প্রকাশিত: ২০১৫-০৮-১১ ১৬:০৪:২৪
বিচারক দিনের শুনানী মুলতবী করে দিয়ে পুলিশ-এলিট ফোর্সের তদন্ত কর্মকর্তাদের বলেন, ১০০ পিস ইয়াবা আর মৃত:
এজলাস কক্ষ থই থই করছে; অনেকগুলো কেসের শুনানী। সবাই জামিন প্রার্থী। বিচারক আদালত কক্ষে ঢুকে সামনে তাকিয়ে চোখে সর্ষে ফুল দেখেন। নিজেকে সামলে নিয়ে চেয়ারে বসেন।
আসামী দবির হাজির বলতেই এক বয়স্ক মানুষকে নিয়ে আসা হয়। উনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার ছেলে ছাত্রলীগ নেতা; তার কোন অপরাধে বুড়ো মানুষটাকে হাতকড়া বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। বিচারকের অবাক লাগে। ছেলের অপরাধে যদি মুক্তিযোদ্ধা পিতাকে এভাবে ধরে আনা হয়; তাহলে বিএনপি শীর্ষ নেত্রী বা আওয়ামী লীগ নেতা মায়া সসম্মানে ঘুরছে কেন! অর্থনৈতিক সামর্থ্যটাই কী আসল! মুক্তিযোদ্ধার জামিন হয়না। কারণ এলাকার সাংসদ মুক্তিযোদ্ধার অভিযুক্ত ছেলেটির ওপর বেজায় ক্ষিপ্ত। রাজাকারের ছেলে সাংসদ হয়েছে; সে এখন দেশপ্রেমের কংক্রীটের স্তম্ভ।
আসামী ছাবেদ হাজির। হাঁক দিতেই এক লোক গরমের মধ্যে চাদর মুড়ে প্রায় মুখ ঢেকে হাজির হয়। এর বিরুদ্ধে অভিযোগ তার কাছে ‘১০০’টি ইয়াবা পাওয়া গেছে। বিচারক জিজ্ঞেস করেন, আপনি কী ইয়াবা ব্যবসায়ী।
ছাবেদ উদভ্রান্তের মতো জিজ্ঞেস করে, ইয়াবা কী স্যার!
পুলিশের চার্জশিটে লেখা এ লোক কুখ্যাত ইয়াবা ব্যবসায়ী।
ছাবেদের আইনজীবী বলে, মাননীয় বিচারক লোকটা বিএনপি করে। সে আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার জন্য পার পিস পাঁচলাখ জমা দিতে না পারাতেই এ মিথ্যা মামলা।
বিচারক জিজ্ঞেস করেন, লোকটা কী পেট্রোল বোমা মেরেছিলো!
ছাবেদ জিজ্ঞেস করে, পেট্রোল বোমা কী স্যার।
আইনজীবী বলে, মাননীয় বিচারক বোমা মারতে জানলে পাঁচ লাখ টাকাও জোগাড় করতে পারতো। এই লোক কিছুই পারে না জন্যই তার বিরুদ্ধে ইয়াবা কেস সাজানো হয়।
ছাবেদের জামিন হয়না। কারণ এ মুহূর্তে বিএনপির এরকম ইউজলেস কর্মী মুক্তি দিয়ে বিচারক ট্রান্সফারের শিকার হতে চাননা।
এনকাউন্টারে মৃত এক তরুণের আব্বা বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে। তার একটি সংক্ষিপ্ত শুনানী শুরু হয়। পুলিশ প্রতিবেদনে লেখা মৃতদেহের পাশে একটি রিভলভার পাওয়া গেছে।
মৃত তরুণের আব্বা কাঁদতে কাঁদতে বলে, এলাকার আসল আসামীদের ধরতে না পেরে আমার এই দিনমজুর ছেলেটাকে খুন করেছে স্যার। খুনের জন্য মেডেলও পেয়েছে এলিটফোর্সের লোকজন। আইনশৃংখলা রক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য বিচার বহির্ভুত হত্যা (বিবহ)’র বিনিময়ে পদকও জোটে আর কী!
বিচারক এর আর কী বিচার করবেন! মনে মনে ভাবেন, কাজ আর পাইনি বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সিস্টেমের আবর্জনা লুকানোর কাজ নিয়েছি।
আসামী টিটু হাজির। এর বিরুদ্ধে ফেসবুকে গালিগালাজের অভিযোগ। ৫৭ ধারায় ধরে আনা হয়েছে। পুলিশ বিচারকের কানে কানে বলে এর ভাই আওয়ামী লীগের বীর ক্যাডার; একাই গুলি কইরা শাপলা চত্ত্বর থিকা হেফাজত সরাইছে। এক ভাই গোলাগুলির বীর আরেকজন গালাগালির। এর মা রত্নগর্ভা। টিটুরে ছাইড়া দেন স্যার।
বিচারক বলেন, শাপলা চত্বর থেকে সাউন্ড গ্রেণেড ব্যবহার করে শান্তিপূর্ণভাবে হেফাজতের লোকদের সরিয়ে দিয়েছে পুলিশ। সেখানে টিটুর বীর বাহাদুর ক্যাডার ভাইয়ের গোলাগুলির তো দরকার ছিলো না।
পুলিশ কাঁচুমাচু করে হাইলেভেলের এক চাপরাশির সুপারিশ আছে স্যার।
বিচারক বিরক্ত হয়ে বলেন, চাপরাশির চাপেই যদি জামিন দিতে হয়; বাপরাশির চাপেতো বেকসুর খালাস দিতে হবে।
টিটুর জামিন হয়ে যায়। দাঁত বের করে বিজয়ীর হাসি দেয় সে। মনে মনে চ-বর্গীয় একটা গালি দেয় বাতাসের বিরুদ্ধে।
আসামী মওলানা কসিমউদ্দিন। তার কাছেও ‘১০০’টি ইয়াবা পাওয়া গেছে। জামাতের লোক পার পিস ১০ লাখ টাকা দিয়ে সরকারী দলে যোগ দিতে না পারায় তাকে ধরে আনা হয়েছে। আইনজীবীর এ অভিযোগ শুনে বিচারক জিজ্ঞেস করেন,
- আপনি কী ইয়াবা ব্যবসায়ী!
- আমি স্যার বাবা জর্দা ছাড়া আর কিছুই খাইনা।
- আপনি কী জঙ্গী! আল-কায়েদার সঙ্গে কী কোন সম্পর্ক আছে আপনার।
- অত বড় সম্পর্ক থাকলে কী আর স্যার ১০ লাখ টাকা জোগাড় করতে না পাইরা জেলে পচি। যাগো সম্পর্ক আছে, সবাই ফুল-মালা দিয়া এখন সরকারী দলে ঢুইকা পড়ছে।
বিচারকের একে জামিন দিতে ভয় লাগে। লোকটার চেহারা বাংলা ভাইয়ের মতো। থাকুক জেলে। বাইরে থাকা জেলে থাকা এ জগতে একই ব্যাপার। কারণ বিচারকের নিজেকেও একটি ভুল ব্যবস্থায় আটকে থাকা মানুষ বলেই মনে হয়। ন্যায় বিচারের শপথ নিয়ে এসে যে অবিচারের সাক্ষী গোপাল হতে হচ্ছে; এর চেয়ে পানের দোকান দিয়ে মুক্ত জীবন যাপন করা শতগুণ ভালো।
কাঁদতে কাঁদতে একজন মা প্রবেশ করে। তার ছেলে ক্রসফায়ারে মারা গেছে। পুলিশ প্রতিবেদনে লেখা, মৃতদেহের পাশে একটি রিভলভার পাওয়া গিয়াছে।
বিচারক মৃত কথিত আসামীর মাকে বলেন, আপনার ছেলে তো সন্ত্রাসী। তার কাছে পিস্তল পাওয়া গেছে!
ক্রসফায়ারে মৃতের মা কাঁদতে কাঁদতে বলে, ছেলে আমার পানের দোকানদার ছিলো। রাতে ঢোপ গুঁটাইয়া বাড়ি ফিরার পথে কালো ড্রেস পরা লোকেরা তারে তুইলা নিয়া যায়। যারা দেখছে নিজ চোখে তারাই বলছে। আমার ছেলে বলছে, আমি পানের দোকানদার স্যার।
কালো পোশাকের লোকেরা ধমক দিয়ে বলে, আমরাও সুপারী বেচি। কাইল আমরা একজন সন্ত্রাসীর মৃত্যুর সুখবর দিতে চাই মিডিয়ায়।
বিচারকের ভেতরটা কেঁপে যায়। পানের দোকানদার হয়েও তো মুক্তি নেই। বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে। ক্রসফায়ারে মৃতের মা বাকী জীবন ছেলের কবরের পাশে বসে কাঁদার রায় নিয়ে ফিরে যায়।
এরপর আসামী শাহীনকে হাজির করা হয়। তার কাছেও ১০০ পিস ইয়াবা পাওয়া গেছে। বিচারকের বেশ অবাক লাগে। ঠিক ১০০ পিস ইয়াবাই কেন পাওয়া যাচ্ছে সবার কাছে!
শাহীনের আইনজীবী বলে, এর চাচাত ভাই ভূমিখেকো ও বালি ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সামনে প্রতিবাদ জানানোতেই; ভূমি খেকোর বন্ধু উচ্চমহলের চাপরাশির চাপে এ মামলা হয়েছে।
বিচারক পুলিশকে জিজ্ঞেস করে, সেই একই চাপরাশি নাকি!
- ইয়ে স্যার চাপরাশি-চাপরাশিই। এরা চেয়ার না মুছলে মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী তো চেয়ারেই বসতে পারবেন না।
- তা ঠিক ‘চেয়ার’ মোছার বিনিময়ে চাপরাশির চাপ দেয়া রাশির লোক হয়ে পড়াই স্বাভাবিক।
ভূমি খেকোদের একজন প্রতিনিধি এসেছে। তাকে সাক্ষী দিতে হবে।
ভূমি খেকো বলে, স্যার আমরা প্লট বেচিতো; আমরা জানি তো; একই প্লট দুইবার বেচা যায়না। কিন্তু পুলিশের, এলিট ফোর্সের সমস্যা হইতেছে তারা একই প্লট বার বার বেচতেছে। পাবলিক খাইতেছে না। ইদানীং বাংলা ফিল্মের খারাপ সময় যাইতেছে। অনেক চিত্রনাট্যকারই বেকার বসে আছে। এগোরে স্যার পুলিশ-এলিট ফোর্সের চার্জশিট লেখার কাজে নিয়োগ দিলে আমারে আইজ এই মিথ্যা সাক্ষী দিতে আইতে হইতো না!
এরপর আবার ক্রসফায়ার কেস। চার্জশিট না দেখেই বিচারক এলিট ফোর্সের তদন্ত কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেন, আসামীর মৃতদেহের পাশে রিভলভার পাওয়া গেছে এই তো।
তদন্ত কর্মকর্তা খুব খুশী হয়ে জী মাননীয় আদালত, জী স্যার জী স্যার বলে ওঠে।
বিচারক দিনের শুনানী মুলতবী করে দিয়ে পুলিশ-এলিট ফোর্সের তদন্ত কর্মকর্তাদের বলেন, ১০০ পিস ইয়াবা আর মৃতদেহের পাশে রিভলভারের গল্পটা চেঞ্জ করে নিয়ে আসেন। গল্পই যদি বানাবেন, নতুন গল্প বানান।
আপনার মন্তব্য