ধারাবাহিক উপন্যাস: বসনা- ৬

রেজা ঘটক

 প্রকাশিত: ২০১৫-০৮-৩১ ২১:৫৩:৪৯

 আপডেট: ২০১৫-০৮-৩১ ২১:৫৮:০২

বসনা উপন্যাস মূলত ইতিহাস প্রধান। বসনিয়া যুদ্ধ ও জীবন এই উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। লেখার পরতে পরতে ফুটে:

পূর্ব প্রকাশিতের পর...
সারায়েভো, ২৮ জুন ১৯১৪
আমরা এখন যে পাহাড়ি জঙ্গলে পালিয়ে আছি, এখান থেকে কুলা আরো ৩০ মাইল দক্ষিণে। গত এক সপ্তাহ ধরে এদিকটায় সার্ব-জঙ্গিবিমান গুলো দিনের বেলায়ও আক্রমণ করেছে। আমরা কেবল জীবন নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। যুদ্ধের ভেতর জীবন নিয়ে পালিয়ে থাকা যে কতটা দুর্বিসহ তা যুদ্ধ যারা ফেইস করেনি, তারা কোনোদিনও বুঝবে না।

আমার ছোটমেয়ে মার্সিয়া, মার্সিয়ার ছেলে আহমেদ, রাফিয়ার মেয়ে আমার আদরের মায়া কোথায় আছে, আমরা জানি না। ওরা আদৌ বেঁচে আছে কিনা তাও জানি না। বেঁচে থাকলে কোথায় কিভাবে আছে, তাও জানি না।

আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী হাইরিয়া, আমার মেজো মেয়ে রাফিয়া, রাফিয়ার ছেলে ডেভিড আছে। হাইরিয়ার মেজো ভাই রুস্তুমের ছেলে রাহমান গত সপ্তাহে তুজলা গেছে। ওদের গ্রামের বাড়ির কী অবস্থা তা দেখার জন্য। রাহমানরেও আর কোনো খবর নাই। রাহমান কী আদৌ বেঁচে আছে কিনা আমরা তাও জানি না।

তুজলায় হাইরিয়ার বাপের বাড়ির অন্য সবাই কেমন আছে, আমরা তারও কিচ্ছু জানি না। এই পাহাড়ি জঙ্গলে সবচেয়ে অসুবিধা খাবার পানির। পানি ছাড়া এভাবে আমরা আর কতদিন বাঁচব জানি না। যুদ্ধ কবে কখন শেষ হবে আমরা তাও জানি না। গোটা বলকান এলাকা আবার সেই পুরানা যুদ্ধে জড়িয়ে গেল। যুদ্ধ যেন বলকানদের একটা নিয়তি। যুদ্ধ ছাড়া এরা বাঁচতে পারে না।

চতুর্দশ শতকের শেষের দিকে অটোমান তুর্কি শাসক ইউরোপের গোটা বলকান এলাকা দখল করেছিল। বলকান নামটিও তুর্কি শাসকের দেওয়া। বলকান অর্থ হচ্ছে 'পাহাড়ি'। পাহাড়ি এলাকার কারণে তুর্কিরা এদিকটার বলকান নাম দিল। তারপর পাঁচশো বছর অটোমান তুর্কিরা এই বলকান অঞ্চল শাসন করলো। সপ্তদশ শতকের শেষের দিকে অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সম্রাট উত্তরাঞ্চল থেকে তুর্কি শাসনের কিছুটা অবসান ঘটাল। সেটা ১৮৭৮ সালের কথা।

১৮৭৮ সালে বার্লিন চুক্তির মাধ্যমে বলকান অঞ্চলের নতুন সীমানা নির্ধারিত হল। তখন সার্বিয়া, মন্টেনির্গো আর রুমানিয়া স্বাধীন হল। আর বুলগেরিয়ার নিজস্ব সীমানা নির্ধারিত হল। ওই সময় স্লোভেনিয়া আর ক্রোয়েশিয়া অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সম্রাটের অধীনে আসলো। ফলে তখন বসনিয়া হারজেগোভিনাও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সম্রাটের দখলে আসলো।

বিংশ শতকের শুরু থেকে অটোমান তুর্কি শাসনের ভাঙ্গন শুরু হল। গোটা বলকান অঞ্চলে তখন থেকেই মূলত জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চাঙ্গা হতে শুরু করলো। ওই গোটা যুদ্ধের পেছনে আসলে সার্বিয়ার দুই রয়্যাল পরিবার দায়ী।

সার্বিয়ায় তখন দুই রয়্যাল পরিবার, দুই সাম্রাজ্যের কাছ থেকে সরাসরি সাহায্য সহযোগিতা পাচ্ছিলো। তখন অব্রেনোভিক পরিবার ছিল অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সম্রাটের সাহায্যপুষ্ট। আর কারাদোর্দেভিক পরিবার ছিল রাশিয়ার সম্রাটের সাহায্যপুষ্ট।

মিলোস টিউডোরোভিক ছিলেন তাঁর মায়ের দ্বিতীয় বিবাহের প্রথম সন্তান। মিলোসের মা ভিনিয়া গজকোভিক প্রথম বিয়ে করেন অব্রেন মার্টিনোভিককে। সেখানে তাঁর তিন সন্তানের জন্ম। সান্তা, জ্যাকোব আর মিলান। ভিনিয়া পরে বিয়ে করেন মিলোসের বাবা মিস্টার থিউডোর মিহাইলোভিককে। সেখানেও তিন সন্তান মিলোস, জোভান আর জেভরেম। প্রথম সার্বিয়ান বিপ্লবের সময় মিলোস আর মিলান সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন। বিপ্লবে হাফ-ব্রাদার মিলানের মৃত্যুর পরে, মিলোস নতুন সুরনেম নিলেন অব্রেনোভিক। অব্রেনোভিক ছিল মিলানের বাবার ফার্স্ট নেম।

আর জোর্জে পেট্রোভিচ ছিলেন আধুনিক সার্বিয়ার প্রতিষ্ঠাতা। তাঁকে সবাই ব্ল্যাক জর্জ নামে ডাকতেন। যাকে সার্বিয়ান ভাষায় বলে কারাজোর্জে। তিনশো বছর ধরে অটোমান তুর্কি সাম্রাজ্যের অধীনে থাকা সার্বিয়া জোর্জে’র নেতৃত্বে প্রথম স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। ১৮০৪ থেকে ১৮১৩ সাল পর্যন্ত কারাজোর্জে ছিলেন সার্বিয়ার স্বায়ত্তশাসনের প্রধান নেতা। অটোমানের বিরুদ্ধে প্রথম সার্ব বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন এই কারাজোর্জে। কিন্তু ১৮১২ সালে ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন বেনোপার্ট অটোমান যুদ্ধের হুমকি প্রদান করলে দ্রুত সময়ের মধ্যে রাশিয়া অটোমানের সাথে একটি শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৮১৩ সালে অটোমান বিপ্লবের সময় মিলোসদের হাতে সার্বিয়ার প্রিন্স জোর্জে পেট্রোভিচ নিহত হন। ১৮৩৯ থেকে ১৮৪২ এবং ১৮৬০ থেকে ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত সার্বিয়ার প্রিন্স ছিলেন মিহাইলো অব্রেনোভিক।  

১৯১২ সালে মন্টেনির্গো সেনাবাহিনী অটোমান তুর্কি সীমান্তে বিশাল আকারের সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে অটোমান তুর্কি শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল। কয়েক দিনের মধ্যে মন্টেনির্গো সেনাবাহিনীর সাথে সার্বিয়া, বুলগোরিয়া এবং গ্রিস সেনাবাহিনী যোগদান করল। এই চার বলকান মিত্রবাহিনী তখন অটোমান দখল থেকে বলকান এলাকার কসোভো, মেসিডোনিয়া এবং আলবেনিয়াকে মুক্ত করেছিল এবং এদেরকে স্বাধীন দেশ হিসেবে ঘোষণা করেছিল। পরবর্তীতে সার্ব সেনাবাহিনী বুলগেরিয়ার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে কসোভো আর মেসিডোনিয়া নিজেদের দখলে নিয়েছিল। সার্বিয়া তখন বৃহৎ সার্বিয়া বা যুগোস্লাভিয়া গঠনের নামে এই অভিযান শুরু করেছিল।

১৯১৪ সালে বলকান এলাকায় সার্ব আগ্রাসন ঠোকানোর জন্যে অস্ট্রিয়ার সম্রাট ফ্রাঞ্জ জোসেফ, ছোট ভাই কার্ল লুডজিগের ছেলে আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফারডিন্যান্টকে বিশেষ দূত হিসেবে সারায়েভো পাঠান। আমরা স্কুলের পাঠ্য বইতে এসব মুখস্থ করেছি। এখন এই যুদ্ধের সময় এই পাহাড়ি জঙ্গলে বসে বলকান যুদ্ধের সেই সব অতীত ইতিহাস মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে কত টাটকা সেদিনের সেই ঘটনাগুলো। আমার দাদুভাই এব্রাহাম সেই যুদ্ধে সরাসরি যোগ দিয়েছিল। দাদুভাইয়ের বয়স তখন ছিল ডেভিডের মত আঠারো উনিশ। কিভাবে সেই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল? যাকে আমরা সবাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নামে জানি?

২৮ জুন ১৯১৪ ছিল রবিবার। সকালবেলায় অস্ট্রেরিয়ান তৎকালীন প্রভিন্স বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো’র এ্যাপেল কুইয়ি এভিনিউতে সাত জন বিদ্রোহী সার্ব জোয়ান অবস্থান নেয়। অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান ব্যাংক ভবনের কাছাকাছি এই দলের প্রথম ব্যক্তি অবস্থান নেয়। তিনি ছিলেন মুসলিম এবং পেশায় ছিলেন একজন কাঠমিস্ত্রী। তার কয়েক গজ দূরে টিচার ট্রেনিং কলেজেন সামনে অবস্থান নেয় দ্বিতীয়জন, যিনি পেশায় একজন টাইপসেটার। যার একহাতে ছিল একটি এন্টি-অস্ট্রেরিয়ান পত্রিকা আর তার কোটের পকেটে ছিল বোমা আর স্বয়ংক্রিয় পিস্তল। সেখান থেকে কিছুটা দূরে ব্রিজের উপর দাঁড়িয়েছিল সারায়েভো হাইস্কুলের দুইজন ছাত্র। সদ্য বেলগ্রেড থেকে আসা অপর দুই ছাত্র দাঁড়িয়েছিল পাশের ব্রিজের উপর। আর দলের সপ্তম ব্যক্তির কোনো নির্দিষ্ট দাঁড়াবার জায়গা ছিল না।

সে সকাল থেকে অন্য সবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে কথাবার্তা বলছিল। সে ছিল একজন ২৪ বছর বয়সি স্কুল শিক্ষক এবং একটি এন্টি-অস্ট্রিয়ান পত্রিকার সম্পাদক। গ্রুপের পাঁচজনের বয়সই বিশ বছরের কম আর তারা সবাই প্রায় বসনিয়া অথবা পাশের হারজেগোভিনা প্রভিন্সের স্থানীয় লোক। একমাত্র মুসলিম কাঠমিস্ত্রী ছাড়া দলের বাকী সবাই সার্ব অর্থোডক্স ক্যাথোলিক। সবার কাছেই তখন স্বয়ংক্রিয় পিস্তল আর বোমা ছিল। এছাড়া সুইসাইড করার জন্য ছিল সায়ানাইড ট্যাবলেট।

ঠিক সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে সাতটি গাড়ি সেখানে আসলো। প্রথম গাড়িতে সারায়েভো’র ডিটেকটিভ প্রধান আর তিনজন স্থানীয় পুলিশ অফিসার। দ্বিতীয় গাড়িতে সারায়েভো’র মেয়র ফেহিম ইফেন্দি কারকিক আর সারায়েভোর পুলিশ প্রধান ডক্টর এডমুন্ড জার্দে। তৃতীয় গাড়িতে আর্চডিইক ফ্রান্স ফারডিন্যান্ট, তাঁর স্ত্রী প্রিন্সেস সোফি, বসনিয়ার গভর্নর জেনারেল ওসকার পোটিওরেক আর আর্চডিউকের বডিগার্ড লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফ্রাঞ্জ ভন হারাচ।

চতুর্থ গাড়িতে আর্চডিউকের মিলিটারি উপদেষ্টা ব্যারন কার্ল ভন রুমারক্সিরিচ, সোফি’র মহিলা এসিসট্যান্ট উলমা লেনিয়াস ভন উলেবাগ, পেটিওরেকের চিফ এ্যাডজুট্যান্ট লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইরিচ এডলার ভন মেরিজ্জি আর লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাউন্ট আলেক্সজান্ডার বস-ওয়ালডেক। পঞ্চম গাড়িতে ভিয়েনার ফিয়াট ফ্যাক্টরির ডিরেক্টর এডলফ এগার, মেজর পল হাইজার, কর্নেল কার্ল বার্ডফ আর ডক্টর ফারডিন্যান্ট ফিশার।

ষষ্ঠ গাড়িতে ব্যারন এন্ড্রিয়াস ভন মোর্সে, ক্যাপ্টেন পিলজ ও আর্চডিউকের কয়েকজন স্টাফ আর বসনিয়ার কিছু স্থানীয় অফিসার। আর একেবাওে পেছনের সপ্তম গাড়িতে মেজর ইরিচ রাইটার ভন হাইটেনব্রেনার, কাউন্ট জোসেফ জু ইরবাচ ফার্সটেনু আর লেফটেন্যান্ট রবার্ট গ্রিন। আর্চডিউক ফ্রান্স ফারডিন্যান্ট সারায়ভো’র সিটি হলে মিউজিয়ামের ওপেনিং অনুষ্ঠান ভিজিট করবেন।

উল্লাস, চিৎকার আর হর্ষধ্বনির মধ্যে আর্চডিউক ফ্রান্স ফারডিন্যান্টের গাড়ি যখন প্রসেসিংয়ে অভ্যর্থণা নিয়ে বিদ্রোহী দলের প্রথম সদস্য মুসলিম কাঠমিস্ত্রীকে অতিক্রম করছিল, তখন তার ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়েছিল একজন পুলিশ সদস্য। ভয়, সঙ্কা আর সিদ্বান্তহীনতার কারণে কাঠমিস্ত্রী মেহমেদ মেহমেদভাইক কিছুই করতে পারলো না। বিদ্রোহী দলের পরবর্তী সদস্য টাইপসেটার ভাসো কুব্রিলোভিকও যথারীতি আক্রমণ করতে ব্যর্থ  হলো।

আরো সামনে রাস্তার উল্টোপাশে মিলিইক্সা নদীর পাশে ছিল নেডেলকো কাব্রিনোভিচ। নেডেলকো ছিল ওদের চেয়ে অধিক শক্ত মনের। আর্চডিউকের গাড়ি দেখা মাত্র সে পকেট থেকে বোমা বের করলো। আর লাইট পোস্টের আড়ালে দাঁড়িয়ে দ্রুত বোমাটির ক্যাপ অফ করে আর্চউিকের গাড়িতে নিক্ষেপ করলো। ওটি ছিল আসলে একটি হ্যান্ড গ্রেনেড। গ্রেনেডটি আর্চডিউকের গাড়ির খোলা ছাদের হুটে লেগে রাস্তায় গড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে গ্রেনেডটি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো এবং  পেছনের গাড়ির অন্তত ২০ জন প্রচ-ভাবে আহত হলো। কিন্তু আর্চডিউক ফারডিন্যান্ট ওই হামলায় সম্পূর্ণ অক্ষত রইলেন।

ওদিকে নেডেলকো কাব্রিনোভিচ সায়ানাইড ট্যাবলেট মুখে দিয়ে মিলাইক্সা নদীতে লাফিয়ে পড়ল। প্রোসেসিং তখন দ্রুত সিটি হলের দিকে এগিয়ে গেল। পেছনে পড়ে থাকল কেবল আহত মানুষের চিৎকার আর ভয়ানক বিভৎসতা। উপস্থিত জনতা মিলাইক্সা নদী থেকে নেডেলকোকে তুলে গণ ধোলাই দিতে লাগলো। কারণ তার সায়ানাইড ছিল খুব পুরাতন, তাই ওটা ঠিকমতো কাজ করেনি। নেডেলকো বারবার শুধু বমি করছিল। পরে পুলিশ এসে নেডেলকোকে উদ্ধার করে নিয়ে গেল। ওদের দলের বাকী সদস্যরা মানে কাইজেটকো পপোভিক, গাবরিলো প্রিনচিপ বা ত্রিফুন গ্রাবেজরা তখন গাড়ি বহরের স্পিডের কারণে কিছুই করতে পারলো না।
টাউন হলের সংক্ষিপ্ত মিটিং-এ আর্চডিউক ফ্রান্স ফারডিন্যান্ট বললেন, "Mr. Mayor, one comes here for a visit and is received by bombs! It is outrageous!"  মিস্টার মেয়র এখন আপনার বক্তৃতা দেওয়া উচিত। এরপর মেয়র তাঁর বক্তব্যে বললেন, "Your Royal and Imperial Highness!...Our hearts are full of happiness..."

এরপর আর্চডিউক তাঁর লিখিত বক্তব্যে সবাইকে ধন্যবাদ জানালেন। মিটিং শেষে জেনারেল পোটিওরেক বললেন, শহরে সম্ভবত বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। তিনি আর্চডিউক ফারডিন্যান্টকে শহর ছেড়ে চলে যাবার জন্য পরামর্শ দিলেন। কিন্তু আর্চডিউক হাসপাতালে আহত মারিজ্জিকে দেখতে যেতে চাইলেন। আর কোনো সিডিউল পরিবর্তন করতে চান না তিনি। হাসপাতাল ঘুরে তিনি মিউজিয়ামে যাবেন। পরে গভর্নরের বাসায় গিয়ে লাঞ্চ করবেন।  

এরপর আর্চডিউককে নিয়ে সবাই শর্টকাট পথে রওনা দিল। ওদিকে গাবরিলো প্রিনচিপ এ্যাপল কুইয়ি দিয়ে হেঁটে হেঁটে ল্যাটিন ব্রিজের পাশে গিয়ে জোসেফ স্ট্রিটে মরিটচ স্কিলার ফুড স্টোরে তখন স্যানডুইচ খাচ্ছিলো। শহর থেকে বের হবার জন্য আর্চডিউকের গাড়ি মিলাইক্সা নদীর ল্যাটিন ব্রিজ দিয়ে বের হতে গেল। জায়গাটা অনেকটা ইংরেজি অক্ষর ভি’র মতো। গাড়ি টার্ন করার জন্য একটু স্লো করতে হলো। লেটিন ব্রিজের ঠিক ওই পয়েন্টে তখন দাঁড়িয়েছিল ইয়ং বসনিয়ার ব্ল্যাকহ্যান্ড গ্রুপের সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য মাত্র ১৯ বছরের গাবরিলো প্রিনসিপ। খুব কাছ থেকে তখন সে একটি এফএন মডেল-১৯১০ পকেট পিস্তল বের করে পরপর দুটি গুলি করলো। প্রথম গুলিটি লেগেছিল প্রিন্সেস সোফি’র তলপেটে আর দ্বিতীয় গুলিটি লেগেছিল আর্চডিউক ফারডিন্যান্টের গলায়।

গাড়ির পেছনের সিটে ছিলেন কাউন্ট ফ্রাঞ্জ ভন হারাচ। তিনি আর্চডিউকের ইউনিফরম টেনে তুলে গলায় রুমাল চেপে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করলেন। আর্চডিউক তখন উচ্চারণ করলেন, ‘ডিয়ার সোফি, ডিয়ার সোফি, ডোন্ট ডাই, স্টে এ্যালাইভ ফর আওয়ার চিলড্রেন...’। জেনারেল পোটিওরেক মনে করেছিলেন, কারো গুলি লাগেনি। তাই ড্রাইভারকে বললেন, সোজা গভর্নর হাউজে যাও। গভর্নর হাউজে যাওয়ার পথে প্রথমে সোফি’র মৃত্যু হয়। তার পরপরই আর্চডিউক ফ্রান্স ফারডিন্যান্টেরও মৃত্যু হয়।

আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফারডিন্যান্টের মৃত্যুর কারণে অস্ট্রিয়া সার্বিয়ার বিরুদ্ধে তখন যুদ্ধ ঘোষণা করলো। যুদ্ধে অস্ট্রিয়ার পক্ষে হাঙ্গেরী, জার্মানি আর ইতালি যোগ দিল। আর সার্বয়ার সঙ্গে যোগ দিল তাদের তিন মিত্র শক্তি রাশিয়া, বৃটেন আর ফ্রান্স। ২৮ জুন ১৯১৪ সালে আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফারডিন্যান্টের মৃত্যুর কারণেই শুরু হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। যা শেষ হয় ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর।

এই যুদ্ধে প্রায় আশি লাখ লোক প্রাণ হারিয়েছিল। প্রায় সত্তর লাখ লোক চিরতরে পঙ্গু হয়েছিল। আর প্রায় এক কোটি পঞ্চাশ লাখ লোক আহত হয়েছিল। ২৮ জুন ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধের ফলে জার্মান, রাশিয়া, অটোমান তার্কি, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসান ঘটেছিল। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে তখন নতুন কয়েকটি দেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল। রাশিয়া ও অটোমান সাম্রাজ্য থেকে কলোনিগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছিল। আর বিশ্ব শান্তি বজায় রাখার জন্যে যাত্রা শুরু করেছিল লিগ অব নেসন্স বা জাতিপুঞ্জ।

কিন্তু বিংশ শতকের শেষ দিকে এসে এখন সার্বিয়ার মাথায় আবার কোন যুদ্ধের দামামা লেগেছে? মিলোসেভিচ আসলে কী চায়? আমরা এই পাহাড়ি জঙ্গলে কতদিন এভাবে বাঁচতে পারব? জোয়ার্নিকে এতদিন আমরা মুসলিম আর সার্ব অর্থোডক্স পাশাপাশি একসঙ্গে বসবাস করলাম। হঠাৎ সেখানে কারা ধর্মের নামে এভাবে যুদ্ধ চাপিয়ে দিল? আমার মার্সিয়া কোথায় আছে, কিভাবে আছে, বেঁচে আছে না মরে গেছে, কিচ্ছু জানি না।

আমার আদরের মায়া কোথায় আছে, কিভাবে আছে, জানি না। আমার অতি আদরের ছোট্ট আহমেদ? আহমেদ কোথায় কিভাবে আছে, কিচ্ছু জানি না। ছোট জামাই হাকিয়া কোথায় আছে কিচ্ছু জানি না। এই বুড়ো সোলায়মান এভাবে আর কতদিন বাঁচবে তাও জানি না। কবে কখন জোয়ার্নিকে ফিরতে পারব তাও জানি না। শুধু জানি আমার ডেভিডকে বাঁচাতে হলে, আমার রাফিয়াকে বাঁচাতে হলে, আমার হাইরিয়াকে বাঁচাতে হলে, নিজের জীবন বাঁচাতে হলে এই পাহাড়ি জঙ্গলে পালিয়ে থাকা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নাই।

কিন্তু খাবার ছাড়া, পানি ছাড়া এভাবে আমরা আর কতদিন বাঁচতে পারব, তাও জানি না। মিলোসেভিচ আসলে কী চায় তাও জানি না।

বসনা- ১ এর URL:  www.sylhettoday24.com/news/details/Literature/5873
বসনা- ২ এর URL:  www.sylhettoday24.com/news/details/Literature/6277
বসনা- ৩ এর URL:  www.sylhettoday24.com/news/details/Literature/6808
বসনা- ৪ এর URL:  www.sylhettoday24.com/news/details/Literature/7473
বসনা- ৫ এর URL:  www.sylhettoday24.com/news/details/Literature/7741

আপনার মন্তব্য