জীবন আমার ভাই

 প্রকাশিত: ২০১৫-১১-১০ ১৫:২১:১৩

মাসকাওয়াথ আহসান:

তাকে দেখা যেতো মিছিলের পুরোভাগে। 'স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক'। স্বোপার্জিত স্বাধীনতার সামনে তীক্ষ্ণ চিবুক, ঝিলিক লাগা চোখের তারায় জ্বলে ওঠা শব্দাবলীর সঙ্গে একজন শ্যামলা ছিপছিপে যুবক- আমি জানতাম হে অর্জুন।

অপরাজেয় বাংলার সামনে স্লোগানে স্লোগানে কতো খাঁ খাঁ দুপুর। মধুর ক্যান্টিনে স্টিলের পাতে হাতের থাবা দিয়ে গল্পের তুবড়ি। ডাকসু ইলেকশন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ-কার্জন হল-বুয়েট ক্যাম্পাস-ফজলে রাব্বী হল-একজন অর্জুন ছুটে বেড়ায়।

তোমাকে পাওয়ার জন্য হে গণতন্ত্র। লাজুক বেণী মৃদুল হাসির কোনো শ্যামলা তরুণী তার জন্য অপেক্ষা করে। অপেক্ষায় চোখ পুড়ে যায়। সময় কোথায়। প্রেম যে তাকে টানে না তা নয়, রাত জেগে স্বৈরাচার বিরোধী বুলেটিনের প্রুফ দেখে। দুপুরে না খেয়ে পয়সা জমা করে। সেন্ট্রাল লাইব্রেরীর দেয়ালে আঁকতে হবে স্বৈরাচার বিরোধী ম্যুরাল।

পরীক্ষার আগের রাতে নোটবুকে স্কেচপেনে হাবিজাবির মাঝে লেখা হয়ে যায় দু একটা নিষিদ্ধ কবিতা। এসএম হলের বেলে পাথরের মিহরাবে গড়া গম্বুজের পাশে বসে রাত জাগা। হঠাৎ একটু বাজিয়ে ফেলা বাঁশী। ভালো ছাত্রদের পড়ার টেবিল-ব্রিটিশ কাউন্সিল কিংবা প্রিয় শিক্ষকের চেম্বার থেকে বের করে নিয়ে যাওয়া হ্যামিলনের বাঁশী।

সেই পারতো স্বপ্ন দেখাতে- স্বপ্ন দেখবার মতো সাহসী করে তুলতে। স্নেহ করবার মতো বুক ছিল তার সুঠাম, প্রশস্ত, পৌরুষে টান টান। চল, মিছিলে চল। অমনি সামনে শরীর পেতে দেয়া উৎসবে তার কণ্ঠ উচ্চকিত হয়, 'স্বৈরাচার নিপাত যাক'। তাকে দেখে বিশ্বাস জাগে, কবিও যোদ্ধা হয়। গায়কও যুদ্ধ জানে।

পুলিশ ভ্যানে যখন তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, লোহার খাঁচার মধ্য থেকে ভেসে আসে অর্জুনের আওয়াজ। ছত্রভঙ্গ মিছিলের প্রতি আহবান- গণতন্ত্র মুক্তি পাক। ৭১-এ যারা শিশু বা কিশোর- নব্বুই তাদের যেন আরেক মুক্তিযুদ্ধের সাধ পূরণ।

তারপর, বেশ কিছু সময় পরে তার সঙ্গে দেখা। পুলিশের লোহার খাঁচার মধ্যে যে অর্জুনের জ্বলজ্বলে চোখ দেখা গিয়েছিল তা কোথায়! হাতে সেলুলার। শরীরে বিলাসী বড়লোকি ঢিলেঢালা চাল- সিল্কের রুচিহীন শার্ট- চোখের তলায় নষ্ট হয়ে যাওয়া মানুষের বলিরেখা। হাতের কব্জিতে জিপ্পো লাইটার। স্নেহ তো মরে না সহজে। অনুজপ্রতিমের দিকে বাড়িয়ে দেয় দরাজ হাত। গমগমে কণ্ঠ, কিরে কি খবর? পদ্যটদ্য লিখিস!

সেই কণ্ঠ, সেই হাত- সুঠাম চেতানো সেই প্রশস্তবুক অগ্রজ আমার। কি যেন নেই। তবু কি যেন নেই সেখানে আগের মতোন।

ব্যবসার ফিরিস্তি- ঠিকাদারী- রাজনীতি- অর্থনীতি- সামনে ইলেকশনে টিকিট- নির্বাচনী এলাকার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধ। যে শ্যামলা ছিপছিপে তরুণী সেন্ট্রাল লাইব্রেরীতে তার জন্য অপেক্ষা করতো এখনো সে অপেক্ষা করে ডাইনিং টেবিলে- গাড়ির হর্ণের জন্য কান পেতে। শুধু সেই অপেক্ষার আনন্দটা নেই।

হিসাবের খাতায় স্কেচপেনের আঁকিবুঁকির মধ্যে জন্ম নেয় না আর কোন নিষিদ্ধ কবিতা। আর সে কণ্ঠ মেলায় না গণসঙ্গীতে। ব্যস্ততার কারণে দুপুরে অনেক সময় খাওয়া হয় না। তাই বলে পয়সা জমানো হয় না দেওয়াল লিখনের রং কেনার জন্য।

তার গাড়িটা যখন বাংলামোটর সিগনাল বাতির সামনে থামে। কোত্থেকে দৌড়ে আসে অনির্বাণ, উস্কো খুস্কো চুল- গাল ভাঙা- কণ্ঠনালীর হাড় উঠে থাকা- চোখের তলায় না ঘুমানোর কালি- কাঁধে একটা ঝোলা। সেই অনির্বাণ যে রাত জেগে এঁকেছিল স্বৈরাচার বিরোধী ম্যুরাল। পাশে বসে রং-তুলি এগিয়ে দিয়েছিল অর্জুন। সিগারেট ধরিয়ে তাপিত করেছিল পৌষের কনকনে শীত রাত। সূর্যসেন হল থেকে ভেজে এনেছিল ডিমের মামলেট।

এমনতো কথা ছিল না বন্ধু! তোমার তো আমাদের সঙ্গেই থাকার কথা ছিল।

গাড়িটা সাঁই করে বাম দিকে কেটে যায়। অনির্বাণ চিৎকার করে আরো কি সব বলছিল। অগ্রজ, অনুজকে নিয়ে সান্তরের কোণার টেবিলে বসে খাবারের মেন্যু হাতে তুলে দিয়ে বললেন, টেক এনিথিং। মনোরম সাউথ ইন্ডিয়ান কুইসিনের সামনে বসে অনির্বাণের কথা ভাবাটা নব্বইয়ের ভাবালুতা। 'প্রিপেয়ার ইওরসেলফ ফর টুয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি।'

অর্জুন কাটা চামচ দিয়ে মুখে তুলে দেয় রেশমি কাবাব। তার সেলুলার বেজে উঠে। ডিসট্যান্ট কল রিসিভ করে। তারপর নির্মোহ ভঙ্গিতে বলে, 'দুইডা পড়ছে'। শালা।

সালাদ মুখে দিয়ে চোখ বুঁজে চিবাতে থাকে- জীবন, আমার ভাই।

আপনার মন্তব্য