বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, সপ্তম পর্ব : ৫

 প্রকাশিত: ২০১৬-১১-১০ ০৪:০১:৫২

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, সপ্তম পর্ব (কারেনিনের হাসি)

কুকুররা মানুষের চেয়ে খুব বেশী সুবিধা ভোগ করে না, কিন্তু যেগুলো ভোগ করে তার মধ্যে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ: ইউথানাসিয়া বা কারো সহায়তায় যন্ত্রণাহীনভাবে মৃত্যুবরণ করার অধিকারটি আইনগতভাবে নিষিদ্ধ নয় তাদের ক্ষেত্রে। প্রাণিদের অধিকার আছে যন্ত্রণাহীনভাবে দয়াময় শান্তির একটি মৃত্যু পাবার। কারেনিন এখন তিন পায়ের উপর ভর করে হাটে আর, বেশী, অনেক বেশী সময় কাটায় সে ঘরে এক কোণে শুয়ে থাকে ক্লান্ত হয়ে, আর কেঁদে। স্বামী স্ত্রী একমত হয়েছিল অযথা তাকে আর কষ্ট দিয়ে মারার অপ্রয়োজনীয়তার বিষয়টিকে। কিন্তু নীতিগতভাবে তারা যতই একমত হোক না কেন, তারপরও তারা বাধ্য হয়েছিল উৎকণ্ঠিত হতে, কারণ তাদের অবশ্যই সেই বিষয়টিরও মুখোমুখি হতে হবে যখনই তাদের নির্ধারণ করতে হবে কখন তার এই কষ্টটা বাস্তবিকভাবেই অপ্রয়োজনীয় হবে, যে মুহূর্তের পর তার জীবন ধরে রাখার কোনো অর্থ হয় না।

শুধুমাত্র টমাস যদি ডাক্তার না হতো! তাহলে তারা একটি তৃতীয় পক্ষের আড়ালে থাকতে পারতো। তারা সেই পশু চিকিৎসকের কাছে ফিরে যেতে পারতো, আর তাকে বলতে পারতো কুকুরটিকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে।

মৃত্যুর সেই দায়িত্ব নেয়া খুবই আতঙ্কের একটি কাজ। টমাস দাবী করেছিল, সে নিজে সেই ইনজেকশনটি দেবে না, সে পশু চিকিৎসককে ডাকবে সেটি করার জন্য। কিন্তু সে অনুধাবন করে, কারেনিনকে একটি সুবিধা সে দিতে পারে যা মানুষের কাছে নিষিদ্ধ: মৃত্যু তার কাছে আসবে তার প্রিয়জনের ছদ্মবেশে।

কারেনিন সারারাত ধরেই কেঁদেছে । সকালে তা পাটা দেখে টমাস তেরেজাকে বলে, ‘আর অপেক্ষা করার কোনো কারণ নেই’।

কয়েক মিনিটের মধ্যে তাদের কাজে বের হতে হবে, তেরেজা কারেনিনকে দেখতে যায়। ততক্ষণ অবধি, সে ঘরের কোণে নির্বিকারভাবে শুয়েছিল ( এমনকি সে কোনো সাড়া দেয়নি যখন টমাস তা পা পরীক্ষা করে দেখেছিল), কিন্তু যখন সে শুনতে পায় দরজা খুলছে এবং তেরেজাকে সে আসতে দেখে, সে তার মাথা তুলে তেরেজার দিকে তাকায়।

তেরেজা তার দৃষ্টিটা সহ্য করতে পারেনা, তাকে প্রায় আতঙ্কিত করে তোলে, টমাসের দিকে সেভাবে কারেনিন কখনো তাকায়নি, শুধুমাত্র তার দিকে, কিন্তু কখনোই তীব্রভাবেই না। এটি কোনো মরিয়া দৃষ্টি না, অথবা এমনকি বিষণ্ণ নয়। না, এটি সেই ভয়াবহ আর দুঃসহ বিশ্বাসের দৃষ্টি। সেই দৃষ্টি একটি ব্যকুল প্রশ্ন। তার সারা জীবন কারেনিন অপেক্ষা করেছে উত্তরের জন্য তেরেজার কাছ থেকে এবং সে তাকে জানিয়ে দিচ্ছে ( যদি সাধারণ সময়ের তুলনায় আরো বেশী দ্রুততার সাথে), সে এখনও প্রস্তুত তার কাছ থেকে সত্যটা জানার জন্য ( যা কিছু তেরেজা থেকে

আসছে সেগুলো ছিল সত্য, এমন কি যখন সে নির্দেশ দেয়, বসো! অথবা শুয়ে পড়ো!, সে সেই আদেশগুলো সত্য হিসাবে দেখে, এমন কোনো সত্য হিসাবে সেগুলোকে চিহ্নিত করে যা তার জীবনকে অর্থবহ করে)। তার সেই ভয়াবহ বিশ্বাসের দৃষ্টিটি বেশীক্ষণ স্থায়ী হয়না। দ্রুত সে তার মাথাটি তার পায়ের উপর নামিয়ে রাখে। তেরেজা জানতো এভাবে আর কেউ কোনোদিনও তার দিকে তাকাবে না।

কারেনিনকে তারা কখনোই মিষ্টি কিছু খেতে দেয়নি, কিন্তু সম্প্রতি তেরেজা তার জন্য কিছু চকলেট বার কিনে এনেছিল। সেগুলো সে মোড়ক থেকে খুলে ছোট ছোট টুকরো করে তাকে দেয় খেতে, এবং তার চারপাশে সেগুলো দিয়ে একটি বৃত্ত তৈরি করে। এরপর সে একটি পানির পাত্র নিয়ে আসে নিশ্চিত করতে, তার কাছে যেন সব কিছু থাকে কয়েক ঘণ্টা যখন সে বাসায় একা থাকবে। যেভাবে কারেনিন তার দিকে তাকিয়ে ছিল ঠিক তখনই যেন মনে হলো তার সেই দৃষ্টি তাকে ক্লান্ত করে দিয়েছে। এমনকি চারপাশে চকলেট দেখেও সে তার মাথা তোলে না।

মাটিকে তার পাশে শুয়ে তেরেজা তাকে জড়িয়ে ধরে। খুব ধীরে আর কষ্টের সাথে মাথা ঘুরিয়ে, কারেনিন তার গন্ধ শোকে এবং তাকে একবার বা দুবার জিভ চেটে দেয়। তেরেজা তার চোখ বন্ধ করে, যখন সে আদর করতে থাকে, যেন সেটি সে মনে রাখতে চায় অনন্তকাল, সে তার অন্য গালটি ঘুরিয়ে দেয় আদর নেবার জন্য।

তারপর তেরেজাকে বের হতে হয় কাজে, বাছুরগুলো দেখার কাজে। দুপুরের খাবারে ঠিক আগ মুহূর্ত ছাড়া সে ফিরতে পারে না। টমাস তখনও বাসায় ফেরেনি। কারেনিন তখনও মেঝেতে শুয়ে আছে চারপাশে চকলেট ছড়িয়ে, এমনকি সে তার মাথাও ওঠায় যখন সে তাকে ঘরে ঢুকতে শোনে। তার খারাপ পাটা এখন অনেক ফুলে গেছে। এবং টিউমারটি অন্য আরেক জায়গায় ফুটে বের হয়েছে। খানিকটা হালকা লাল রঙের ফোটা ( রক্তের মত নয়) যেন জমাট বাধছে তার লোমের গোড়ায়।

আবারও সে মাটিতে তার পাশে শুয়ে পড়ে।তেরেজা তার শরীরটাকে একটি হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আর চোখ বন্ধ করে। তেরেজা শুনতে পায় কে যেন জোরে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে, ‘ডাক্তার ! ডাক্তার! শূকর এসে গেছে, শূকর ও তার মনিব’। তেরেজার কোনো শক্তি আর নেই কারো সাথে কথা বলার, সে নড়ে না, এমনকি তার চোখও খোলে না। ‘ডাক্তার! ডাক্তার! শূকর হাজির’, তারপর নীরবতা ।

টমাসে ফিরতে আরো আধা ঘণ্টা লাগে। সে সরাসরি রান্নাঘরে যায় এবং কোনো কথা না বলে ইনজেকশনটা তৈরি করে। যখন সে ঘরে ঢোকে , তেরেজা তখন দাড়িয়ে আছে, কারেনিনও নিজেকে কষ্ট করে দাড় করিয়েছে, যখনই সে টমাসকে দেখে, দুর্বলভাবে সে তার লেজটি নাড়ায়।
‘দেখো’, তেরেজা বলে, ‘ও এখনও হাসছে’। সে অনুনয় করে বলে, যেন চেষ্টা করে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য কারেনিনের জন্য কিছু সময় জয় করার জন্য। কিন্তু সে জোর করে না।

ধীরে ধীরে, কাউচের উপর তেরেজা একটি চাদর বিছিয়ে দেয়, সাদা সেই চাদরে ছোট ছোট ভায়োলেট ফুল আকা নকশা। সবকিছু সে আগে থেকেই সতর্কভাবে ভেবে পরিকল্পনা করে রেখেছিল বহুদিন আগেই, কারেনিনের মৃত্যুর কথা কল্পনা করে (কত ভয়ানক যে আমরা আসলেই আমরা যাদের ভালোবাসি তাদের মৃত্যু কল্পনা করি।)

কারেনিনের আর সেই শক্তি নেই লাফ দিয়ে কাউচে উঠবে। তারা একসাথে তাকে কোলে তুলে নেয়। তেরেজা তাকে তার একপাশে শুইয়ে দেয় আর টমাস ভালো একটি পা পরীক্ষা করে দেখে, সে মোটামুটি স্পষ্ট একটি শিরা খুঁজছিল, তারপর কাচি দিয়ে কিছু লোম সে কেটে জায়গাটি পরিষ্কার করে।

কাউচের পাশে হাঁটু মুড়ে বসে তেরেজা কারেনিনের মাথাটা তার মাথার কাছে ধরে রাখে। টমাস তাকে শক্ত করে চাপ দিয়ে দিয়ে পাটা ধরতে বলে কারণ সে শিরায় সূচ ঢোকাতে পারছিল না। টমাসের কথা মত সে কাজ করে, কিন্তু তার মুখটা কারেনিনের মাথার কাছ থেকে সরায় না। সে কারেনিনের সাথে আস্তে আস্তে কথা বলতে থাকে, আর সে শুধু তার কথাই ভাবে। কারেনিন ভয় পায়না, সে তেরেজার মুখটা আরো দুবার চেটে দেয়, আর তেরেজা ফিস ফিস করে বলতে থাকে, ‘ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, তুমি আর কোনো ব্যথা পাবে না, তুমি কাঠবিড়ালি আর খরগোশদের স্বপ্ন দেখবে, সেখানে গরুও থাকবে, মেফিস্টোও সেখানে থাকবে, ভয় পেয়ো না..’

টমাস শিরায় সূচ ঢুকিয়ে ইনজেকশন দেয়, কারেনিনে পা কয়েকবার কেঁপে ওঠে। তার শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত হয় কয়েক সেকেন্ডের জন্য, তারপর থেমে যায়। তেরেজা কাউচের কাছে মেঝেতে বসে থাকে, কারেনিনের মাথায় মুখ ঢেকে।

এরপর তাদের দুজনকেই আবার কাজে ফিরে যেতে হয়, কাউচের উপর কুকুরটিকে সেভাবে শুইয়ে রেখে, ছোট ছোট ভায়োলেট এর নকশা আকা সাদা বিছানার চাদরের উপর।

সন্ধ্যা নাগাদ তারা ফিরে আসে। টমাস বাগানে যায়, দুটি আপেল গাছের মাঝখানে তেরেজার গোড়ালি দিয়ে আকা আয়তাকার ক্ষেত্রটি খুঁজে পায় সে। এরপর সে খুড়তে শুরু করে। নির্দিষ্ট দাগের মধ্যেই সে খুঁড়ছিল, সে চাইছিল সব কিছু তেরেজা যেমন চেয়েছে তেমনই ভাবে হোক।

তেরেজা কারেনিনের সাথে ঘরে ছিল, সে তাকে জীবন্ত কবর দিতে ভয় পাচ্ছিল। সে তার মুখের কাছে তার কান নেয় আর ভাবে সে হয়তো হালকা শ্বাস নেবার শব্দ পাচ্ছে, সে একটু পিছিয়ে সরে আছে, তার যেন মনে হয় কারেনিনের বুক খুব সামান্য নড়ছে।

(না, সে শ্বাস নেবার শব্দটি সে শুনেছিল, সেটি তার নিজের, কারণ এটি তার শরীরকে খুব হালকা গতিতে পরিচালিত করছিল, এবং তার মনে হয়েছিল কুকুরটি সামান্য নড়ছে);

সে তার ব্যাগে একটি আয়না পায়, সেটি কারেনিনের মুখের সামনে ধরে। আয়নাটিতে এত ঝাপসা দাগ লেগেছিল যে, সে ভেবেছিল সেখানে কিছু দাগ দেখতে পাচ্ছে, তার শ্বাসের কারণে সৃষ্ট।

‘টমাস! কারেনিন বেঁচে আছে’, সে চিৎকার করে, যখন টমাস বাগান থেকে ভিতরে আসে তার কাদা মাখা বুট পরে।

টমাস তার উপর ঝুঁকে দেখে, আর মাথা নাড়ায়। তারা দুজনেই বিছানার চাদরটির দুই প্রান্ত ধরে, যেখানে কারেনিন শুয়ে আছে। তেরেজা শেষে মাথাটি, টমাস উপরের প্রান্তটি। এরপর তারা তাকে উঁচু করে তুলে বাগানে নিয়ে আসে।

বিছানার চাদরটা তার হাতে ভেজা মনে হয় তেরেজার, সে প্রস্রাব করেই তাদের জীবনে এসেছিল, এখন সে প্রস্রাব করেই তাদের জীবন থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, সে ভাবে, আর তেরেজার ভালো লাগে তার হাতে সেই আর্দ্রতা পেয়ে। তার শেষ শুভেচ্ছা।

তারা আপেল গাছগুলোর কাছে নিয়ে যায় ও তাকে কবরে রাখে। সে ঝুঁকে গর্তটি দেখে, তারপর চাদরটি এমনভাবে সাজায় যেন তাকে পুরোপুরি ঢেকে দেয়। বিষয়টি দুঃসহ ভাবা যে কিছুক্ষণ পরই তারা তার উপর মাটি ছুড়ে দেবে, তার নগ্ন শরীরের উপর বৃষ্টির মত পড়বে।

এরপর তেরেজা ঘরে ফিরে যায়, ফেরত আসে তার গলার বন্ধনী, বন্ধনী, এক মুঠো টকলেট যা সকালে অস্পৃশ্য অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে, সে সবকিছুই তার সাথে কবরের মধ্যে ছুড়ে দেয়।

গর্তের পাশে নতুন ভাবে রাখা মাটির স্তূপ, কোদাল হাতে নেয়।

ঠিক তখনই তেরেজার সেই স্বপ্নের কথা মনে পড়ে, দুটি রোল আর একটি মৌমাছির জন্ম দেয় কারেনিন। হঠাৎ করেই শব্দগুলো এপিটাফের মত মনে হয়, সে কল্পনা করে একটি স্মারক চিহ্ন এখনে দাড়িয়ে আছে, আপেল গাছগুলোর মাঝখানে, যেখানে লেখা আছে, ‘এখানে শুয়ে আছে কারেনিন, সে জন্ম দিয়েছিল দুটি রোল আর একটি মৌমাছির’।

বাগানে তখন গোধূলি, দিন আর রাতের মাঝামাঝি সময়। আকাশে ম্লান একটি চাঁদ, মৃতদের কক্ষে রাখা বিস্মরিত কোনো প্রদীপের মত।

তাদের বুট কাদায় ভরে গেছে যখন তারা কোদাল, শাবল গুছিয়ে রাখে, যেখানে তাদের যন্ত্রপাতিগুলো সার বেধে দাড় করানো আছে: নিংড়ানী, পানি দেবার পাত্র, নল।
[আগামী পর্বে সমাপ্য]

আপনার মন্তব্য