বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, ষষ্ঠ পর্ব : ১৯-২২

 প্রকাশিত: ২০১৬-১০-২৬ ০০:৫৭:০১

 আপডেট: ২০১৬-১০-২৬ ০১:৪৭:২১

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, ষষ্ঠ পর্ব (দ্য গ্র্যান্ড মার্চ) : ১৯ -২২
১৯
অবশেষে ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপিকা আমেরিকার অভিনেত্রীটির হাত যখন ছেড়ে দেন, কালো দাড়িওয়ালা জার্মান পপ সঙ্গীত শিল্পীটি তখন অভিনেত্রীটির নাম ধরে ডেকে তার কাছে আসতে আহবান জানান।

আমেরিকার সেই অভিনেত্রী কখনোই সেই শিল্পীর নাম শোনেননি বা তাকে তিনি চেনেনও না, কিন্তু অপমানিত হবার পর কারো সহমর্মিতা গ্রহণ করার ব্যাপারে তিনি খানিকটা বেশী সংবেদনশীল হয়ে উঠেছিলেন, এবং তার দিকেই তিনি দৌড়ে এগিয়ে যান।গায়ক তার হাতে ধরা সাদা পতাকা লাগানো লাঠিটি অন্য হাতে নিয়ে মুক্ত হাতটি ঘাড়ের উপর দিয়ে অভিনেত্রীকে জড়িয়ে ধরেন।

প্রায় সাথে সাথেই তাদের ঘিরে ফেলে নতুন ফটোগ্রাফার আর ক্যামেরাম্যানদের একটি দল। একজন সুপরিচিত আমেরিকান আলোকচিত্রী, যার কিনা বেশ কষ্ট হচ্ছিল, সাদা পতাকার সাথে তাদের দুজনের মুখ একটি ফ্রেমে বন্দী করতে, কারণ লাঠিটি ছিল বেশ লম্বা, কয়েক পা পিছিয়ে যান ধান ক্ষেতের মধ্যে, এবং ঘটনাচক্রে সেটি করতে গিয়ে তিনি একটি ল্যান্ডমাইনের উপর পা দিয়েছিলেন। একটি বিস্ফোরণ হয়, তার শরীর শতচ্ছিন্ন হয়ে চারিদিকে ছিটকে যায়, ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীদের উপর রক্তের বৃষ্টি ঝরিয়ে।

ভয়ঙ্করভাবেই আতঙ্কিত হয়েছিলেন গায়ক ও অভিনেত্রী, কিন্তু তারা নড়তে পারছিলেন না তার অবস্থান থেকে। তারা চোখ তুলে তাকান পতাকার দিকে। এটি এখন রক্তে রঞ্জিত। আবারো তারা শঙ্কা বোধ করেন।তারপর দুজনেই খুব ভয়ে ভয়ে উপরের দিকে তাকান ও হালকাভাবে হাসেন। একটি বিস্ময়কর গর্বে তারা পূর্ণ, যে গর্ব তারা কখনোই এর আগে অনুভব করেনি: যে পতাকা তারা বহন করছে তা পবিত্র হয়েছে রক্তের দ্বারা, আরো একবার তারা মার্চে শামিল হন।

২০
সীমানাটি তৈরি করেছে অপ্রশস্ত একটি নদী, কিন্তু প্রায় ছয় ফুট উঁচু একটি লম্বা দেয়াল, এর দুই তীর ঘিরে রেখেছে, আর দেয়ালের সুরক্ষার জন্য রাখা হয়েছে বালির বস্তা। বন্দুক সহ থাই সৈন্যরা এর তীর ধরেই বসে আছে, কিন্তু তারা দৃষ্টি সীমানার বাইরে। দেয়ালে শুধুমাত্র একটি জায়গা উন্মুক্ত, যেখানে একটি সেতু নদীর উপর দাড়িয়ে। ভিয়েতনামী সেনারা অপেক্ষা করছে অন্য পাশে, কিন্তু তারাও অদৃশ্য, তাদের অবস্থানও খুব নিখুঁতভাবে লুকানো। যদিও বিষয়টি স্পষ্ট, যে মুহূর্তে কেউ সেই সেতুর উপর পা রাখবে, অদৃশ্য সেই ভিয়েতনামী সেনারা গুলি চালাবে।

মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা দেয়াল অবধি যায় এবং সতর্ক হয়ে দাড়িয়ে থাকে পায়ের আঙ্গুলের উপর ভর করে। ফ্রাঞ্জ দুটি বালির বস্তার মধ্যকার ফাকা জায়গা দিয়ে তাকায়, চেষ্টা করে বুঝতে কি হচ্ছে ।কিছুই তার নজরে পড়ে না, তারপর তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সেখানে এসে দাড়ায় এক ফটোগ্রাফার, যে মনে করে সেই জায়গাটির উপর তার অধিকারই সবার চেয়ে বেশী।

ফ্রাঞ্জ পেছন দিকে তাকায়, সাত জন আলোকচিত্রী একটি গাছের মাথার চুড়ায় বসে আছেন, আকারে বেঢপ বড় এক পাল কাকের মত, তাদের চোখ নিবদ্ধ নদীর অপর প্রান্তে।

ঠিক তখনই মিছিলের মাথায় থাকা দোভাষী, একটি বড় মেগাফোন তার মুখের সামনে তোলেন, খেমার ভাষায় অপর দিকে বরাবর আহবান করে বলেন: ‘এই সব মানুষগুলো হচ্ছেন সারা বিশ্ব থেকে আসা চিকিৎসক, তারা কম্বোডিয়া ভূখণ্ডে প্রবেশ করার অনুমতি চাইছেন, এবং তারা শুধুমাত্র চিকিৎসা সাহায্য দিতে এসেছেন। কোনো রাজনৈতিক পরিকল্পনা তাদের নেই, শুধুমাত্র মানব কল্যাণের খাতিরে তারা এখানে জড়ো হয়েছেন’।

অন্য দিক থেকে তার এই আহবানের প্রত্যুত্তর ছিল একটি বিস্ময়কর নীরবতা। এই নীরবতা এত চূড়ান্ত যে প্রত্যেকেই নিরাশ হয়ে পড়েন। শুধু ক্যামেরাগুলো চলতে থাকে, ক্রান্তীয় কোনো অঞ্চলের পতঙ্গদের মত তারা সেই নীরবতাকে শব্দময় করে রাখে।

ফ্রাঞ্জ হঠাৎ করেই অনুভব করেছিল, গ্র্যান্ড মার্চ অবশেষে শেষ হতে যাচ্ছে। ইউরোপকে ঘিরে আছে নীরবতার সীমান্ত, এবং সে স্থানে এই গ্র্যান্ড মার্চ হচ্ছে এই গ্রহের মধ্যে খুব ক্ষুদ্র একটি মঞ্চ। যে জনগণরা আগে উৎসাহের সাথে মঞ্চের কাছাকাছি ভিড় করেছিল, তারা অনেক আগেই চলে গেছেন, এবং গ্র্যান্ড মার্চ চলছে নীরবে একাকী, কোনো দর্শক ছাড়াই। ‘হ্যাঁ’, ফ্রাঞ্জ স্বগতোক্তি করে, ‘ গ্র্যান্ড মার্চ চলতে থাকে, পৃথিবীর সব নির্বিকারতাকে উপেক্ষা করে’। কিন্তু এটি ক্রমশ উদ্বেগময় আর বিশৃঙ্খল হতে হতেও শুরু করেছে : গতকাল ভিয়েতনামে আমেরিকার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, আজ কম্বোডিয়ায় ভিয়েতনামের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, গতকাল ইসরায়েলের জন্য, আজ প্যালেস্টাইনের জন্য, গতকাল কিউবার জন্য, কাল কিউবার বিরুদ্ধে - আর সবসময়ই আমেরিকার বিরুদ্ধে । কখনো গণহত্যার বিরুদ্ধে, কখনো অন্য গণহত্যার সমর্থনে। ইউরোপ মার্চ করে যাচ্ছে, আর সব ঘটনার সাথে তাল রাখার জন্য কোনো কিছুই এটি পরিত্যাগ করতে পারছে না, এর গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে, যতক্ষণ এই মার্চ দৌড়ানো, লাফানো মানুষের মিছিলে পরিণত না হচ্ছে, মঞ্চ ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে সেই অবধি, যখন একদিন এটি শুধুমাত্র মাত্রাহীন কোনো বিন্দুতে পরিণত না হয়।

২১
আরো একবার দোভাষী মেগাফোনে তার চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করেন, এবং আবারো এর প্রত্যুত্তর হচ্ছে সীমাহীন, নিঃশেষ নির্বিকার নীরবতা।

ফ্রাঞ্জ চারিদিকে তাকায়, নদীর অন্য প্রান্তের নীরবতাকে তারা তাদের মুখে চপেটাঘাতের মত অনুভব করে। এমনকি সাদা পতাকা হাতে গায়ক আর আমেরিকার অভিনেত্রীও হতাশ, ইতস্ততবোধ করে সবাই, পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য।

অন্তর্দৃষ্টির এক ঝলকে ফ্রান্স দেখতে পায় তারা সবাই কতটা হাস্যকর, কিন্তু তাদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নেবার বদলে অথবা শ্লেষে নিজেকে পূর্ণ করার বদলে, এই ভাবনাটি একধরনের অসীম ভালোবাসাও তাকে অনুভব করায়, যা আমরা কোনো দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর প্রতি অনুভব করি। হ্যাঁ, গ্রাণ্ডমার্চ শেষ হতে যাচ্ছে, কিন্তু সেটি কোনো কারণ নয় যে ফ্রাঞ্জও তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে? তার নিজের জীবনটাও কি শেষ হয়ে আসছে না? সাহসী ডাক্তারদের সাথে সীমানায় আসা মানুষগুলো প্রদর্শনীবাদের প্রতি তিরস্কার করার সে কে? শুধুমাত্র লোক দেখানো প্রদর্শনী করা ছাড়া তারা আর কীইবা করতে পারে? তাদের কি কোনো অন্য বিকল্প ছিল?

ফ্রাঞ্জ ঠিকই ভাবছিল।আমিও প্রাহার সেই সম্পাদকের কথা না ভেবে পারছিলাম না, যিনি রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য মুক্তি চেয়ে পিটিশন সংগঠন করেছিলেন। তিনি খুব ভালো করেই জানতেন তার সেই পিটিশন বন্দীদের কোনো সাহায্য করবে না। তার সত্যিকারের লক্ষ্য ছিল বন্দীদের মুক্ত করা নয়, শুধু দেখানো যে নির্ভীক মানুষদের এখনও অস্তিত্ব আছে।সেটাও একধরনের ভান করা।কিন্তু তার আর কোনো সম্ভাবনাও ছিল না।তার বাছাই করার সুযোগ অভিনয় আর কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তার বাছাই করা বিষয়টি ছিল অভিনয় আর কোনো কাজ না করার মধ্যে। কিছু পরিস্থিতি আছে, যখন মানুষ অভিনয় বা ভান করার দণ্ড পায় অভিশাপ হিসাবে। নীরব ক্ষমতার বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম (নদীর ওপারে নীরব শক্তি, একজন পুলিশ দেয়ালে থাকা নীরব মাইক্রোফোনে রূপান্তরিত হয়) একটি নাটকের দলের সংগ্রাম, যা কোনো সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করেছে।

ফ্রাঞ্জ দেখে সরবোনের তার বন্ধুটি শূন্যে হাত তুলে অপর পাশের নীরবতাকে হুমকি দিচ্ছে।

২২
তৃতীয়বারের মত দোভাষী মেগাফোনে তার আহবান জানায়।

যে নীরবতা তার প্রত্যুত্তরে ফিরে আসে সেটি হঠাৎ করে ফ্রাঞ্জের হতাশাকে রূপান্তরিত করে ক্রোধে। এখানে সে দাড়িয়ে আছে, মাত্র কয়েক পা দূরে সেই সেতু থেকে, যা থাইল্যান্ডকে যুক্ত করেছে কম্বোডিয়ার সাথে, আর সে তীব্র একটি কামনা অনুভব করে সেখানে দৌড়ে যেতে, আকাশের দিকে রক্ত জমাট বাধিয়ে দেবার মত গালি চিৎকার করে দিতে দিতে এবং বন্দুকের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে মারা যেতে।

ফ্রাঞ্জের এই হঠাৎ ইচ্ছা আমাদের অন্যকিছু মনে করিয়ে দেয়; হ্যাঁ, আমাদের এটি মনে করিয়ে দেয় স্ট্যালিনের সেই ছেলের কথা, যখন কাটা তারের বেড়ার দিকে সে ছুটে গিয়েছিল নিজেকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করতে, যখন আর সহ্য করতে পারছিল না সে, মানব অস্তিত্বের মেরুগুলো যখন এত কাছাকাছি পরস্পরকে স্পর্শ করার মত পরিস্থিতিতে চলে এসেছিল, যখন মহিমান্বিত আর জঘন্য কিছুর মধ্যে আর কোনো পার্থক্য ছিল না, পার্থক্য ছিল না মাছি আর দেবদূতদের মধ্যে বা ঈশ্বর আর মলের মধ্যে।

ফ্রাঞ্জ কিছুতেই মেনে নিতে পারে না যে গ্র্যান্ড মার্চের মহিমা এর অংশগ্রহণকারীদের হাস্যকর অহংকারের সমান; ইউরোপিয় ইতিহাসের সুন্দর শব্দগুলো হারিয়ে যায় অসীম নীরবতায় এবং আর কোনো পার্থক্য থাকে না ইতিহাস আর নীরবতার মধ্যে। সে অনুভব করে যে সে তার নিজের জীবন রেখেছে দাঁড়িপাল্লায়, যেন সে প্রমাণ করতে চায় গ্র্যান্ড মার্চ মলের চেয়েও ভারী।

কিন্তু মানুষ এমন কিছু কখনো প্রমাণ করতে পারে না। দাঁড়িপাল্লার এক পালায় ভরা মল, অন্য পাল্লায় স্ট্যালিনের ছেলে তার পুরো শরীর রেখেছিল, কিন্তু সেই দাঁড়িপাল্লা একটুও সেদিকে হেলে যায়নি।

গুলি খেয়ে মরার বদলে ফ্রাঞ্জ শুধুমাত্র তার মাথা নত করে সবার সাথে সারি বেধে ফিরে যায় বাসের দিকে।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য