বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, ষষ্ঠ পর্ব : ২৬-২৯

 প্রকাশিত: ২০১৬-১০-২৮ ০১:২৬:০৪

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, ষষ্ঠ পর্ব (দ্য গ্র্যান্ড মার্চ) : ২৬ -২৯
২৬
বাসটি ব্যাংককের সেই হোটেলের সামনে এসে থামে, কারোরই আরা কোনো সভা করার মানসিকতা ছিল না। নানা দলে ভাগ হয়ে সবাই শহর দেখতে বের হয়ে যায়। কেউ যায় মন্দিরে, কেউ পতিতালয়ে। ফ্রাঞ্জের সরবোনের পুরোনো বন্ধুটি তাকে প্রস্তাব দেয় সন্ধ্যাটা একসাথে কাটাতে, কিন্তু ফ্রাঞ্জ একা থাকাই শ্রেয়তর মনে করেছিল।

তখন প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছিল ফ্রাঞ্জ রাস্তায় যখন হাটতে বের হয়। সে কেবলই সাবিনার কথাই ভাবতে থাকে, অনুভব করে সাবিনা তার দিকে তাকিয়ে আছে। যখনই সে সাবিনার দীর্ঘ দৃষ্টি অনুভব করেছে, নিজেকে সে সন্দেহ করতে শুরু করেছে : কখনোই সে পুরোপুরি বুঝতে পারেনি, সাবিনা কি ভাবতো। বিষয়টি তাকে অস্বস্তিতে ফেলতো, এখনও তার সেটি মনে হয়। সে কি তাকে ব্যাঙ্গ করতে পারে? সে তাকে নিয়ে যে ধর্ম তৈরি করেছে, সেটিকে কি সে বোকামি ভাবছে? সাবিনা কি তাকে বলার চেষ্টা করছিল, এবার তার প্রাপ্তবয়স্ক হবার সময় হয়েছে এবং তার উচিৎ হবে পুরোপুরিভাবে সেই প্রেমিকার প্রতি নিবেদিত হওয়া, যাকে সে পাঠিয়েছিল তার কাছে?

গোল চশমাসহ সেই ছাত্রী প্রেমিকাটির চেহারাটি কল্পনা করে হঠাৎ করেই ফ্রাঞ্জ অনুধাবন করে সে আসলেই কত সুখী তার এই প্রেমিকাকে নিয়ে। আর একই সাথে কম্বোডিয়ায় এই অভিযানটি তার কাছে অর্থহীন, হাস্যকর বলে মনে হয়। কেন সে এসেছে এখানে? শুধুমাত্র এখন সেটি সে বুঝতে পারে। সে এসেছিল তার কারণ, চূড়ান্তভাবে সে জানতে চেয়েছিল এইসব মিছিল বা সাবিনা নয়, চশমা পরা সেই তরুণী হচ্ছে তার আসল জীবন, তার একমাত্র সত্যিকারের জীবন! সে এখানে এসেছিল জানতে যে, সেই বাস্তবতাটি স্বপ্নের চেয়ে অনেক বেশী, স্বপ্নের চেয়েও অনেক অনেক বেশী।

হঠাৎ করেই আধো অন্ধকার থেকে একটি মানুষ বেরিয়ে আসে আর তাকে এমন কোনো একটি ভাষায় কিছু বলে যে ভাষাটি সে জানেনা। ফ্রাঞ্জ আগন্তুককে দেখে ও চমকে ওঠে, তবে সহমর্মিতা প্রদর্শন করে। মানুষটি মাথা নুইয়ে হাসে ও বিড়বিড় করে কিছু বলে ওঠে খুব তাড়াসহ। কি বলতে চেষ্টা করছে লোকটি? মনে হচ্ছে সে যেন তাকে কোথাও যাবার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে । মানুষটি তার হাত ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়। ফ্রাঞ্জ সিদ্ধান্ত নেয় কারো নিশ্চয়ই তার সাহায্য প্রয়োজন। হয়তো তার এতদূরে আসার কোনো অর্থ হতে পারে, কাউকে সাহায্য করার জন্য কি তাকে ডাকা হচ্ছে না?

এরপর হঠাৎ করে প্রথম মানুষটার পাশে আরো দুটি মানুষ আবির্ভূত হয়, তাদের একজন ইংরেজিতে তার কাছে যা টাকা আছে সেগুলো তাদের দিতে বলে।

সেই মুহূর্তে চশমা পরা তরুণীটি তার চিন্তা থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়, আর সাবিনা তার দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তার উপর। অবাস্তব সাবিনা তার মহান নিয়তি সহ, সেই সাবিনা যে সবসময় তার নিজেকে খুব অপ্রতুল হিসাবে মনে করিয়েছে। সাবিনার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি ছিদ্র করে তার ভিতর প্রবেশ করে, রাগী আর অসন্তুষ্ট: সে কি আবারো বোকা বনেছে? কেউ কি আবারো তার নির্বুদ্ধিতা-পূর্ণ ভালোমানুষির অপব্যবহার করেছে?

সে লোকটি কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়, যে এখন তার শার্টের হাতা আকড়ে ধরে আছে। সে মনে করতে পারে সাবিনা সব সময়ই তার শারীরিক শক্তির প্রশংসা করতো। সে অন্য লোকটি হাত শক্ত করে ধরে যে তার গায়ের উপর খানিকটা ঝুঁকে পড়েছিল, এবং শক্ত করে তাকে ধরে ফ্রাঞ্জ তাকে নিখুঁত একটি জুড়োর কসরতে ঘাড়ের উপর দিয়ে ছুড়ে মাটিতে ফেলে দেয়।

এখন সে নিজের উপর সন্তুষ্ট, সাবিনার চোখ তখনও তার উপর, সে আর কখনোই দেখবে না ফ্রাঞ্জ তার নিজেকে অপমানিত করছে! আর কখনোই সে তাকে প্রস্থান করতে দেখবে না! নরম মন আর ভাবালুতাপূর্ণতা যথেষ্ট হয়েছে,ফ্রাঞ্জের জন্য, আর না।

আনন্দময় একটি ঘৃণা সে অনুভব করেছিল এই লোকগুলোর প্রতি। আর তারা ভেবেছিল এই লোকটার পাগলামি আর নির্বুদ্ধিতায় কিছুটা হেসে নেয়া যাবে। ঘাড় খানিকটা ঝুঁকিয়ে সে সেখানে দৃঢ়ভাবে দাড়িয়ে থাকে, বাকী দুজনের দিকে তার চোখ দ্রুত আসা যাওয়া করতে থাকে । হঠাৎ করেই সে মাথায় একটা ভারী আঘাত অনুভব করে, সাথে সাথে দুমড়ে মাটিতে সে পড়ে যায়। অস্পষ্টভাবে সে অনুভব করে কোথাও তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তারপর তাকে এটি শূন্যতায় ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়, সে নিজেই অনুভব করে কোথাও যেন সে পড়ে যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর একটি ভাঙ্গার শব্দ শোনে সে, এরপর সে জ্ঞান হারায়।

জেনেভার একটি হাসপাতালে তার ঘুম ভাঙ্গে ফ্রাঞ্জের। মারি-ক্লদ তার বিছানার উপর ঝুঁকে তাকিয়ে আছে। মারি-ক্লদকে তার বলতে ইচ্ছা হচ্ছিল, তার এখানে থাকার কোনো অধিকার নেই। চশমা পরা সেই তরুণীটিকে তখনই সেখানে ডেকে আনতে তাদের সে নির্দেশ দিতে চাচ্ছিল। তার সব চিন্তা তখন তাকে নিয়ে, সে চিৎকার করতে চাইলো, তাকে ছাড়া তারপাশে সে আর কাউকে সেখানে সহ্য করতে পারছে না । কিন্তু আতঙ্কের সাথে ফ্রাঞ্জ অনুভব করে সে কথা বলতে পারছে না। অসীম ঘৃণা নিয়ে সে মারি-ক্লদের দিকে তাকায়, চেষ্টা করে তার কাছ থেকে সরে যেতে। কিন্তু সে তার শরীরটাও নাড়াতে পারে না। তার মাথা, হয়তো? না, সে এমনকি তার মাথাও নাড়াতে পারে না। সে চোখ বন্ধ করে যেন তাকে আর মারি-ক্লদকে দেখতে না হয়।

২৭
মৃত্যুতে, অবশেষে ফ্রাঞ্জ অবশেষে তার স্ত্রীর দখলে ফিরে আসে। সে এখন মারি-ক্লদের কুক্ষিগত, অথচ এমনভাবে সে কখনোই মারি-ক্লদের ছিল না। মারি-ক্লদ সবকিছু আয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন, বিবৃতি, ফুলের ব্যবস্থা, এবং একটি কালো জামাও বানানো হয় – বিয়ের কাপড়, বাস্তবিকভাবে। হ্যাঁ, একজন স্বামীর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানই একজন স্ত্রীর সত্যিকারের বিয়ের অনুষ্ঠান! তার জীবনের সব কর্মকাণ্ডের চূড়ান্ত ক্লাইম্যাক্স ! তার সব যন্ত্রণার পুরষ্কার!

ধর্ম যাজক বিষয়টি খুব ভালো করেই বোঝেন। তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে তার ভাষণ ছিল একটি সত্যিকারের দাম্পত্য ভালোবাসা সংক্রান্ত, বহু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যা মৃত ব্যক্তির জন্য শান্তির ঠিকানা হিসাবে রয়ে গেছে। একটি বন্দর যেখানে সে তার জীবনের শেষ দিনে ফিরে এসেছে।ফ্রাঞ্জের যে সহকর্মীদের মারি-ক্লদ কবরের পাশে কথা বলতে অনুরোধ করেছিল তারা মূলত মৃতের সাহসী স্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলেন।

পেছনে কোথাও দূরে, কোনো বন্ধুর ঘাড়ে ভর করে দাড়িয়ে ছিল বড় চশমা পরা সেই তরুণীটি। বহু ঔষধ আর চেপে রাখা কান্নার সংমিশ্রণ তাকে খিচুনির মত আক্রমণ করে অনুষ্ঠানটি ঠিক শেষ হবার আগে। সামনের দিকে ঝাঁকুনি দিয়ে সে পড়ে যায়, পেটটা আকড়ে ধরে, তার বন্ধু তাকে সমাধিস্থল থেকে নিয়ে যায় ।

২৮
যে মুহূর্তে সমবায় খামারের সভাপতির কাছ থেকে শিমন টেলিগ্রামটি পায়, সে লাফ দিয়ে তার মটর সাইকেলে উঠে বসে। সময় মত সে হাজির হয়েছিল তার বাবার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানটি আয়োজন করার জন্য। সমাধি ফলকের জন্য বাবার নামের নীচে লেখার জন্য সে বেছে নেয়,

‘তিনি পৃথিবীতে ঈশ্বরের রাজত্ব চেয়েছিল’।

শিমন খুব ভালোভাবেই জানতো, তার বাবা ঐ শব্দগুলো কখনোই এভাবে বলতেন না, কিন্তু সে নিশ্চিত ছিল বাক্যটি তার বাবা আসলেই যা ভাবতেন সেটাই প্রকাশ করতে পারছে। ঈশ্বরের রাজত্ব মানে ন্যায়বিচার। টমাস এমন একটি জগত আকাঙ্ক্ষা করেছিল যেখানে ন্যায়বিচারের রাজত্ব থাকবে। শিমনের কি কোনোই অধিকার নেই তার নিজের শব্দভাণ্ডার দিয়ে তারা বাবার জীবনকে প্রকাশ করার জন্য? অবশ্যই তার সেই অধিকার আছে: অনাদিকাল থেকে সব উত্তরসূরিদের কি এই অধিকার ছিল না?

ফ্রাঞ্জের সমাধিফলকের উপর পাথরটিকে অলঙ্কৃত করেছিল ‘দীর্ঘ ভ্রমণ শেষ প্রত্যাবর্তন’ বাক্যটি, এটিকে ধর্মীয় অর্থে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে: ভ্রমণ যদি হয়ে থাকে আমাদের পার্থিব অস্তিত্ব, প্রত্যাবর্তন মানে ঈশ্বরের আলিঙ্গনের প্রত্যাবর্তন। কিন্তু কাছের লোকরা জানতেন এর একটি নিখুঁত ধর্মনিরপেক্ষ অর্থও আছে। আসলেই মারি-ক্লদ এটি নিয়ে কথা বলেছে প্রতিদিন:

‘ফ্রাঞ্জ, আমার প্রিয়, লক্ষ্মী ফ্রাঞ্জ। মাঝবয়সের উদ্বেগগুলো সহ্য করা তার জন্য খুব বেশ কঠিন অনুভূত হয়েছিল। আর সেই হতভাগা ছোট মেয়েটা, তাকে তার জালে ফাঁসিয়ে দেয়।কিন্তু কেন, এমনকি সে সুন্দরও দেখতে ছিল না! (তোমারা দেখেছো সেই বিশাল চশমাটা, যার পিছনে সে নিজেকে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করে?), কিন্তু যখনই পুরুষগুলোর বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হতে থাকে (সবাই কি তা আমরা জানি না!), তারা তাদের আত্মাকে বেঁচে দেয়ে নতুন এক টুকরো মাংসের লোভে। শুধুমাত্র তার স্ত্রী জানে কিভাবে এটি তাকে যন্ত্রণা দিয়েছে, বিশুদ্ধ মানবিক যন্ত্রণা! কারণ, সত্যিকারভাবে তার অন্তরে, ফ্রাঞ্জ একজন দয়ালু আর ভদ্র মানুষ ছিল। না হলে কিভাবে তুমি ব্যাখ্যা করবে সেই পাগলামো, এশিয়ার কোন অজানা জায়গায় এমন মরিয়া হয়ে ছুটে যাওয়া? সেখানে সে আসলে তার মৃত্যু খুঁজতে গিয়েছিল’। হ্যাঁ, মারি-ক্লদ যেন সেটি জানেন চরম বাস্তব সত্য হিসাবে:

ফ্রাঞ্জ সচেতনভাবে তার মৃত্যুকে খুঁজে বের করেছিল। তার শেষ দিনগুলোতে, যখন সে মারা যাচ্ছিল আর যখন কোনো প্রয়োজন ছিল না মিথ্যা বলার, শুধুমাত্র মারি-ক্লদই ছিল একমাত্র মানুষ যাকে সে খুঁজেছিল সবসময়। সে কথা বলতে পারেনি, কিন্তু কিভাবে সে তার চোখ দিয়ে তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল! তার দিকে তাকিয়ে ছিল আর ভিক্ষা করেছে যেন তাকে সে ক্ষমা করে দেয়। আর সে তাকে ক্ষমা করেও দিয়েছেন।

২৯
কম্বোডিয়ার সেই মুমূর্ষু জনগণের অবশিষ্টাংশের কি হয়েছিল তারপর?

একটি বিশাল আলোকচিত্র, যেখানে আমেরিকার অভিনেত্রী তার কোলে একটি এশিয় শিশুকে ধরে আছেন।

টমাসের অবশিষ্টাংশ কি ছিল?

সমাধি ফলকে একটি লেখা, ‘তিনি পৃথিবীতে ঈশ্বরের রাজত্ব চেয়েছিল’।

বিটহোভেনের কি অবশিষ্ট আছে?

একটি ভ্রুকুঞ্চন, একটি অসম্ভাব্য চুলের কেশর এবং একটি গম্ভীর কণ্ঠের সূর - এস মুস সাইন (অবশ্যই করতে হবে) !

ফ্রাঞ্জের বাকী ছিল কি?

সমাধি ফলকে লেখা, ‘দীর্ঘ ভ্রমণ শেষে প্রত্যাবর্তন’।

আর এভাবেই সব কিছু ঘটে। বিস্ফোরিত হবার আগে, আমরা রূপান্তরিত হবো ‘কিচে’। ‘কিচ’ হচ্ছে বেঁচে থাকা আর বিস্মরণের মধ্যবর্তী একটি বিরতি।
(ষষ্ঠ পর্ব সমাপ্ত)

আপনার মন্তব্য