কবি জফির সেতু: স্বপ্ন ও সংগ্রামের সঙ্গে সন্ধি যার

 প্রকাশিত: ২০১৯-১২-২১ ১৭:০৭:৪৯

আলমগীর শাহরিয়ার:

বহুবিশ্রুত ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা’ গানের কথার মতো বাঙালি জেনে গেছে কবি মানে অমল। যার কবি কবি চেহারা। কাঁধেতে ঝোলানো ব্যাগ। পরনে মলিন পাঞ্জাবি। পায়ে সুকতলা ক্ষয়ে যাওয়া স্যান্ডেল। মুখভরা অযত্নে গজানো দাড়ি তাঁর। চোখে রাতজাগা ক্লান্তির ছাপ। সাহিত্যের ঠিকাদারি নেয়া পত্রিকার সম্পাদকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরঘুর করা। কিন্তু একটা কবিতা তার কোথাও ছাপা হয় না। দীর্ঘশ্বাস আর হা হুতাশ বাড়ে। নগরের নষ্ট জীবনে কখনো পায় না সে প্রতিভার দামটা। না খেয়ে খেয়ে কোনো একদিন দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে হুট করে মরে যায় অমল। মুছে যায় তাঁর প্রতিভাদীপ্ত নামটা।

চর্যাপদ থেকে ময়মনসিংহ গীতিকা, প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক যুগ বাংলা ভাষার বাউল আর কবির চিরচেনা রূপ অস্বীকার করে যিনি প্রথম সামাজিক বিদ্রোহ করেছিলেন তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। পশ্চিমা আধুনিকতায় প্রভাবিত হয়ে দস্তুর ইংরেজ সাহেবদের মতো চৌকস পরিপাটি রূপ নিয়ে যশোরের সাগরদাঁড়ির জমিদার নন্দন কবিতা লিখতে শুরু করলেন। ব্যারিস্টার হবার বাসনায় পাড়ি জমালেন বিলেতে, প্যারিসে। কিন্তু আত্মার ক্রন্দন ছিল আইন পেশা নয় কবিতা। বেহিসেবি জীবনে কঠিন অভাব অনটনে পড়েছেন। কিন্তু আমৃত্যু নিজেকে সাহিত্য সাধনায় নিয়োজিত রেখেছেন, তাঁর কালের একজন আধুনিক অগ্রসর মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন চিন্তায়, ভাবনায়, চাল চলনে। তাই তিনি বাঙলার আধুনিক কবিদের পথিকৃৎ। দুই বাংলার রাজধানী কলকাতা আর ঢাকায় অমল চরিত্রের অনেক কবিদের এখনো দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু ষাটের দশকে কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আশির দশকে হুমায়ূন আজাদ, রণাঙ্গনের কবি রফিক আজাদ, তসলিমা নাসরিনরা ভেঙ্গে দিলেন কবিদের কথা ভাবলেই চোখে ভেসে ওঠা অমলেন্দু কবিদের চেনাবৃত্ত। ঝকঝকে, স্মার্ট, সুদর্শন এই কবিরা নতুন প্রজন্মের কবিদের পথ দেখালেন। ভেঙে দিলেন ভাবনার ঝরাগ্রস্ত পুরনো বৃত্ত।

দশকওয়ারি হিসাবে (বলে রাখি, দশকওয়ারি এই হিসাব কেন জানি আমার ভালো লাগে না। প্রকৃত কবি চিরকালের। তাকে সময়ের ফ্রেমে ফেলে ভাগ করা যায় না) নব্বই দশকের কবি জফির সেতু তাদের নান্দনিক কাব্যভাবনা ও আধুনিকতার সুযোগ্য উত্তরসূরি বললে মোটেই অত্যুক্তি হবে না। কবিতায় নিজস্ব ভাষাভঙ্গি, স্বর দাঁড় করাতে না পারলে কোনো কবি তাঁর চেনা সময়কে অতিক্রম করতে পারেন না। জফির সেতু কবিতায় তাঁর স্বতন্ত্র ভাষাভঙ্গি প্রতিষ্ঠায় সফল। প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজস্ব স্বর।

তখন আমরা সিলেট সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ি। পাশের ক্যাম্পাস মুরারি চাঁদ(এমসি) কলেজের সবুজ চত্বরে বন্ধু সেলিম একদিন পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিল ইনি কবি জফির সেতু। দেখলাম একজন সুদর্শন, তারুণ্যে টগবগ করা যৌবনের মধ্যগগনে থাকা এক তরুণ সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। হাত বাড়িয়ে দিলেন। কিঞ্চিৎ লেখালেখি ও পড়াশোনায় আগ্রহী জেনে এমসির কলেজের ঐতিহাসিক বাংলা বিভাগে আসাম অঞ্চলের বাংলো প্যাটার্নের টিনশেড ভবনের রুমে নিয়ে গেলেন আমাদের। কথা বললেন দীর্ঘক্ষণ। তাঁর পর কেটে গেছে এক যুগেরও বেশি সময়। কত শত স্মৃতি জমেছে জীবন স্মৃতির সিন্ধুকে।

তিনি এমসি কলেজ ছেড়ে চলে গেলেন। যোগ দিলেন শাবিতে বাংলা বিভাগে। সে সময় কিছু প্রতিক্রিয়াশীল লোকজন সিলেটে আন্দোলন গড়ে তুলেন তাঁর বিরুদ্ধে। শুনতে পাই সে আন্দোলনে ইন্ধন দেন কিছু শঙ্কিত প্রগতিশীলরাও। কিন্তু জফির সেতুই জিতেন। আসলে জফির সেতু জেতেন না, জয় হয় ওই জ্ঞানোন্মুখ চেতনায় প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটির। জ্ঞানচর্চার আকালের দিনে শাবি একদিন যে কয়জন শিক্ষককে নিয়ে গর্ব করবে নিঃসন্দেহে জফির সেতু সেখানে উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন। তাঁর জীবন ও কর্মসাধনা অন্তত তাই বলে। রক্তস্নাত একাত্তরের মহান বিজয়ের মাসে জন্মেছেন এ কবি। সংগ্রামের সঙ্গে আজন্ম সন্ধি তাঁর। স্বাধীনতা তাঁর অস্তিত্ব প্রকাশের সমান জন্মবিহ্বলক্রন্দন। জারুল-হিজল-করচের মতো বিরুদ্ধ সময়ের সংগ্রামী বৃক্ষ তাই সহজে পরাস্ত হন না। নিজ হাতে নিয়ত বুনে চলেন দক্ষ তাঁতীর মত জীবন। শৈশবে বেড়ে ওঠা খাল বিল আর হাওরের কাদা-মাটির গন্ধ, অবারিত প্রকৃতি আর নিসর্গের শিয়রে মায়ের মমতাময়ী কোলে তিনি এখনো জেগে থাকেন শিশুর মতো সংবেদনশীল এক হৃদয় নিয়ে। দেশ মাটি ও মানুষের প্রতি বৌদ্ধিক অঙ্গীকার তিনি কখনোই বিস্মৃত হননি বলেই ইতিহাসের নতুন পৃষ্ঠায় লিখে যান কীর্তিমান, আলো ও আশাজাগানিয়া পূর্বপুরুষ আর তাদের স্বপ্ন ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামী সময়ের কথা। নিজেও হাঁটেন সে পথ ধরে। শিক্ষকের অবিচল নিষ্ঠা ও সততায় আলোকিত করেছেন অজস্র শিক্ষার্থীর অন্ধকারাচ্ছন্ন অন্তর। নিঃসন্দেহে তিনি আমাদের কালের অগ্রসর একজন মানুষ।

‘সিলেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস’, ‘স্ত্রী শিক্ষার উন্মেষ পর্ব ও সিলেট মহিলা কলেজ’, সিলেটে রবীন্দ্রনাথের আগমনের শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে প্রকাশিত ‘শ্রীভূমির রবীন্দ্রনাথ’ সাম্প্রতিক গবেষক জফির সেতুর গুরুত্বপূর্ণ কাজ। একজন সফল শিক্ষক এবং গবেষক পরিচয়ের বাইরে সতত জাগ্রত থাকে চিরকালের সৃষ্টিশীল কবিতাচ্ছন্ন এক হৃদয় তাঁর। এজন্য আরাধ্য কাব্যতীর্থে স্বচ্ছন্দ বিচরণ। এযাবৎ জফির সেতুর ১৫টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বহুবর্ণ রক্তবীজ (২০০৪), সহস্র ভোল্টের বাঘ (২০০৬), স্যানাটোরিয়াম (২০০৮), তাঁবুর নিচে দূতাবাস (২০১১), সিন্ধু দ্রাবিড়ের ঘোটকী (২০১২), জাতক ও দণ্ডকারণ্য (২০১৩), সুতো দিয়ে বানানো সূর্যেরা (২০১৪), Turtle Has No Wings (2014), ময়ূর উজানে ভাসো (২০১৪), ডুমুরের গোপন ইশারা (২০১৪), প্রস্তরলিখিত (২০১৫) ইয়েস, ইউ ব্লাডি বাস্টার্ডস (২০১৫), এখন মৃগয়া (২০১৬), আবারও শবর (২০১৬) ইত্যাদি। ২০২০ সালের বইমেলায় বের নাগরী থেকে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর সবশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘তিন ভাগ রক্ত’। শিক্ষকতা ও গবেষণার বাইরে স্ত্রী শাহেদা শিমুলকে নিয়ে কবি জফির সেতুর আনন্দভুবন। এছাড়া, তিনি সম্পাদনা করেন ছোটকাগজ ‘সুরমস’। নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, ভাষা ও সাহিত্য তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র। নিষ্ফলা সময়ে তিনি যেন স্বপ্নবান কৃষকের মতো নিরন্তর ফসল বুনে চলেন এই ঊষরভূমিতে।

আজ জন্মদিনে তাকে শ্রদ্ধা ও নিঃশর্ত ভালোবাসার কথা জানাই।

আপনার মন্তব্য