হালিম বুঝ

 প্রকাশিত: ২০১৫-১১-২৯ ২০:২৯:৪০

মাসকাওয়াথ আহসান:

বেয়াইপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হালিম ভাই অত্যন্ত বিনয়ী মানুষ। একসময় যাত্রার বিবেক ছিলো। হালিম ভাইয়ের অভিনয় দেখে গ্রামবাসী অশ্রুবন্যায় ভাসতো। তাই হালিম ভাই যখন মেম্বর হয় তখন যাত্রা্র দর্শক জলিলেরা আনন্দে অশ্রুসজল হয়ে ওঠে।

গ্রামবাসীর বিপদ আপদে ছুটে গিয়ে হালিম ভাই হাউ মাউ করে কাঁদতে পারে। তাই তার কান্দনের ভক্ত হয়ে পড়ে জলিলকূল। যাত্রার বিবেক থেকে বেয়াইপুরের বিবেক হয়ে ওঠে হালিম ভাই।

ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বর সলিম ভাই এক বৈঠকে জানায়, আমার বেয়াইটার কাজে-কামে খুব অসুবিধা হচ্ছে। চৌকিদার দিয়া কাউরে সে গ্রেফতার কইরা নিয়া আসলেই; বেয়াইপুরের লোকজন কী এক মুবাইল ফোন পাইছে; তা দিয়া সবাইরে জানায়। অমনি লোকজন জড়ো হইয়া যায়। বেয়াইয়ের আমার নিজ এলাকায় প্রভাব ধইরা রাখতে ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে।

বৈঠকে চৌকিদারদের প্রধান দুল দুল মিয়া বলে, এই ভাবে কাম হইবো না মেম্বর সাব । ঐ মুবাইল ফুনডাই দাজ্জাল। চৌকিদাররা কোথাও গিয়া একটু চা-মিষ্টি ফ্রিতে খাইলেও লোকজন মুবাইলে ছবি তুইলা আমগো ইমেজের ভীষণ ক্ষতি করে।

আরেক মেম্বর গদি মিয়া ফিস ফিস করে বলে, একটু বাবা জর্দার ব্যবসা করি; ভিতরে ইট্টু আফিম দিয়া দিই; হেই খবরডা মুবাইল ফুনে ছড়ায় দিয়া বেয়াইপুর বাসী আমার বাবা ব্যবসা লাটে তুলছে।

মহিলা মেম্বর গডজিলাতুন্নেসা বলে, বেয়াইপুরের লোকজন বেশী শিক্ষিত হইয়া পড়ছে; সুশীল কুনহানকার! খালি প্রতিবাদ। আরে বাবা চৌকিদার যদি কোন মাইয়ার তুলের মুঠি ধইরা ঘুরাইয়া দেয়, হেইডার ছবি তুইলা মুবাইলে ছড়াইয়া দেওনের কী আছে!

মেম্বর হনু ভাই আর্তনাদ করে ওঠে, বেয়াইপুরের ইতিহাসে এমন সুসময় আর আসে নাই; সুখে থাকলে ভূতে কিলায় এগো। এই গ্রামে মুবাইল ফোন বন্ধ রাখাই শ্রেয়।

প্রস্তাবটা চৌকিদার দুলদুলের খুব মনে ধরে। সে বলে, ফোন বন্ধ কইরা দিলে এই গ্রামে চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি-খুনাখুনি সব বন্ধ হইয়া যাইবো। চৌকিদাররা হাতে জবা ফুল নিয়া দাঁড়াইয়া থাকবো। তাগো আর বন্দুক নিয়া ঘুরার দরকার হবে না।

সলিম মেম্বর বলে, কিন্তু মোবাইল বন্ধ করার ব্যাপারটা গ্রামবাসী যদি না বুঝতে চায়!

বেয়াই মেম্বর বলে, আমি বিশিষ্ট শান্তিকারের পোলা; মোবাইল ফোনে সবাই গুজব ছড়ায় আমি নাকি অশান্তিকার। আমার পরিবার সারাজীবন এতো শান্তির আতর ছড়াইলো; এরা তার সুবাস পাইলো না।

গডজিলাতুন্নেসা বলে, সুশীলগো নাক সারা বছর বন্ধ থাকে। আর এরা সব গ্রামদ্রোহী। ধইরা সব জেলে ভইরা দ্যান।

মেম্বর হনু ভাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আমার শুকনা কথায় চিঁড়া তো আর ভিজে না। সলিম ভাই আপনার সলিম বুঝ দিয়া গ্রামবাসীকে বোঝান।

বেয়াই মেম্বর বলে, যুগের হাওয়া বদলাইছে। এখন সলিম বুঝ দিয়া হবে না। এখন দরকার হালিম বুঝ। যে যাত্রা্র বিবেক হিসাবে গ্রামের মানুষরে অভিনয় কইরা কান্দায়ে দিতো; সেইতো কাইন্দা কাইন্দা ভালো বুঝাইতে পারবে। আফটার অল সে তো বিবেক।

চৌকিদার দুলদুল মনে করিয়ে দেয়, আগে অপারেটর দিয়া মোবাইল ফোন বন্ধ কইরা দেন, তারপর বোঝানোর ব্যাপারটা আসবে।

মেম্বর দীপু প্রতিবাদ জানায়, কী বলেন! গ্রামের তরুণরা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অনেক সেবামূলক কাজ করে, অনিয়মের কথা জানায়, তাদের ছোট ছোট ব্যবসা উদ্যোগও চলে এই ফোনের সুবিধা নিয়ে। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির আশা দিয়েই তো আমরা ভোটে জিতেছিলাম।

কেউ তার কথাকে গুরুত্ব দেয়না। হনু ভাই বিরক্ত হয়। ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর হয়ে দীপু লোকটা মেম্বরদের স্বার্থ না দেখে গ্রামবাসীর পক্ষে কথা বলে। উনি খুব আসছেন একজন জনদরদী।

শেষ পর্যন্ত শান্তিকার বেয়াই একটা ফর্মূলা দেয়। ব্যাপারটারে একটা পলিটিক্যাল কালার দেয়া দরকার। এর আগে এক খুনীর বিচারের সময় গ্রামের কিছু লোক গুজব ছড়িয়ে পরিবেশ অশান্ত করেছে। আরো দুইজন খুনীর শাস্তির উপলক্ষটাকে কাজে লাগানো যায়।

দীপু বলে, সে গুজব তো ছড়ানো হয়েছিলো মসজিদের মাইকে। মোবাইলে তো সে গুজব ছড়ানো হয়নি। মোবাইলে একবারই একটি গুজব ছড়িয়ে বৌদ্ধদের বাড়ীতে আগুণ দেয়া হয়েছিলো। দুটো ভিন্ন ঘটনা।

সলিম বলে, আপনে খুব বেশী বুঝতে শুরু করছেন। গুরুজনদের সঙ্গে তর্ক করতে নাই। শোনেন মসজিদের মাইকের ‘অনুভূতি’ আছে। ঐটাতো আর বন্ধ করা যায়না। মোবাইল ফোনের তো কোন সেন্টিমেন্ট নাই; ঐটা বন্ধ করলে কোন অসুবিধা নাই।

চৌকিদার দুলদুল বলে, তাইলে বিসমিল্লাহ বলে মোবাইল ফুন বন্ধ কইরা দ্যান।

বেয়াই মুচকি হাসে। যাক এবার শান্তিকার হিসেবে আরো অনেক শান্তি প্রতিষ্ঠিত করা যাবে বেয়াইপুরে।

বন্ধ হয়ে যায় মোবাইল ফোন। দুটি নরভোজী খুনীর ফাঁসি হয়ে যায়। গ্রামের পরিস্থিতি শান্ত থাকে। হালিম ভাইয়ার ভক্ত জলিলেরা অশ্রুসিক্ত হয়। কী যাদু কী যাদু দেখাইলো হালিম ভাইয়া।

চৌকিদার দুলদুল সর্বশক্তি নিয়োগ করে গোটা গ্রামে পাহারা বসিয়ে ব্যাপারটা সম্ভব করে। সে চৌকিদারদের অনুপ্রাণিত করে, যদি প্রতিষ্ঠিত করা যায়; মোবাইল ফোনটাই যত অপরাধের গোড়া; ঐটা বন্ধ থাকবে। তোমরা অনির্দিষ্ট কালের জন্য চা-মিষ্টি খাইতে পারবে। কেউ ছবি তুইলা ছড়াইয়া দিতে পারবে না।

গ্রামের তরুণেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ইউনিয়ন পরিষদের কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসুচীর পেট চালানো জলিলেরা ছাড়া বাকী সবাই অসন্তুষ্ট।

--ভোট নিলা মোবাইল ফোনের সুবিধা দিবা বইলা; অহন ধুন ফুন বুঝাইয়া দিলা ফুন বন্ধ কইরা।

এবার মাঠে নামে হালিম ভাই। সে হালিম বুঝ দিয়ে আবেগী চিঠি লেখে গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে। সেটা কাবিখা জলিলেরা বিতরণ করে।
প্রিয় গ্রামবাসী,
আমি মেম্বর হিসেবে নয়, অভাজন হিসেবে বিবেকের তাড়নায় এ চিঠি লিখছি। আমি মানুষকে বাঁচানোর জন্য মোবাইল ফোন বন্ধ করার অপরাধ করেছি। সে অপরাধের জন্য; আপনারা আমাকে একটি শিশুর প্রাণ বাঁচানোর জন্য যা খুশী শাস্তি দিন। মোবাইল বন্ধ আছে জন্য আজ মাতার কোলে শিশুরা হাসছে। মোবাইল ফোন ব্যবহার করে একজন খুনীর বিচারের রায়ের সময় গুজব ছড়িয়েছিলো গ্রামদ্রোহীরা। তাতে প্রাণহানি ঘটেছিলো। মোবাইল ফোন বন্ধ করে যদি প্রাণ বাঁচানো যায়, আমরা তো কবুতর যাহ যাহ যাহ’র যুগে ফিরে যেতে পারি। চিঠি লিখুন, কবুতরের পায়ে বেঁধে দিন। তবুও শিশুটি পিতার কোলে হাসুক।
ইতি
আপনাদের ভালোবাসা ধন্য
হালিম ভাইয়া

হালিম ভাইয়ার বিনয়ের গ্লিসারিন মাখানো চিঠি পড়ে অনেক মানুষই চিঠিতে অশ্রু মোছে।

মোবাইল ফোন বন্ধ থাকাকালে বেয়াইপুরে হিন্দু-বৌদ্ধ পরিষদের নেতাকে কোপানো হয়। কেউই জানতে পারে না। হাসপাতালে শুয়ে উপায়হীন মানুষটি কাঁদে। তার স্ত্রী হালিম বুঝের চিঠিটি এগিয়ে দেয় সে কান্নার অশ্রু মুছতে।

মোবাইল ফোন বন্ধ থাকার সময় গ্রামের এক মসজিদে ইমাম খুন হয়ে যায়। প্রতিবেশীরা সলিম বুঝের চিঠি এগিয়ে দেয় শোক সন্তপ্ত পরিবারের অশ্রু মুছতে।

গ্রামের এক সমবায় সমিতি যেটিকে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে ফান্ডিং-এর অভিযোগে ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে আনতে বলা হয়েছিলো, মোবাইল ফোন বন্ধ থাকা কালে সেই সমিতির শেয়ার পছন্দের জলিলদের বিলিয়ে দেয়া হয়। লুটপাট চলতে থাকে পাগলা হাওয়ার শীত শীত রাতে। গ্রামের মানুষের প্রতিবাদ জানানোর মাধ্যম মোবাইল ফোন বন্ধ। ফলে সবাই হালিম বুঝের চিঠিতে বেদনার অশ্রু মোছে।

বিশিষ্ট খুনী “বেয়াই দ্য লিটল” বিশিষ্ট শান্তিকার পুত্র মেম্বর বেয়াই এর সঙ্গে দেখা করতে এসে সহাস্যে জড়িয়ে ধরে,

--ম্যাজিক ভাইজান; এতো ম্যাজিক। তাইলে আমার বিচারের ঝামেলাটা আর আসতেছে না। ঐ মোবাইল ফোনটাই ঝামেলাটা করছিলো; আমার সমস্ত অপকীর্তির কথা সবাই জেনে ফেলছিলো; ঐটা থামলো।

--এতো চিন্তা করেন কেন। বেয়াই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ আছে না। বেয়াই মানেই “সাত খুন মাফ”

--আমি অবশ্য অনেক বেশী খুন করেছি।

--অতীতকে ভুলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। বেয়াই হওয়া মানেই রিকনসিলিয়েশানের বাতাসা খাওয়া।

আনন্দে অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে বেয়াই প্রিন্স দ্য লিটল।

হালিম বুঝের চিঠিখানা মেম্বর বেয়াই এগিয়ে দেয়, নিন চোখ মুছে নিন বেয়াই।

 

(সাহিত্যের চরিত্রগুলো লেখকের মৌলিক চিন্তাপ্রসূত। জীবিত,মৃত কারও সঙ্গে মিলে যাওয়া নেহায়েত কাকতাল। সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে সকল ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)

আপনার মন্তব্য