স্যারের নাম কী?

ফেলে আসা দিন

 প্রকাশিত: ২০২০-০৫-১৭ ২১:২৯:১৭

 আপডেট: ২০২০-০৫-১৮ ১৪:৪৫:৫২

মো. শাফায়াত মাহবুব চৌধুরী:

১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরের সকাল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা উপেক্ষা করে লেপের ওম থেকে বের হতে হলো। প্রচণ্ড মানসিক চাপ নিয়ে সকাল ৯টার পূর্বে ডিপার্টমেন্টে হাজির হলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষার শেষ দিন। অর্থাৎ ভাইভা। সতীর্থরা অনেকেই হাজির হয়েছে। নিজেদের মতো করে শেষ মুহূর্তে বইপত্রে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে।

আগের সপ্তাহে একদিন পর পর তিনদিন প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা হয়েছে। এক্সটারনাল এক্সামিনার হিসেবে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক এসেছেন। একটা আইটেমে উনি মতামত দিলেন এটার হিসাব নতুনভাবে করতে হবে - আমরা যে নিয়মে শিখেছি সেভাবে নয়। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। কারণ ঐ আইটেমে ২০ নম্বর আছে। চেষ্টা করলাম ঐ আইটেম উনার নির্দেশনা মতো করতো। কিন্তু পরে জানলাম একজনের মাত্র সঠিক হয়েছে। আর কারো হয়নি। মার্ক সম্পূর্ণ কাটা যেতে পারে অথবা নিয়ম যতটুকু ঠিক হয়েছে ততটুকু নম্বর পাওয়া যেতে পারে। তবে তা নির্ভর করছে এক্সটারনাল এক্সামিনারের উপর। সেই অনিশ্চয়তা নিয়ে ভাইভায় হাজির হওয়া!

বিজ্ঞাপন

যথারীতি ভাইভা শুরু হলো। একজন পরীক্ষার্থী বের হওয়ার পর সবাই হামলে পড়েছে তার উপর কী প্রশ্ন করা হয়েছে জানতে। কিন্তু বিধি বাম! টের পেয়ে গেলেন শিক্ষকরা। অতএব অপেক্ষমাণদের এমন একটা রুমে স্থানান্তর করা হলো যেখান থেকে ভাইভা বোর্ড থেকে বের হওয়া কোন পরীক্ষার্থীর নাগাল পাওয়া যাবে না। কিন্তু এর মাঝেও কেমন করে জানি জানা গেল, ভাইভা বোর্ডে একটা কমন প্রশ্ন সবাইকে করা হচ্ছে। সেটা হচ্ছে এক্সটারনাল এক্সামিনারের নাম কী? উত্তর না পারার দরুন তিরস্কার করা হচ্ছে এই বলে যে যিনি বাইরে থেকে এসে আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছেন তাঁর নাম না জানাটা অনুচিত।

নামটা জানার জন্য সবাই দৌড় দিল প্রশাসনিক কর্মকর্তার রুমে। নামটা একটু লম্বা এবং কঠিনও বটে। সবাই লেখাপড়া বাদ দিয়ে সেই অধ্যাপকের নাম মুখস্থ করতে শুরু করলো। আমি দেখলাম আমার এক বন্ধু দূরে দাড়িয়ে খাতায় ক্রমাগত কী লিখে যাচ্ছে। কাছে গিয়ে জানতে চাইলে বললো -মাথা জ্যাম হয়ে আছে। কিছুই মনে রাখতে পারছি না। তাই এক্সটারনাল এক্সামিনারের নামটা খাতায় কয়েকবার লিখে নিচ্ছি যাতে ভুলে না যাই!

আমার পালা এলো। সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে প্রবেশ করলাম রুমে। দেখলাম সবাই বৃত্তাকার একটা টেবিলে বসে আছেন। একটা চেয়ার খালি আছে। সেটাতে পরীক্ষার্থী বসার ব্যবস্থা। বসতে বলা হলো। বসলাম। আমার মুখোমুখি চেয়ারম্যান স্যার ও এক্সটারনাল এক্সামিনার।

প্রথমেই আমার ডান পাশ থেকে একজন শিক্ষক প্রশ্ন করলেন– স্যারের নাম কী?
আহ, আমাকে পায় কে? প্রথমেই প্রশ্ন কমন পড়েছে। বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দিলাম– আবু আহমদ আব্দুল মুহসি।

আবার একই প্রশ্ন এবং একই উত্তর দিলাম। দেখলাম সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন। চেয়ারম্যান স্যার চোখ গোল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এক্সটারনাল এক্সামিনার মিটিমিটি হাসছেন। বুঝলাম কিছু একটা গড়বড় করে ফেলেছি। কিন্তু কী সেটা ধরতে পারছি না। ঘাম ছুটা শুরু হলো। চেয়ারম্যান স্যার প্রায় ধমকের সুরে বললেন – আরে এটাতো এক্সটারনাল এক্সামিনারের নাম। তোমার নাম কী সেটা বলো?

বিজ্ঞাপন

প্রশ্নকর্তা শিক্ষক বললেন– তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছ। আমিতো তোমাকে সম্মান করে স্যার অ্যাড্রেস করেছি। এক্সটারনাল এক্সামিনারের নাম জানতে চাইনি।

বুঝলাম ধরা খেয়ে গেছি। লাইফ শেষ!!! অনেক প্রশ্ন করা হলো। বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম উত্তর দিতে। শেষ হলো একসময় ভাইভা। বের হওয়ার পর বাইরে দাঁড়ানো বন্ধুরা জানতে চাইলো কেমন দিলাম ভাইভা? রাগ-দুঃখ চেপে রেখে দাঁত কেলিয়ে বললাম– ভাল হয়েছে।

প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় সঠিকভাবে উত্তর না দেওয়া, ভাইভা বোর্ডে সঠিকভাবে রেসপন্স না করা সব মিলিয়ে নিশ্চিত ধরে নিয়েছিলাম ফলাফল বিপর্যয় ঘটবে। কিন্তু একমাস পর যখন চূড়ান্ত ফলাফল বের হলো দেখা গেল ঐসব বিষয় আমার কাঙ্ক্ষিত ফলাফলে কোন নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। ফলে ঘটনাটি আমার জীবনে একটি মজার ঘটনা হিসেবেই রয়ে আছে। উল্লেখ্য এক্সটারনাল এক্সামিনার জনাব আবু আহমদ আব্দুল মুহসি আমাদের সাবেক অর্থমন্ত্রী জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন মহোদয়ের ভাই।

মো. শাফায়াত মাহবুব চৌধুরী: উপসচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

আপনার মন্তব্য