না, ফিরছি না

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৯-২৮ ২১:৩৯:৫৬

 আপডেট: ২০১৬-১০-০৫ ১৩:০৮:৫৯

ইব্রাহিম চৌধুরী:

ফেরা।
না,ফিরছি না।
সহজে ফেরা যায় না।
ফিরবো বলে বেরিয়েছিলাম।
ফিরা হয়নি।
কেউ ফিরে কদাচিত। কেউ ফিরে না।
আমি না ফেরার দলে।
কেউ অপেক্ষাও করেনি।
কারো কি অপেক্ষা করার কথা ছিল?
উত্তর জানিনা।

অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। শুধু জানি, জীবন চলে জীবনের নিয়মে।সময় যায়। দ্রুত।খুব দ্রুত।
কেমন করে ২০ টি বছর চলে চলে গেলো!
একদিন মনে হতো এই শহরের অনেক কিছুই হবে না, আমি না থাকলে।
সভা হবে না, শ্লোগান উঠবে না, মিছিল যাবে না। মঞ্চ আলোকিত হবে না। নাগরিক সমাজ থমকে দাঁড়াবে।
না,কিছুই থমকে দাঁড়ায়নি।
দুই দশক পর কেউ কি আর মনে রেখেছে।কার এতো দায় পড়েছে?
না, বাস্তবটা ভিন্ন। শেষ পর্যন্ত মানুষ মানুষকেই অবাক করে দেয়।
হারিয়ে যাওয়া অচেনা মুখ জড়িয়ে ধরে অবাক করে বলে উঠে, কেমন আছো বন্ধু।
শীর্ণ শরীর নিয়ে কেউ ঝাপ্টে ধরে বলে উঠে,কেমন আছো কমরেড?
চুপসে যেতে হয়।

প্রশ্নের উত্তরে শুনতে হয়, যেখানে থাকার কথা ছিল-সেখানেই আছি। রাজপথে।
কেউ তার লাফ ঝাপ দিয়ে সিঁড়ি টপকানোর গল্প বলতে চায়।বলতে গিয়ে কুণ্ঠিত হয়। অসহায়ত্ব চোখে পড়ে।
এ যেন,"আমিও জানি-তুমিও জানো" গল্পের ধাঁধাঁ। এদের এড়িয়ে চলি। চলতে হয়।
সময় আর কাজের বন্দিত্ব তো আছেই।
মাত্র সপ্তাহ দুইয়ের জন্য ফেরা।

এর মধ্যে পারিবারিক কাজ অনেক। একা। ছেলে মেয়ের স্কুল। মা সামাল দেবেন সন্তানদের। এবারে আমি নিজেকেই সামাল দিতে হবে। পরিবারের ভালোবাসা আমাদের পংগু করে দেয়।নিজেকে দেখভালের নিয়ন্ত্রণ এখন অন্যের হাতে।নাটাই অন্যের হাতে গেলে সহজেই বলা যায়,ঘূড়ি তুমি কার?
দায় দায়ীত্মের সাথে চিত্তের নিত্য সংঘাত।এবারে চরমে উঠবে।
অনেক সুহৃদ,বন্ধু,অনুরাগী,আত্মীয়, পরিজন জানবেন।জেনে বিরক্ত হবেন।যাদের ভালোবাসায় ছিলাম -আছি, তারা। যাদের ভ্রুকুটিতে ছিলাম তারাও বিরক্ত হবেন।
যদি সময় পাই,কীন ব্রীজে সূর্যোদয় দেখবো।সুরমা পারের কবিয়ালকে আবার মনে পড়বে শ্রদ্ধায়,ভালোবাসায়।সাথে অনেককে।
আদালত মোড়ে দাঁড়াবো।সেখানে এখন কি আর জনসভা হয় নিত্যদিন? মানুষের অধিকার নিয়ে কোন অচেনা কন্ঠ গর্জে উঠে আজকাল?শহীদ মিনারে গিয়ে দাঁ ড়ালে,কি আয়োজন দেখা যাবে?পারলে একাটি মটর সাইকেল নিয়ে টুকের বাজার থেকে জাফলং পর্যন্ত যাব।থামতে হবে অনেকবার।মোড়ের পান বিড়ির দোকানগুলো কি আছে আজো? পুরনো দেনার কথা কি মনে করিয়ে দেবে কেউ?

প্রিয় শহরে সন্ধ্যার কোলাহলটা কোথায়?নাটকের সুহৃদরা কি বিচ্ছিন্ন এখন?প্রান্তিক চত্বর তো আর নেই এখন।
আদালত পাড়ায় এখন কাদের দাপট? চেয়ারটিতে নতুন কোন পেশাজীবী এখন বসে থাকেন মক্কেলের অপেক্ষায়।
কমরেডরা কোথায়।বেলা বাড়লে ডেকে উঠাতে হবে।
বেলাশেষে আবারো বলবেন, অধিকারহারা বঞ্চিত মানুষের কথা স্পষ্ট উচ্চারণে।
সংবাদকর্মীরা এখন কোথায় আড্ডা দেন।অন্যের খবর ফেরি করে নিজেদের খবর এখন আর কাদের বলাহয় না।নিজেরা কতোটা বিভক্ত,তার খবর দেবেন।
বিপণীকেন্দ্র গুলোর সামনে কারা দাঁ ড়ায় এখন?রিকশায় যাওয়া মেয়েদের দেখে কারা টিপ্পনী দেয়?
পারলে চুপি চুপি দেখে নেবো সব।
রাত বাড়লে ভদ্র সমাজের কারা কারা এখন অতী ভদ্র হয়ে উঠে?এদেরও যে খোজ রাখতে হয়!
নগর কেন্দ্রের বাতিগুলো কতো রাতে এখন হলুদ হয়?কারা এখন জলে রঙ মেশায়?
নগর ভবনের সামনের বেওয়ারিশ কুকুরটি কি হলুদ বাতির নীচে দাঁড়িয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাবে?না ঘেউ ঘেউ করে উঠবে?
পরিবারের কেউ না থাকলেও এই শহরকেই আমার আপন মনে হয়।সব গলি পথে পাওয়া যাবে পদচিহ্ন।
"এই শহর জানে আমার গোপন অনেক কিছু".।
হারিয়ে যাওয়া চেনা মুখ খুঁজব। অনেকের সান্নিধ্যহীনতা পিড়ীত করবে।বুকটা হাহাকার করবে।
গ্রামে যাব।খেয়া নৌকার সেই মাঝি কি আছেন? দেখলে জড়িয়ে ধরবেন নির্ঘাত।ঘামের ঘন্ধে মাতাল হবো।আসবেন বর্গা চাষীরা।খোজ নেবেন পরিবারের সবার।জানাবেন,হাল চাষে আর বলদ লাগে না।

বলদগুলো এখন কি করে?
উত্তরে হাসবেন কৃষক। এ হাসি বড় অর্থবহ।জানাবেন,ছাগলের সংখ্যাও কমছে দিন দিন।বড়ই দু:সময় তাদের।
মেঠো পথ আর নেই হয়তো।খবর পেয়ে দূর থেকে ছুটে আসবেন নিষ্পাপ মানুষগুলো।
বাপ দাদার বিরান ভিটেতে দাঁড়িয়ে কি স্থির থাকা যাবে?
বাবার হাতল ভাঙা চেয়ারটি কি আছে এখনো? আঙিনায় খুঁজে ফিরবো পূর্ব পুরুষদের পদচিহ্ন।বাবার লাগানো রক্তজবা গাছটি কি এখনো বংশ বিস্তার করে?
মা, নিজ হাতে বরই গাছটা লাগিয়েছিলেন।এখন কি বরই ফলনের সময়?
বাবা বেল তলায় বসতেন।বসে কাঠাল গাছের ফাঁকে সুর্যের তাপ নিতেন শীতকালে।
আমরা এক দংগল ভাই বোনের বাল্য শৈশবের ভিটে মাটি।সবাই আজ দূরের জনারন্যে ।আমার মতো ফেরা না ফেরার সংঘাতে।
সময়, জীবন সব বদলে গেলো।
মায়ের কবরে আমরা নিত্য যাই। আমাদের হাসী কান্না শুনাতে যাই।আমেরিকায় কেউ গেলে,তাকেও নিয় যাই।মায়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে বাবাকে মনে করি।
কাঠাল গাছের নীচে বাবার কবর। এখানেও কি সূর্যের তাপ পান?
জানি না।অনেক প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই।

যদি চিৎকার করেও বলি,"বাবা দেখো তোমার ছেলে এসেছে?তোমার সন্তানদের মধ্যে ডানপিটে ছেলেটি।অন্যরা সবাই ভালো আছে বাবা।আমিও এখন বাবা হয়েছি।তোমার সব ছোট ছেলেটিও দুই সন্তানের বাবা।বাবা, আমি - আমরা বদলে গেছি----"
বাবা কি শুনতে পাবেন?

আপনার মন্তব্য