বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, সপ্তম পর্ব : ৪

 প্রকাশিত: ২০১৬-১১-০৮ ০১:৩৩:১৬

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, সপ্তম পর্ব (কারেনিনের হাসি)

তেরেজার কাছে ‘আইডিল’ বা প্রশান্ত পল্লীপ্রকৃতিসদৃশ শব্দটি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

ওল্ড টেস্টামেন্টের পুরাণ কাহিনী শুনে বড় হবার কারণে যেমন আমর হয়তো বলতে পারি কোন আইডিল হচ্ছে একটি দৃশ্যচিত্র যা আমাদের সাথে রয়ে গেছে স্বর্গের একটি স্মৃতির মত: স্বর্গের জীবন মানে অচেনা কোনো দিক বরাবর সরল রেখায় হেটে যাওয়া নয়, এটি কোনো অভিযানও নয়, পরিচিত নানা জিনিসের মধ্যে এটি বৃত্তাকারে ঘোরে। এর একঘেয়েমি জন্ম দেয় সুখের, বিরক্তি নয়।

যতদিন মানুষ গ্রামে বাস করবে, প্রকৃতিতে, গবাদি পশু দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে, নিয়মিত ভাবে পুনরাবৃত্তি হওয়া ঋতুর আলিঙ্গনে, তারা সেই স্বর্গীয় দৃশ্যের কমপক্ষে সামান্য খানিকটা আভাস ধরে রাখবে। সেকারণে তেরেজা, যখন তার সমবায় খামারের সভাপতির সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল স্পা’তে, গ্রামের একটি দৃশ্য সে কল্পনা করে নিতে পেরেছিল (একটি গ্রাম যেখানে সে কখনোই থাকেনি বা চেনে না) যা তাকে মুগ্ধ করেছিল। সেটি অতীতে দিকে তাকানোর তার একটি উপায়, অতীতের স্বর্গের দিকে।

কুয়োর পানির উপর ঝুঁকে পড়ে পানির উপর প্রতিফলন দেখা অ্যাডাম তখনও অনুধাবন করতে পারেনি, সে আসলে নিজেকে দেখেছে। তেরেজাকে অ্যাডার কখনোই বুঝতে পারতো না, যখন তেরেজা, অল্প বয়সী একটি মেয়ে যে তার আয়নার সামনে দাড়িয়ে শরীরের মধ্যে দিয়ে তার আত্মাকে দেখার চেষ্টা করতো। অ্যাডাম হচ্ছে কারেনিনের মত। তেরেজা একটি খেলা তৈরি করেছিল যেন কারেনিন আয়নায় নিজেকে দেখতে পারে, কিন্তু কখনোই সে তার নিজের প্রতিবিম্বকে চিনতে পারে নি। অবিশ্বাস্য নির্লিপ্ততায় শূন্য একটি দৃষ্টি নিয়ে সে তাকাতো আয়নার দিকে ।

অ্যাডামের সাথে কারেনিনের তুলনা আমাকে সেই ভাবনার দিকে নিয়ে যায়: স্বর্গে মানুষ তখনও মানুষ হয়ে ওঠেনি, অথবা আরো সুনির্দিষ্টভাবে, মানুষকে তখনও মানুষ হবার পথে নির্বাসিত করা হয়নি। এখন আমরা দীর্ঘদিনের নির্বাসিত, সময়ের শূন্যতার মধ্য দিয়ে সরলরেখায় দ্রুত চলছি। তারপরও আমাদের গভীরে একটি সরু সুতো আমাদের যুক্ত ররে রাখে বহু দূরের কুয়াশাচ্ছন্ন অস্পষ্ট সেই পরিত্যক্ত স্বর্গের সাথে, যেখানে অ্যাডাম কুয়োর উপর ঝুঁকে পানির দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু নার্সিসাসের ব্যতিক্রম, কখনোই এমনকি সে সন্দেহ করতে পারেনি ঐ ফ্যাকাসে হলুদ দাগটি, যা পানিতে দেখা যাচ্ছে সেটি আসলে তারই প্রতিবিম্ব। স্বর্গের জন্য মানুষের আকাঙ্ক্ষা আসলে মানুষ না হবার জন্যেই আকাঙ্ক্ষা ।

যখনই, তার শৈশবে, মাসিকের রক্তসহ তার মায়ের ফেলে দেয়া স্যানিটারি ন্যাপকিন তেরেজার চোখে পড়তো, খুব ঘৃণা লাগতো তার, এবং সে তার মাকে ঘৃণা করতো সেগুলো লুকিয়ে না রাখার মত নির্লজ্জ হবার জন্য। কিন্তু কারেনিন, আর যাই হোক না কেন, যে তার লিঙ্গে স্ত্রী, তারও মাসিক হত। প্রতি ছয় মাসে যা একবার হতো, স্থায়ী হতো প্রায় পক্ষকাল। পুরো ফ্ল্যাটে যেন সে রক্ত দিয়ে ময়লা না করে, তেরেজা তুলোর একটি প্যাড বানিয়ে তার দুই পায়ের মধ্যে রেখে এটি পুরোনো প্যান্টি খুব দক্ষতার সাথে লম্বা ফিতা দিয়ে বেধে দিত তার শরীরের সাথে। প্রতিটি মাসিকের পনেরো দিন সে কারেনিনের এই অবস্থা দেখে নিজে নিজেই হাসতো।

কেন কুকুরের মাসিক সে হালকাভাবে নিতো, যখন কিনা তার নিজের মাসিক তার অসহ্য লাগতো? এর উত্তর আমার কাছে মনে হয় সহজ, কুকুরদের কখনোই মানুষের মত স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হতে হয়নি। কারেনিন শরীর ও আত্মার দ্বৈততা সম্বন্ধে কিছুই জানে না, তার ঘৃণার ধারণাটি নেই। সে কারণে তেরেজা তার সাথে ঘনিষ্ঠ আর সহজ হতে পারে। (আর সে কারণে কোনো প্রাণিকে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে রূপান্তরিত করা খুব বিপজ্জনক: যেমন কোনো গরুকে দুধ তৈরি করার যন্ত্র।এটি করার মাধ্যমে, মানুষ সেই সুতোটি কেটে দেয় যা তাকে স্বর্গের সাথে যুক্ত করে রাখে, আর কিছু থাকে না অবলম্বন বা তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য, সময়ের শূন্যতার মধ্যে দিয়ে যখন তাকে ভেসে যেতে হয়।)

এই সব জট পাকানো ধারণাগুলো থেকে একটি ধর্মদ্রোহিতাপূর্ণ চিন্তা আসে তেরেজার মনে, আর কিছুতে সেটি সে তার মন থেকে ঝেড়ে সরাতে পারেনা: যে ভালোবাসা তাকে কারেনিনের সাথে যুক্ত করেছে সে ভালোবাসা তার ও টমাসের মধ্যে ভালোবাসার চেয়ে উত্তম, উত্তম তবে বড় নয়। তেরেজা তার নিজেকে বা টমাসের কোনো দোষ খুঁজতে চায় না। সে এমন কোনো ইচ্ছা পোষণ করে না দাবী করার জন্য যে, তারা নিজেদের এর চেয়ে বেশী ভালোবাসতে পারে। তার অনুভূতি ছিল, মানব দম্পতির প্রকৃতি অনুযায়ী; নর নারীর ভালোবাসা আগে থেকেই নিম্নমানের সেই ভালোবাসা থেকে যার অস্তিত্ব আছে মানুষ ও কুকুরের মধ্যে, মানব ইতিহাসের এই অদ্ভুত বিষয়টি সৃষ্টিকর্তার সম্ভবত অপরিকল্পিত।

এটি পুরোপুরি আত্মনিবেদিত নিঃস্বার্থ ভালোবাসা: তেরেজা কারেনিনের কাছে কিছু চায় না, সে তাকে ভালোবাসুক এমন দাবীও সে করে না। আর সে কখনোই নিজেকে সেই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞাসা করেনি যা মানব দম্পতিকে যন্ত্রণা দেয়: সে কি আমাকে ভালোবাসে? আমার চেয়ে কি তাহলে অন্য কাউকে সে ভালোবাসে বেশী? সে কি আমি তাকে যতটা ভালোবাসি তার চেয়ে আমাকে বেশী ভালোবাসে। হয়তো ভালোবাসার কাজে জানতে চাওয়া সব প্রশ্ন, একে পরিমাপ করা, পরীক্ষা করা, খুঁটিয়ে দেখা এবং এটি রক্ষা করার বাড়তি পরিণত হচ্ছে এটিকে সংক্ষিপ্ত করা। হয়তো যে কারণে আমরা ভালোবাসতে পারি না, তা হলো আমরা ভালোবাসা পাবার জন্য বেশী কামনা করি, অর্থাৎ, আমরা কিছু দাবী করি (ভালোবাসা) আমাদের সঙ্গীর কাছ থেকে, তাদের কাছে সেভাবে নিজেদের কোনো দাবী ছাড়াই নিবেদন না করে, যেখানে তাদের সঙ্গ ছাড়া আর কিছু আমরা চাইনা।

এবং আরো কিছু বিষয়: তেরেজা কারেনিনকে মেনে নিয়েছে সে যা ঠিক সেভাবেই। সে তার নিজের মত করে তাকে গড়ে তোলেনি, সে তার কুকুরের জীবনের সব কিছুই শুরু থেকে মেনে নিয়েছে, কোনো ইচ্ছা পোষণ করেনি, সেই জীবন থেকে তাকে বঞ্চিত করতে, তার গোপন কোনো কৌতুহল নিয়ে তাকে ঈর্ষা করেনি। যে কারণে তাকে কিছু সে শিখিয়েছিল, সেটি তাকে বদলে দেবার জন্য না (যেমন করে কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে বা স্ত্রী স্বামীকে সংস্কার করা চেষ্টা করে।) বরং তাকে সে মৌলিক ভাষার ব্যবহার শিখিয়েছিল, যা তাকে সক্ষম করেছে তাদের সাথে সংযোগ ও সহাবস্থান করতে।

এছাড়াও: তেরেজাকেও কেউ জোর করেনি কারেনিনকে ভালোবাসতে, কুকুরের জন্য ভালোবাসা হয় স্বেচ্ছায়। (তেরেজার আবার তার মায়ের কথা মনে পড়ে এবং সব কিছু নিয়ে সে অনুশোচনা করে, যা ঘটেছিল তাদের মধ্যে। যদি তার মা কোনো গ্রামের কোনো নাম না জানা মহিলা হতেন, সে হয়তো তার সেই লঘু স্থূলতাকে সহ্য করতে পারতো। ওহ, শুধুমাত্র যদি মা হতো কোনো আগন্তুক! শৈশব থেকেই, তেরেজা লজ্জা পেয়েছে যেভাবে তার মা তার নিজের চেহারার বৈশিষ্ট্যগুলো দখল করে আছে, বাজেয়াপ্ত করেছে তার আমিত্বকে। যে বিষয়টি এটিকে আরো খারাপ করেছে সেটি হচ্ছে প্রাচীন সেই কর্তব্য, তোমার পিতা ও মাতাকে ভালোবাসো! যা তাকে বাধ্য করেছে সেটি মেনে চলতে, সেই আগ্রাসনকে ভালোবাসা মানতে। তার মায়ের কোনো দোষ ছিল না তার সাথে তেরেজার সম্পর্ক ছিন্ন করার কারণ হিসাবে। তেরেজা তার সাথে সম্পর্ক রাখেনি কারণ সে যেধরনের মা ছিল সে কারণে নয় বরং এর কারণ সে ছিল একজন মা।)

কিন্তু সবচেয়ে বড় ব্যাপারটা হচ্ছে: কেউ কাউকে প্রশান্ত পল্লীপ্রকৃতিসদৃশ সেই স্বর্গটি উপহার দিতে পারে না। শুধুমাত্র একটি প্রাণি সেটি করতে পারে, কারণ শুধুমাত্র প্রাণিদের স্বর্গ থেকে বহিষ্কার করা হয়নি। মানুষ ও কুকুরের মধ্যে ভালোবাসা হচ্ছে প্রশান্ত স্বর্গীয়। এর মধ্যে কোনো সংঘর্ষ নেই, কোনো উত্তেজনাময় টান টান দৃশ্য নেই, এটি কোনো দিকে বিবর্তিত হয় না। কারেনিন তেরেজা আর টমোসকে ঘিরে রেখেছিল পুনরাবৃত্তিয় জীবন দিয়ে এবং সে তাদের কাছে সেটাই প্রত্যাশা করেছিল।

যদি কারেনিন কুকুরে বদলে কোনো মানুষ হতো, সে নিশ্চয়ই বহু দিন আগেই তেরেজাকে বলতো, ‘দেখো, আমি অসুস্থ এবং প্রতিদিন মুখে রোল নিয়ে ঘুরে বেড়াতে ক্লান্ত, তুমি কি এর চেয়ে ভিন্ন কিছু পরিকল্পনা করতে পারো না’? আর এখানেই আছে মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্দশা। মানুষের সময় বৃত্তাকারে আবর্তিত হয় না। এটি সামনে দৌড়ে চলে সরল রেখায়, আর সেকারণেই মানুষ কখনো সুখী হতে পারে না। সুখ হচ্ছে পুনরাবৃত্তির আকাঙ্ক্ষা।

হ্যাঁ, সুখ হচ্ছে পুনরাবৃত্তির আকাঙ্ক্ষা, তেরেজা নিজেকেই বলে।

যখন সমবায় খামারের সভাপতি তার মেফিস্তোকে নিয়ে হাটতে বের হতেন কাজের পর এবং তেরেজার সাথে তার দেখা হতো, কখনোই তিনি বলতে ভুলতেন না, ‘কেন তুমি আমার জীবনে এত পরে এলে, তেরেজা? আমি আর মেফিস্তো একসাথে মেয়ে পটাতে বের হতাম, সে আর আমি, কে ঠেকাতে পারতো দুটো ছোট শূকরকে’? এই মূহুর্তে তার পোষা শূকরটি প্রশিক্ষিত ছিল ঘোঁত ঘোঁত শব্দ আর নাক দিয়ে জোরে জোরো শ্বাস ফেলার জন্য। তেরেজা প্রতিবারই হাসতো, এমনকি যখন আগে থেকেই তেরেজা জানতো, সে কি বলবে। কৌতুকটি তার আকর্ষণীয়তা হারায়নি পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে। বরং এর ব্যতিক্রম, গ্রামের প্রশান্ত দৃশ্যপটে, প্রতিটি কৌতুকই পুনরাবৃত্তির মধুর নিয়মটি মানতে বাধ্য।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য