থেমে গেল হৃৎকলম, চলে গেলেন সব্যসাচী লেখক

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৯-২৮ ২০:৪৪:৫৫

 আপডেট: ২০১৬-১০-০১ ০১:০৮:৪১

নিরঞ্জন দে:

একজন কবিই পারেন তাঁর কবিতা দিয়ে শাসন-শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনতাকে ডাক দিয়ে স্বৈরশাসনের ভীত কাঁপিয়ে দিতে। যেমন রবীন্দ্রনাথ পেরেছিলেন, যেমন নজরুল পেরেছিলেন, যেমন বেঞ্জামিন মোলায়েস পেরেছিলেন, যেমন পেরেছিলেন তরুণ কবি সুকান্ত। তুমি আমার বাংলা ছাড়ো বলে ডাক দিয়ে ছিলেন কবি সিকান্দার আবু জাফর।

একদিন প্রত্যুষে বাংলার উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে হুংকার দিয়ে ডাক দিয়েছিলেন সৈয়দ শামসুল হকের নুরুলদীন- ‘জাগো বাহে- কোনঠে সবায়’। হাজার কবির ভিড়ে কোন এক কবি তাঁর প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতায় লিখেছিলেন ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’। এই কবি সত্যদ্রষ্টাÑসৈয়দ শামসুল হক। কুড়িগ্রামে জন্ম নেয়া শিশুটির যৌবনে অর্জিত দ্রোহের চেতনা বয়সের ভার ছেপে এগিয়ে আসা আপোষকামিতাকে অগ্রাহ্য করে, বলতে পেরেছিলেন-

‘‘পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের
কখনোই ভয় করিনিকো আমি উদ্ধত কোন খড়গের।’’

তাই তিনি লক্ষ কোটি ভক্তহৃদয়ের অভিভাষণে হয়েছেন ‘সব্যসাচী লেখক’। তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। মৃত্যুকে প্রবল প্রাণের উৎসাহে তুচ্ছ করে লিখে গেছেন ‘শেষ যোদ্ধা’। লিখে গেছেন মৃত্যুশয্যায় থেকেও অনেক কবিতা গান আর গল্প। তাঁর মৃত্যু ‘অমৃত’ দান করে গেছে। একটি লেখনী হয়তো থেমে গেছে কিন্তু তাঁর চেতনার রক্তবীজ থেকে হাজারটা লেখনীর যাত্রা শুরু হবে এই বাংলায়।

রবীন্দ্রনাথের পর দুই বাংলায় মিলে এমন বহুমুখী প্রতিভার স্বাক্ষর যে কজন কবি-সাহিত্যিক রেখে যেতে পেরেছেন। তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য সৈয়দ হক। তিনি সত্যিকার অর্থেই সব্যসাচী। নাটক, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, গান, নিয়মিত কলাম, অনুষ্ঠান নির্মাণ, উপস্থাপনা, সংগ্রামে-সংকটে কোথায় নেই শামসুল হক। তিনি এক প্রজ্ঞাতীর্থ। তিনি বাতিঘর। তাঁর উপস্থিতি ছিল ধ্রুপদী। স্তব্ধ বিটপীর মতো স্থির ছিলেন, কিন্তু বচনে ছিলেন হৃদয়গ্রাহী। মুগ্ধ বিস্ময়ে নিবিষ্ট নয়নে তাঁর কথা শুনতো ভক্তজন। তাঁর সাবলীল উচ্চারণ যেন নাভি থেকে উঠে আসতো এক পরম বিশ্বাসের গন্ধ নিয়ে, যেখানে ছিল পরিমিতি বোধ, ছিলনা আত্মপ্রতারণা।

আমার হক ভাই চলে গেলেন। প্রথম পরিচয়ে খানিক কথা হয়েছিল তাঁর সাথে, ভাবিনি এতেটা কাছে টেনে নেবেন। তাঁর কাছে যাওয়ার কোনো যোগ্যতা আমার নেই, তবুও পেয়েছি তাঁকে পিতার মতো, ভাইয়ের মতো, বন্ধুর মতো, সহযোদ্ধার মতো। সেসব স্মৃতি লেখার মতো মানসিক অবস্থা আজ নেই। আমার সাথে দেখা হলেই জিজ্ঞেস করতেন, ‘কেমন আছো, বৌমা কেমন আছে, মেয়ে দুটি কেমন আছে?’

আমার মাতৃবিয়োগের সংবাদ শুনে একটি দীর্ঘ এসএমএস দিয়ে আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। আমার মতো নগণ্য ব্যক্তির আহ্বানে আমার তথ্যচিত্রে কাজ করেছেন। আমার সংগঠন চারুবাক-এর আমন্ত্রণে সিলেটে তাঁর একক স্বরচিত কবিতা পাঠের আসর হয়েছে। দীর্ঘ দুই ঘণ্টা পিনপতন স্তব্ধতায় সিলেটের বিদগ্ধজনেরা তাঁর নিজ কণ্ঠে কবিতা পাঠ উপভোগ করেছেন। এ নিয়ে তাঁর আনন্দের সীমা ছিল না। কোনো স্মৃতিকথা আজ আর লিখবো না। কতো লিখবো। যা পেয়েছি তা কি সবটুকু লিখে বোঝানো যায়। দীর্ঘদিন কতো কিছু নিয়ে কতো নিরালায় আলাপ হয়েছে তাঁর সাথে। এক আপাদমস্তক ‘আশি বছরের যুবক’ হঠাৎ করেই চলে গেলেন।

দেশের যুব সমাজের বিরাট অংশের মানসিক, জটিলতা, অবক্ষয়, পারিবারিক সুশিক্ষার অভাব, সংস্কৃতি চর্চায় লক্ষ্যহীনতা, প্রাণহীন আনুষ্ঠানিকতা তাঁকে ভাবিয়ে তুলতো। তবুও তিনি আশাবাদী ছিলেন-একদিন বদলাবেই এসব। উপর থেকে সর্বনিম্নে যে পচন, যে চারিত্রিক স্খলন, ধর্মের নামে অধর্ম, অমানবিকতার বীভৎস আস্ফালন এসব দেখে দেখে তাঁর হৃদয়েও ক্ষরিত হয়েছিল উষ্ণ রক্তধারা-এ কোন দেশ? অবাক বিস্ময়ে ভেবেছেন কবি। কবি নেই আছে তাঁর গল্প, উপন্যাস, নাটক, গান কবিতা। কবির মৃত্যু নেই। শব্দব্রহ্মে লীন হয়েছেন মাত্র। যখনই তাঁর শব্দমালা যথাযথ প্রাণের আবেশ মিলিয়ে উচ্চারিত হবে কবি থাকবেন সেখানে, কবি হাসবেন সেখানে। অনাগত দিনের কোন এক কবি তাঁর না বলা কথা বলবেন তখন।

সিলেটের সাথে ছিল কবির অন্তরের টান। প্রেম ছিল তাঁর। সুরমার প্রেম, সবুজের প্রেম, সুফিয়ানার প্রেম, বাউলের প্রেম, বৈষ্ণবের প্রেম। আমি তাঁর বাসায় একটি কাজ সেরে নিতে চাইলে আমাকে বলেছিলেন, ‘‘নিরঞ্জন আমিতো সিলেটে গিয়ে তোমার কাজটি করে দেবো, আমি সুরমার পারে হেঁটে হেঁটে কথা বলবো।’’ কবি দাঁড়িয়ে ছিলেন সুরমার পাড়ে আমাকে নিয়ে- মনে পড়ে আজ সে কথা। সেদিন অনেক গল্প হয়েছিল সিলেট নিয়ে। সিলেটের সংস্কৃতি আর পরম্পরা নিয়ে। তাঁর এখানে একটি যোগ ছিল, তা তিনি মনেপ্রাণে অনুভব করতেন।

আমাকে বলেছিলেন সে কথা। জিনস শার্ট-প্যান্ট পরা, চোখে সানগ্লাস, হাতে ব্রেসলেট এক যুবক চলনে ধীরস্থির। যাপিত দীর্ঘ জীবনের নানা ঘটনা আর অভিজ্ঞতায় তিনি হয়েছিলেন গভীর দৃষ্টি সম্পন্ন। আমার কলেজ জীবনে তাঁর লেখা ‘কেন রুখে দাঁড়াতে হয়’ বইটি পড়ে অনেককিছু অন্যভাবে দেখতে ও বুঝতে শিখেছিলাম। যুগের দাবী উপেক্ষা করে শুধুই কাব্যের উৎকর্ষতায় ডুবে থাকেননি সৈয়দ হক। তাই লিখতেন ‘হৎকলমের টানে’।

সেই কলম কার হাতে তোলে দিয়ে গেলেন কবি- চারিদিকে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মানুষের সংখ্যা তো কম নয়। কবির অক্ষয় কর্মের পথ ধরে যদি কোন মঙ্গলে শঙ্খ বাজে তবে হয়তো বন্ধ কপাট খুলতেও পারে। আত্মপরিচয়ের সংকটে মগ্ন আমরা পরপারের সুখের নেশায় বিভোর হয়ে আছি। এমন সময়ে কে শোনাবে

‘তবে কি তুমি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোন নাই-
সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’

লেখক: তথ্যচিত্র নির্মাতা ও সাংস্কৃতিক সংগঠক।

আপনার মন্তব্য