প্রকাশিত: ২০১৯-১১-১০ ১৮:২৫:৫১
অনিমেষ বিজয় চৌধুরী:
গৌড়ের অধিপতি নৃপতি লক্ষণ সেনের মন্ত্রী ছিলেন নারায়ণ দত্ত। নারায়ণ দত্তের পুত্র প্রসিদ্ধ বৈদ্যশাস্ত্রপ্রণেতা চক্রপাণি দত্ত শুধুমাত্র বাংলার নয়, সমগ্র ভারতবর্ষের গৌরব। তাঁর অমর কীর্তি ‘চক্রদত্ত’ গ্রন্থ প্রণয়ন চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা। হযরত শাহজালালের শ্রীহট্ট বিজয়ের প্রায় শতবর্ষ আগে আনুমানিক ১২৮৪ খ্রিস্টাব্দে চক্রপাণি দত্ত শ্রীহট্টে পদার্পণ করেন। সে সময় নৃপতি গৌরগোবিন্দের (১৩৮৪ খ্রিস্টাব্দে হযরত শাহজালালের কাছে পরাজিত রাজা গোবিন্দ নয়) কঠিন ব্যাধি উপশম করতে চক্রপাণি তিনপুত্রের সাথে শ্রীহট্ট আসেন।
রাজা গৌরগোবিন্দের কঠিন অসুখ হলে রাণীমা দক্ষিণ রাঢ়ের সপ্তগ্রাম নিবাসী বৈদ্যকুল শিরোমণি চক্রপাণি দত্তকে বিশেষ দূত মারফত খবর দেন যাতে তিনি রাজার চিকিৎসার ভার গ্রহণ করেন। কিন্তু চক্রপাণি সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করলে রাণীমা পুনরায় একটা বাক্সে তার অঙ্গের সমস্ত অলংকার ভরে দিয়ে সেই বাক্স দূত মারফত পাঠালেন এই বলে যে, বৈদ্যমহাশয় যদি কৃপা করে আসেন তবেই তিনি এই অলংকার পুনরায় নিজ অঙ্গে ধারণ করবেন। রাণী মার বিশ্বাস চক্রপাণি রাজার চিকিৎসার ভার নিলেই তিনি নবজীবন ফিরে পাবেন। আর যদি চিকিৎসা না পেয়ে রাজার মৃত্যু হয় তবে রাণী সতী হবেন। অর্থাৎ রাজার সাথে সহমরণে যাবেন। অগত্যা চক্রপাণি শ্রীহট্টে এসে রাজার চিকিৎসার ভার নিলেন এবং কিছুদিনের মধ্যেই গৌরগোবিন্দ সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করলেন।
মহাত্মা চক্রপাণি দত্ত জলৌকা প্রয়োগ দ্বারা বহুবিধ রোগের চিকিৎসা করতেন। এই বিশেষ ধরণের চিকিৎসায় মহারাজ সম্পূর্ণরূপে আরোগ্য লাভ করনে । রোগমুক্তির পর রাজা বৈদ্যরাজের প্রতি কৃতজ্ঞতায় তাঁকে নানাভাবে পুরস্কৃত করেন। রাজার মনের একান্ত বাসনা বৈদ্যরাজকে যেকোনো মূল্যে নিজ রাজ্যে প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু চক্রপাণি গঙ্গা ছেড়ে কচ্ছদেশে থাকতে চাইলেন না কিছুতেই। এদিকে একটি বছর সম্পূর্ণ হতে চলেছে। আর নয়; এবার ফেরার সময় এসেছে। তবে রাজার অনুরোধ একেবারে ফেলতে পারলেন না চক্রপাণি। জ্যেষ্ঠপুত্র উমাপতিকে সঙ্গে নিয়ে দেশে ফিরলেন। আর দুই পুত্রকে শ্রীহট্টে বাস করার অনুমতি দিলেন। পরবর্তীকালে গৌরগোবিন্দের একান্ত ইচ্ছায় মধ্যম পুত্র মহীপতি দক্ষিণসুরে এবং কনিষ্ঠ পুত্র মুকল গয়ারেতে প্রতিষ্ঠিত হন।
এই দত্ত বংশের এক শাখা সুনামগঞ্জের অন্তর্গত আতুয়াজান পরগণার কেশবপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হন। এই শাখায় রাধাগোবিন্দ দত্ত নামে এক কৃতী ব্যক্তি কুলপঞ্জিকা রচনা করেন। তিনি লিখেছেন যে, দক্ষিণ রাঢ়ের সপ্তগ্রামের গৌতম গোত্র প্রভব দত্তবংশী বিখ্যাত বৈদ্যরাজ চক্রপাণি দত্ত নৃপতি গৌরগোবিন্দের ব্যাধি দূর করেন। তার পুরস্কার স্বরূপ গৌরগোবিন্দ চক্রপাণি দত্তের মধ্যম পুত্র মহীপতি দত্তকে হাইল হাওর (হাসীল) পরে সপ্তগ্রামে স্থাপিত করেন। এই সাতগাঁও পরগণার চক্রদত্ত বংশীয় প্রভাকর দত্তকে প্রধানমন্ত্রীর পদ দিয়ে আতুয়াজানের রাজা বিজয় সিংহের প্রপিতামহ দুর্ব্বার খাঁ কেশবপুর গ্রামে স্থাপিত করেন। প্রভাকর দত্তের বংশেই রাধামাধব নামে এক সুকবি জন্মগ্রহণ করেন।
রাধামাধব নানা শাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন। ‘শ্রী শ্রী মনসাপুরাণ’ ‘জয়দেব’ প্রভৃতি পাঁচালী তাঁর অমর কীর্তি। হাতে লেখা জয়দেব-এর গীতগোবিন্দের বাংলা পদ্যানুবাদ এখনও বর্তমান আছে। শ্রাবণ মাসে রাধামাধব লিখিত মনসাপুরাণ জগন্নাথপুররে ঘরে ঘরে এখনও গীত হয়। এছাড়াও তার রচিত ‘ভ্রমরগীতা’, ‘ভারতসাবিত্রী’, ‘গোবিন্দ ভোগের গান’, ‘ পদাবলী গান’, ‘ সখীসংবাদ গান’, ‘ ঝুলন গান’, ‘ রাস গান’ ও নানা বিষয়ক ‘ মেয়েলি গান’ উল্লেখযোগ্য।
তৎকালীন সুনামগঞ্জ মহকুমার জগন্নাথপুর থানার অধীন আতুয়াজান পরগনার কেশবপুর গ্রামে রাধামাধব ও সুবর্ণাদেবীর ঘরে ১২৪১ বঙ্গাব্দে (১৮৩৪ ইং) আবির্ভূত হন সাধক কবি রাধারমণ দত্ত। রাধারমণের দুই অগ্রজের নাম রাধানাথ ও রাধামোহন। কনিষ্ঠ পুত্র রাধারমণের বয়স যখন মাত্র ১০ বছর তখন পিতা রাধামাধব দেহত্যাগ করেন। স্নেহশীলা এবং পরমভক্তিমতী মাতা সুবর্ণাদেবী পুত্রদের শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থায় ত্রুটি করেননি। তাছাড়া পারিবারিক ঐতিহ্যের আনুকূল্যে এবং বিত্তশালী সম্ভ্রান্ত বংশে জন্ম নেয়ার সুবাদে রাধারমণ শৈশব থেকেই নানাবিধ শাস্ত্র অধ্যয়ন, কাব্য ও সংগীত চর্চা ইত্যাদি যথাযথভাবেই লাভ করেছিলেন। রাধারমণের শান্ত স্বভাব ও মধুর ব্যবহার সকলকেই আকর্ষণ করত। স্বভাব কবি ছিলেন তিনি। পিতার কবি প্রতিভা তাঁর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল এবং বয়ঃবৃদ্ধির সাথে সাথে তা শতধারায় বিকশিত হয়।
১২৭৫ বঙ্গাব্দে চৌত্রিশ বছর বয়সে মৌলভীবাজারের নিকটবর্তী আদপাশা গ্রামে শ্রীচৈতন্যের অন্যতম পার্ষদ সেন শিবানন্দের বংশীয় নন্দকুমার সেন অধিকারীর কন্যা গুণময়ী দেবীর সাথে রাধারমণ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। রাধারমণ ও গুণময়ী দেবীর ঘর আলো করে আসেন চার পুত্র রাসবিহারী, নদীয়াবিহারী, বিপিনবিহারী ও রসিকবিহারী। স্ত্রী গুণময়ী দেবীকে রাধারমণ শুধু সহধর্মিণীরূপে নয়, দেবীজ্ঞানে ভক্তি করতেন। “প্রিয়েরে দেবতা করি/ দেবতারে প্রিয়ে”- এই দার্শনিক তত্ত্বটি যেন বৈষ্ণব কবির অন্তরে বদ্ধমূল ছিল। সংসার জীবনের ভোগবাদ বিত্তশালী পরিবারের আদরের দুলাল রাধারমণের চিত্তকে আকর্ষণ করতে পারেনি বলেই মর্ত্যের প্রেমকে ঈশ্বর প্রেমের দিকে ধাবিত করতে পেরেছিলেন অবলীলায়। তবুও বৈষ্ণব কবি এই মাটির পৃথিবীর মানুষ, সংসার জলধির দুঃখ-সুখের আবর্তন তাকেও উদ্বেলিত করেছে। সেই সময় কলেরা বঙ্গদেশে মাঝে মধ্যেই মহামারী আকার ধারণ করত। ভয়াল এই রোগ রাধারমণের তিন পুত্রকে কেড়ে নিল একে একে। কিছুদিনের মধ্যে প্রিয়তমা স্ত্রী গুণময়ী দেবীও দেহত্যাগ করলেন। একমাত্র জীবিত শিশুপুত্র বিপিনবিহারীকে নিয়ে রাধারমণ তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করলেন। মৃত্যুশোক তাঁকে নতুন জ্ঞান, নতুন দৃষ্টি দিল। বৈরাগ্য তাঁর স্বভাবেই ছিল। এবার মায়ার বেড়ীও শিথিল হয়ে এলো। কিছুকাল পর পুত্র বিপিনবিহারীকে মাতুলালয়ে স্থায়ীভাবে রেখে এলেন।
বৈষ্ণব কবির গুরু বরণের সময় উপস্থিত হলে পঞ্চাশ বছর বয়সে মৌলভীবাজারের অন্তর্গত ঢেউপাশা গ্রামের সাধক রঘুনাথ গোস্বামীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে রাধারমণ কঠোর সাধনায় নিমগ্ন হলেন। সংগীতের ফল্গুধারা এবার উদ্দাম গতি পেয়ে নতুনরূপে প্রবাহিত হতে লাগল। সাধন জীবনের উপলব্ধিগুলোকে বৈষ্ণব কবি তাঁর অমিয় বাণী ও জাদুকরী সুররে রসায়নে জারিত করে নবনব সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রকাশ করতে লাগলেন অপূর্ব রসভঙ্গিমায়। নিজের রচনাকে সংরক্ষণ করে রাখার মন তাঁর ছিলনা। গান আসত বন্যার বেগের মতো। সে তুলনায় লেখনীর বেগ যে অতি মন্থর। রাধারমণরে চরিত্রের আকর্ষণ আর অপার্থিব আনন্দের রসাস্বাদন নিমিত্ত ভক্তবৃন্দ সমবেত হতে শুরু করলেন কবির কুটির প্রাঙ্গণে।
গ্রামীণ জনপদের নানা জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-সম্প্রদায়ের মানুষ ছুটে আসতেন কবির কাছে। ভিনদেশের মানুষ ও আসতেন। সেই যুগে জাত পাতের বেড়া অতিক্রম করে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখবার মন সকলের ছিলনা। তাই একান্নবর্তী পরিবারে থেকে কবিকে কিছুটা অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল। শেষে বাড়ির পাশে নলুয়ার হাওরে তিনি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে স্থায়ীভাবে ওখানেই থাকতেন। রাতভর সংকীর্তনে সকলের অংশগ্রহণেও আর কোন বাধা আসত না। ক্রমে কবির গান ও নানা অলৌকিক কাহিনী লোকমুখে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। ভাবের আবেশে ভক্তগণ যেন রাধারমণের মধ্যে গৌরাঙ্গ প্রভুকেই প্রত্যক্ষ করতে লাগলেন।
রাধারমণের দেহকান্তি ছিল দেবতুল্য। শরীরের আকৃতি মাঝারি ধরণের ও গায়ের রং ছিল দুধে আলতা। ধুতি আর সাদা ফতুয়া পরতেন। নলুয়ার হাওরে ওই আশ্রমেই তিনি সিদ্ধি লাভ করেন সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মের সাধনায়। বৈষ্ণব সাহিত্যে শান্ত, সখ্য, দাস্য, বাৎসল্য, মধুর প্রভৃতি নানা রসের পদ আমরা দেখি কিন্তু রাধারমণের পদগুলি মূলত উজ্জ্বল মধুর রসের খনি। বৈষ্ণব কবির অন্তরঙ্গ শিষ্যদের মধ্যে অধর সূত্রধর ছিলেন বায়েন। ধ্যানমগ্ন রাধারমণ যখন কীর্তন আরম্ভ করতেন তখন অধর শ্রীখোল ধরতেন। অনেকের মতো তিনিও সাধক কবিকে ‘ঠাকুর’ বলে সম্বোধন করতেন। আসতেন পরমানন্দ সাহা, হরমণি মালাকার, ব্রহ্মানন্দ সাহা, পুত্র বিপিনবিহারী। আরও কত নাম না জানা ভক্ত। বিভোর হয়ে গাইতেন বলে লেখার অবকাশ পেতেন না। ভক্তগণ শুনে শুনেই সেই সহজ সুরের মন প্রাণ আকুল করা গান স্মৃতিতে ধরে রাখতেন ও পরে খাতায় লিখে নিতেন।
আদর্শ সাধক ও আদর্শ গৃহী ছিলেন রাধারমণ। বিপিনবিহারীর প্রতি তাঁর কর্তব্যে তিনি অবহেলা করেননি। মৌলভীবাজারের নিকটবর্তী ভুজবলের কর বংশের কুঞ্জকুমারী দেবীর সাথে বিপিনবিহারী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে পুত্রের শ্বশুরালয়ে তিনি একাধিকবার গমন করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পিতা-পুত্রের যোগাযোগ অটুট ছিল। পৈতৃক সূত্রে বিপিন প্রচুর ভূ-সম্পত্তির অধিকারী হন পরবর্তীকালে।
বৈষ্ণব কবির সংগীতের অন্যতম অঙ্গ ছিল নৃত্য। বাঙালির নিজস্ব কোনো নৃত্যশৈলী হয়ত ক্লাসিক্যাল মর্যাদা পায়নি। তথাপি রাধারমণ দত্তের অনন্য অবদান ধামাইল নৃত্য এই উপমহাদেশের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। ধামাইল আজ বিশ্বের অনেক দেশেই সমাদৃত। বঙ্গদেশে বৈষ্ণব পদের পাশাপাশি শাক্ত পদাবলীও রচিত হয়েছে অনেক কীর্তিমান সাধক কবিদের লেখনীতে। রাধারমণ বৈষ্ণব কবি হলেও কোন সংকীর্ণতা তার কবি প্রতিভাকে আচ্ছন্ন করতে পারেনি। তিনি কিছু সংখ্যক শাক্তপদ রচনা করেন। কিছু গান রচনা করেন মহাদেব বা ত্রিনাথ বন্দনা বিষয়ক যা একশ্রেণির শৈব সাধকের আদরণীয় হয়ে আছে আজও। ১৩২২ বঙ্গাব্দের ২৬ শে কার্তিক (১৯১৫ ইং) শুক্রবার শুক্লা ষষ্ঠী তিথিতে ৮১ বছর বয়সে এই কবি সাধকের দেহান্ত হয়। আজও কেশবপুরে কবির সমাধি মন্দিরে নিত্য সন্ধ্যারতি হয়। গীত হয় তাঁর রচিত গান।
ধ্যানমগ্ন অবস্থায় তিনি মুখেমুখে গান রচনা করতেন। যার মর্মস্পর্শী সুর, উচ্চাঙ্গরে বাণী, ছন্দরে বৈচিত্র্য, অলংকার প্রয়োগ সবখানেই ছিল অসাধারণ নৈপুণ্য। যার ফলে তিরোধানের শতবর্ষ পরেও তাঁর গানের অপূর্ব নির্মাণশৈলী, সহজ সুরের চলন আর ধামাইল নৃত্যগীত আমাদের মোহি করে রেখেছে আপন মহিমায়।
আপনার মন্তব্য