সাকা-নাকা সাকা-নাকা দেহ দোলানাহ!

 প্রকাশিত: ২০১৫-১১-২৩ ১৫:৫৩:৪৩

মাসকাওয়াথ আহসান:

হেভেনের ৩২ নম্বরের ব্যালকনীতে পায়চারী করছেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ থেকে একাত্তরের আদিম অপরাধী সালাউদ্দীন কাদের আর মুজাহিদ এসেছে। মুজাহিদকে নরকে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু সাকা’র ব্যাড-হিলসের খুনে বাহিনীর একটি অংশ দোজখে তোরণ বানিয়ে তাকে সম্বর্ধনার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সাকাকে হেভেনের মাঝের দোজখে মানে গোবর-ডাঙ্গা ও শিয়ালনগরের ক্রসরোডে একটি খাঁচায় ভরে জনপ্রদর্শনীর জন্য রেখে দেয়া হবে।

বঙ্গবন্ধু ভয় পাচ্ছেন যেভাবে গোবরডাঙ্গা ও শিয়ালনগরে সাকা-প্রবৃত্তির লোক বেড়েছে তাতে আবার সাকা খাঁচা-পীর না হয়ে যায়!

বঙ্গবন্ধুর আশংকা সত্যি হয়। সাকা খাঁচার মধ্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিতকার করে,

--বদনা হয়ে গেলাম!

 

অমনি লোকজন হাততালি দিয়ে পুনরাবৃত্তি করে,

--বদনা হয়ে গেলাম।

সাকা নানারকম অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে লোকজনকে বিনোদন দেয়। এই অশ্লীল বিনোদনের রেটিং এতই বেড়েছে যে খন্দকার মুশতাক উপস্থিত জনতার কাছে আহবান জানায়, খাঁচা-পীরের জন্য সবাই কিছু উপঢৌকন নিয়ে আসবেন। ফ্রিতে এতো বিনোদন হয়না।

সাকা খাঁচার মধ্যে বসে চিৎকার করে,

--আমারে দোজখে পাঠায় না কেনো; সেখানে আমার অনেক ভক্ত। বুঝিনা এইসব সিদ্ধান্ত কে নেয়! এখানেও কী লেজ কুত্তা নাড়ায়!

উপস্থিত জনতা হাসিতে ফেটে পড়ে। পাঞ্জাবের একদল লোক ঢাক-ঢোল বাজিয়ে সাকার গলায় একটি সোনার মালা পরিয়ে দেয়।

খাঁচা পীর সাকা সোনার মালা পরে অত্যন্ত গর্বিত মুখে বসে থাকে।

দেবদাস তার রাশান বান্ধবী আনাকে নিয়ে অকুস্থল পরিদর্শনে আসে। বিস্মিত হয়। একজন চিহ্নিত অপরাধীর ব্যাপারে মানুষের এতো আকর্ষণ। এরা কী আয়োডিনযুক্ত লবণ খেয়ে বড় হয়নি!

সৈয়দ মুজতবা আলী এসে পৌঁছেন। দেবদাসের কানের কাছে ফিসফিস করে বলেন,
--এসে কী ফেঁসে গেলুম মশাই! সাকা-সার্কাসে লোক তো ভালোই হয়েছে।

প্রফেসর অবনী মোহন দত্ত এগিয়ে আসেন। উনি জনতার উদ্দেশ্যে বলেন,

--এই সাকা আমাকে তার ব্যাডহিলসের টর্চার সেলে নিয়ে গিয়ে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে হত্যা করেছিলো।

সাকা ভেংচি কেটে বলে, খুন করেছি বেশ করেছি; খাঁচা থেকে ছাড়া পেলে আবার খুন করবো।

পিসি বর্মণ বলেন, দেখলে সাকা, আমাকে হত্যা করে ভেবেছিলে পার পেয়ে যাবে। শেষ রক্ষা তো হলোনা!

সাকা কিছুটা বিমর্ষ হয়ে যায়। নতুন চন্দ্র সিংহ এগিয়ে আসেন।

--আমাকে চিনতে পারছো সাকা। আমি যখন মন্দিরে পুজো দিচ্ছিলাম, তখন তুমি আমাকে গুলি করে মেরেছিলে।

এইসময় কিছু লোক ক্ষেপে গিয়ে খাঁচার মধ্যে পাথর ছুঁড়ে মারে। সাকা হাত দিয়ে সেগুলো ঠেকাতে গিয়ে কুঁকড়ে যায়।

আনা উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বলে,
--এই চিহ্নিত খুনীটিকে কারা সোনার মালা পরিয়েছে। বানরের গলায় এই সোনার হার কী মানায়!

সাকা হেঁচকি দিয়ে বলে ওঠে,
--আমার সোনা নিয়ে টানা-হেঁচড়া ক্যানো। দেবদাসকে বলো।

আনা ধমক দেয়, শাট আপ।

দেবুদা বলে, আপনার মুখটাতো দেখছি চলমান টয়লেট মশাই।

চুনিলাল বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, লাল বাতি এলাকার লোকের মুখের ভাষাও তো এর চেয়ে ভালো!

সাকা সার্কাসের লোক কমতে থাকে। খন্দকার মুশতাক সাকা-র কানে কানে কী যেন বলে।

সাকা বিনীত ভঙ্গিতে বলে, ভাইসব আমি আর সোনা-দানা টাইপের কোন শব্দ বলবো নাহ। আপনারা প্লিজ যাবেন না।

এমন সময় রাউজানের কিছু মানুষ এসে সাকার দিকে পচা ডিম ছুঁড়ে মারে।

সৈয়দ মুজতবা আলী বলেন, এইচ টু এসের গন্ধে টেকা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে পাবলিক টয়লেটে এসে পড়লুম। চলো আনা আমরা কেটে পড়ি।

দেবুদার সেল ফোন বেজে ওঠে। আলতাফ মাহমুদ ফোন করেছেন,
--দেবুদা স্বর্গের পুলিশে তো আপনার জানাশোনা আছে। একটু বলে দেখুন। আমরা নরক পরিদর্শনে যেতে চাই। মুজাহিদের কী পরিণতি হয়েছে একটু দেখা দরকার।
--আমি আপনাকে মিনিট দশেকের মধ্যে জানাচ্ছি আলতাফ ভাই।

দেবুদা দোজখের দায়িত্বে নিয়োজিত সহকারী পুলিশ কমিশনারকে ফোন করে,
--হ্যালো আমি দেবদাস বলছি।

--দেবুদা নতুন আমদানী মুজাহিদকে নিয়ে একটু ব্যস্ত আছি। আজ ঘন্টা দুয়েক পরে তাকে গাছে ঝুলিয়ে মাথার কাছে একটা সৌরচুল্লী জ্বালিয়ে দেয়ার ইভেন্ট আছে।

--আসলে এই মুজাহিদ একাত্তর সালে যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিলো; তারা একটু এই ইভেন্ট দেখতে চান।

--নিশ্চয়ই এটাতো উনাদের প্রাধিকার। প্লিজ কয়েকজনকে নিয়ে আসুন। আমি রিসেপশানে বলে রাখবো। আর মুজাহিদের এই পানিশমেন্ট ইভেন্ট নিয়মিত চলবে। কয়েকটা গ্রুপে উনারা সবাই এসব দেখে যেতে পারবেন।

দেবুদা চুনিদার ট্যাক্সিতে আলতাফ মাহমুদ, শহীদুল্লাহ কায়সার, সিরাজুদ্দীন হোসেনকে নিয়ে নরকের রিসেপশানে পৌঁছে যায়। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন জাহানারা ইমাম। উনি তাঁর ছেলে রুমিকে নিয়ে বেহেশত থেকে এসেছেন মুজাহিদের ইভেন্ট দেখতে।

ইভেন্ট শুরু হয়। মুজাহিদকে গাছে ঝোলানো হয়। এপর্যন্ত আগত অতিথিদের মুখে মুচকি হাসি ছিলো। কিন্তু মাথার কাছে সৌরচুল্লী জ্বালাতেই মুজাহিদ যে আর্তচিতকার শুরু করে; জাহানারা ইমাম বলেন,
--আপনারা দেখে আসুন। আমি রিসেপশানে বসছি।

সবাই প্রায় একসঙ্গে বলে ওঠেন,
--নাহ দেবুদা আমরা রিসেপশানে আছি; আপনি দেখে আসুন।

রুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,
--যে মানুষগুলোকে মুজাহিদ হত্যা করেছে, যে মানুষটি তার শাস্তির জন্য আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন; তারা কেউ এদৃশ্য দেখতে পারলেন না!

--রুমি ভাই এখানেই তো এই অন্ধকারের মানুষ মুজাহিদের সঙ্গে ঐ আলোর মানুষদের পার্থক্য।

পুলিশ অফিসার বলেন, যাদের জন্য ইভেন্ট আয়োজন তারাই ইভেন্ট দেখলেন না। উনাদের উপস্থিতির কথা ভেবেই মুজাহিদের মাথার কাছে সৌরচুল্লী দেয়া হয়েছে। এমনিতে আমরা খড়ির চুলা জ্বেলে দিই।

বঙ্গবন্ধু ফোন করেন দেবুদাকে।
--দেবুদা আপনি কোথায় কোথায় থাকেন! গান্ধীজী খুব অস্থির হয়ে আছেন। বেহেশত কতৃপক্ষ ফাইনাল নোটিশ পাঠিয়েছে। গোবরডাঙ্গা-শিয়ালনগর তারা গুঁড়িয়ে দিতে চায়। সে কী করে সম্ভব! উপমহাদেশের মানুষগুলো এভাবে মারা পড়বে, তাই কী হয়!

–বঙ্গবন্ধু এ তো হবারই ছিলো। এরা ভারতবর্ষে থাকতে যা যা করেছে; বেহেশতে এসেও যদি তাদের সেইসব বদ স্বভাবের পরিবর্তন না হয়; হেভেনের অন্যান্য লোকের স্বার্থে এদের মেরে ফেলা হবে। আমি একটু দোজখে এসেছিলাম। বেহেশতে ফিরেই আপনাকে রিপোর্ট করছি।

দেবুদা বাসায় ফিরে একটা সিগার ধরিয়ে ভাবতে থাকে, এই মুহূর্তে কী করা যায়!

আনা দেবুদার কাঁধে হাত রেখে বলে, তোমাকে এই সাবকন্টিনেন্টাল ভাইরাস নির্মূলে একটা কোন মেথড বের করতে হবে দেবুদা।
--কী রকম!
--দেখো ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টের সব মানুষই যে খারাপ তা তো নয়।
--সেতো অবশ্যই। গোবরডাঙ্গা-শিয়ালনগরে অধিকাংশ মানুষই ভালো; কিন্তু আয়োডিনের অভাবে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ এটা আইডেন্টিফাই করতে পারে না।
--তাহলে ভালো মানুষ-খারাপ মানুষ আলাদা করবে কীভাবে!

দেবুদা পায়চারী করে। আনা একটু রুহ আফজা এনে দেয়।
--বুদ্ধি খাটাও।
--একটু বানারসের পান খাওয়া দরকার। বন্ধ বুদ্ধির তালা তাতে যদি খুলে।
--রাশান রুহ আফজা বানারসের পানের চেয়ে কম কিছু নয় দেবুদা।

আনা হেভেন অথোরিটির কাছে ফোন করে দুটো দিন সময় নিয়ে নেয়; গোবরডাঙ্গা-শিয়ালনগর গুঁড়িয়ে দেবার আগে একটা শেষ চেষ্টা করার জন্য।

দেবুদা বলে, আনা আই গট দ্য আইডিয়া। আইডিয়ার নাম সাকা ধ্রুবক। খাঁচা পীর সাকার ভক্ত যারা; সাকা স্বভাবের যারা তাদের সরিয়ে নিলেই হয়।

--এক্সাক্টলি! বেহেশত পুলিশের কাছ থেকে সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে চেক করে নেয়া যায়।

মাত্র আধঘন্টার মধ্যে বেহেশত পুলিশ ফুটেজ দিয়ে যায়। দেবুদা বঙ্গবন্ধুকে ফোন করে ফর্মূলাটা জানায়। বঙ্গবন্ধু বলেন, কিন্তু গান্ধীজী বলছিলেন সমন্বয়ী অহিংস কোন সমাধান পাওয়া যায় কীনা! দেখা যাক সাকা ভাইরাসে আক্রান্ত লোকের সংখ্যাটা কেমন দাঁড়ায়!

--বঙ্গবন্ধু হেভেন কতৃপক্ষ তো পুরো গোবরডাঙ্গা-শিয়ালনগর গুঁড়িয়ে দিতে চায়। এরচেয়ে কি এই সমাধানটি কী ভালো নয়।

--আসলে সারাজীবন মানুষের ওপর আস্থা হারাইনি; তাই আস্থা হারাতে কষ্ট হয়। দেখা যাক!

সাকার খাঁচার সামনে ফুটেজে দেখা যায় এক লোক এসে বলছে, শেখ মুজিব হিন্দুদের দালাল।

সাকা বলে, এই জন্যে হয়তো পাইপ মুখে নিয়া ধোয়ার আরতি দেয়।

আরেক লোক চিৎকার করে বলছে, গান্ধী মুসলমানদের দালাল।

সাকা টন্টিং করে বলে, কে জানে সে হয়তো মুসলমান। নাইলে সারাক্ষণ হজ্জ্বের ড্রেস পইরা ঘুরে ক্যান!

এক লোক এসে সাকাকে বলে, শিয়ালনগরে আবার ধর্ষণের অভিযোগ এসেছে। আপনার ভক্তদের বিরুদ্ধে নারীরা অভিযোগ করেছে।

--এতো অভিযোগের কী আছে; যা প্রতিহত করা যায়না তা উপভোগ করলেই হয়।

এই মন্তব্যে খুশীতে বাক বাকুম চেহারাগুলো ফুটেজে চিহ্নিত করা হয়।

বেহেশত কতৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় এই সাকা সিনড্রোমে আক্রান্ত লোকগুলোকে আবার ভারতীয় উপমহাদেশের তিনটি দেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। কারণ হাবিয়াহ দোজখের চেয়ে খারাপ কোন জায়গায় তাদের স্থানান্তর করতে হবে।

লীথি নদীর ধারে থ্যানাটস বন্দরে অনেকগুলো জাহাজ দাঁড়িয়ে। মর্ফিয়ুস বাঁশী বাজায়। সাকা ভাইরাসের রোগীদের কোমরে দড়ি বেঁধে জাহাজে তোলা হয়। মওদুদী, বালথ্যাকারে, গোলাম আজম, নাথুরাম গডসে, খন্দকার মুশতাক সবাইকে একে একে জাহাজে তোলা হয়। জামাত-আরএসএস-কাম্যবাদী দল-সাম্যবাদী দল কেউ বাদ নেই; সিসিসিভি ফুটেজে সাকা সিনড্রোমে আক্রান্ত যাদেরকেই দেখা গেছে; সবাইকেই এই বেহেশত থেকে “বহিষ্কার জাহাজে” তুলে দেয়া হচ্ছে। সাকা খাঁচার মধ্যে দাঁড়িয়েই বলে, এটা বে-আইনী; আমাকে দোজখে পাঠানো হোক; ব্যাড হিলস, রাউজান, পাঞ্জাবের ভক্তরা অপেক্ষা করছে। আমি তাদের জন্য সাকা-নাকা; সাকা-নাকা নৃত্য করবো।

জাহাজগুলো একে একে ছেড়ে যেতে থাকে। সাকার খাঁচাটা জাহাজে না তুলে ক্রেণ দিয়ে মহাবিশ্বের শূন্যতায় ছুড়ে ফেলা হয়। খাঁচাটা শনি গ্রহের পাশ দিয়ে পতিত হবার সময় সেখান থেকে গান ভেসে আসে,

সাকা নাকা সাকা নাকা দেহ দোলানাহ

বদির ভাই

হেইলা দুইলা দরবার নাচাই।

আপনার মন্তব্য