কেন পড়ব মাহবুব মোর্শেদের কবিতা?

 প্রকাশিত: ২০২০-০২-১০ ২১:৪১:০১

এহসান মাহমুদ:

বাংলা কবিতার ঐতিহ্যগত দিক বিচার করলে দেখা যায় যে, ধর্মতত্ত্বকে আশ্রয় করে তা এগিয়ে এসেছে। বিভিন্ন ধর্মের মূলধারার গ্রন্থ আশ্রিত কাব্য রচনার প্রয়াসও দেখতে পাওয়া যায়। সেই ধারা থেকে এখনকার বাংলা কবিতা কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, সেটা জানার জন্য মাহবুব মোর্শেদের কবিতার বই ‘অরব বসন্ত’ পড়া শুরু করেছি।

মাহবুব মোর্শেদের কবিতার বই ‘অরব বসন্ত’। জি আপনি ঠিকই পড়ছেন ‘আরব’ নয়। ‘অরব’ বসন্ত।

বিশ্বজুড়ে গত কয়েক বছরে যে শব্দটি বিশ্বরাজনীতিতে অজস্র বার উচ্চারিত হয়েছে, সেটি হল- আরব বসন্ত। ২০১০ এর শুরু থেকে আরব বিশ্বে যে গণবিক্ষোভ দেখা দিয়েছে সেটিই মিডিয়ার কল্যাণে ‘আরব বসন্ত’ নামে প্রচার পায়। মিশর থেকে শুরু হয়ে লিবিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া হয়ে বিভিন্ন দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে।

স্বেচ্ছাচার, কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র, সরকারি দুর্নীতি, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতার সরকার, সাম্প্রদায়িকতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন-এসবই আরব বসন্তকে অনিবার্য করে। পাশাপাশি অনলাইন সক্রিয়তা, বিপ্লব, আত্মবলিদান- এটিকে লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যায়।

সেখানে যখন মাহবুব মোর্শেদের কবিতার বইয়ের নাম ‘অরব বসন্ত’ দেখতে পাই, তখন বিষয়টি আগ্রহী উদ্দীপক হয়ে ওঠে। ‘অরব বসন্ত’ এর যদি বিশ্লেষণ করি তো, দেখতে পাই ‘অরব’ এর সহজ অর্থ দাঁড়ায়- চুপচাপ, নিশ্চল, নিঃসাড়। সেই সঙ্গে বসন্ত!

এইবারে আমরা বাংলা কবিতায় এই ‘অরব’ শব্দটির আরেকটি ব্যবহারের কথা উল্লেখ করতে পারি। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় শব্দটি এসেছে এইভাবে-‘আঁধার অরব রাতে অগণন জ্যোতিষ্কশিখায়/ মহাবিশ্ব একদিন তমিস্রার মতো হয়ে গেলে/ মুখে যা বলোনি, নারি, মনে যা ভেবেছো তার প্রতি/ লক্ষ্য রেখে অন্ধকার শক্তি অগ্নি সুবর্ণের মতো/ দেহ হবে মন হবে- তুমি হবে সে-সবের জ্যোতি।‘

এসব গেল কবিতার বইয়ের নামকরণ নিয়ে আলোচনা। এই নামকরণ থেকেই মাহবুব মোর্শেদের কবিতার অভিমুখ কিছুটা আন্দাজ করা যায়।

প্রকৃতি, নরনারীর প্রেম, রাজনীতি, যৌনতা- এসবই মাহবুব মোর্শেদের কবিতার বিষয় আশয়। এসবের বাইরে আর থাকে কী! যা থাকে সেটা নাঙ্গা দরবেশের জীবন। যখন পাঠ করি ‘তাই আয়নার কারিগরের সামনে জানু পেতে বসে আছি করজোড়ে’ তখন এক ভিন্ন জগতের হাতছানি পাওয়া যায়। মাহবুব মোর্শেদের কবিতায় এই অভিজ্ঞতাও হয়ে যাবে কবিতার মনোযোগী পাঠকের।

মাহবুবের কবিতায় শরীর এসেছে অনিবার্য হয়ে। এটি নিয়ে কোনো আড়ষ্ট বা লুকোচুরি নেই। তাই সহজেই বলা যায় ‘চুমোই হলো শরীরের আশ্চর্য দরজা’। আবার ‘কুকুর’ শিরোনামের কবিতায়- ‘সহসা এক বেওয়ারিশ কুকুর ডেকে ওঠে/ এ ভরা ভাদ্র মাসে’ উচ্চারিত হলে এর ইঙ্গিতটাও আমাদের অপরিচিত মনে হয় না। পাশাপাশি ‘ফটোগ্রাফার’ কবিতায় প্রেমের উচ্চারণ চিরন্তন প্রেমেরই সাক্ষ্য দেয়।

মাহবুবের কবিতার ভাষা ইঙ্গিতময় ও সরল গীতলতাপূর্ণ। সহজে পড়া যায় তাঁর কাব্য যাত্রা। কবিতায় একধরনের অন্তিমে চমক জাগানিয়া বিষয়ের উপস্থিতি থাকলেও তা বাহুল্য বলে মনে হয় না।

কবিতার বইয়ের শিরোনাম যতোই রোমান্টিক মনে হয় ততোটা রোমান্টিকতা আসলে নেই। ‘পার্টি ও প্রেম’ এবং ‘ও শ্রাবণ’ শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক কবিতা। যখন দেখি ‘রাষ্ট্রযন্ত্র ভালো চলে ট্রাফিকবিহীন’ তখন এই ধারণা শক্ত হয়।

আলোচ্য বইয়ের কবিতা পাঠ করতে করতেই মনে হয় মাহবুব মোর্শেদ নাগরিক কবিও কি নন? যখন উচ্চারণ করি ‘ফোন বাঁচিয়ে ঠিকঠাক ভিজতে পারলে তো? এই বর্ষায়?’ নাগরিক জীবনের সঙ্গে বর্ষা ও সেলফোনের এই উপস্থিতি মাহবুবের কবিতা বিষয়ে মন্তব্য করতে নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করবে।

এ ছাড়া ‘বাবু খেয়েছ?’ কবিতায় সমসাময়িক শব্দ ও টার্মকে কবিতায় যথাযথ প্রয়োগ হয়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। ‘অরব বসন্ত’ কবিতার বইয়ে একধরনের দীর্ঘ কবিতা রচনার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়। ‘রিকা পর্ব’ কবিতাটি তার উদাহরণ।

মাহবুব মোর্শেদের কবিতায় ঐতিহ্য ও বর্তমানের পাশাপাশি ভবিষ্যৎ বিষয়েও সাবধান বাণী উচ্চারিত হতে দেখি। ‘বিজয়ী বীরের প্রতি’ কবিতায় যেমন বলেছেন- ‘অর্জুন, আমার লাশের থেকে সরাও / এ বিজয় পতাকা। কেননা তোমারই মতো/ ওই পতাকাও একদিন ধূলিলিপ্ত হবে...’।

‘গেরিলা’ নামের কবিতায় দেখা হয় এক স্বাপ্নিক নাগরিকের সঙ্গে। এইভাবে এই বইয়ে মলাটবদ্ধ কবিতাগুলো পাঠ করতে করতে বহু চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় হয় আমাদের। ঘোরা হয়ে যায় এক গোপন স্বভাবী কবির গোপন জগতের সঙ্গে।

এমন আরও উদাহরণ দেওয়া যায়। তবে শেষ পর্যন্ত মাহবুব মোর্শেদের কবিতার অভিমুখ পুরোপুরি জানার জন্য ‘অরব বসন্ত’ হাতে নিতে হবে।

বই : অরব বসন্ত
কবি: মাহবুব মোর্শেদ
প্রকাশক: বৈভব
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২০

আপনার মন্তব্য