ঊনিশশো একাত্তরের মা

 প্রকাশিত: ২০১৫-১২-১৪ ০১:৩১:৩২

মাসকাওয়াথ আহসান:

ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সাদাশাড়ি পরা এক শীর্ণ বৃদ্ধা। সন্ধ্যার আকাশে টুকরো টুকরো মেঘ। গুমোট গরম।

-- কি ভাবছো দিদা?

-- কিছু নারে।

অনি লক্ষ্য করেছে দিদা মাঝে মধ্যেই অন্যমনষ্ক হয়ে যায়। তার ছানি পড়া ধূসর চোখে জল থৈ থৈ করে।

--চলো দিদা টিভি দেখবে।

--তুমি যাও, আমি আসছি।

একা একা ছিপছিপে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে। একা থাকা মানেই স্মৃতির সঙ্গে থাকা। একা থাকা মানেই স্মৃতির সাথে আড্ডা দেয়া।

ঢাকায় একটুও মন টিকছেনা। শুধু ডাক্তার দেখাতে ঢাকায় আসা। খুব ইচ্ছা করছে ফিরে যেতে।একা একা পদ্মার পাড়ে লাল ইটের একটি বাড়ি। আশপাশে সবুজ গাছপালা—সারদা পুলিশ একাডেমির তারকাঁটার বেড়া।ভোরবেলা বিউগলের শব্দ। লেফট রাইট লেফট রাইট। আর সন্ধ্যা মানেই মসজিদের আজান, চুলো জালার হিস হিস শব্দ-পদ্মার জল-হাওয়ার শোঁ শোঁ। তার মধ্যে কালো ফ্রেমের চশমা পরা অনাম্নী এক শহীদ জননী। এতোগুলো বছর সারদার পদ্মার চরে বধ্যভূমির স্মৃতি ছুয়ে ছুয়ে বেঁচে থাকা। এতো বছর মনের মধ্যে পুষে রাখা কষ্টের হা-হুতাশ।

এখনো স্পষ্ট মনে পড়ে।শিবলী ময়মনসিং কৃষি ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরলো। ছিপছিপে টিকালো নাক গভীর চোখের এক ছটফটে ছেলে। পড়াশুনায় খুব ভালো। মাকে বললো, মা যুদ্ধে যাবো। মার বুক এতটুকু কাঁপেনি—নিশ্চয়ই যাবি।

দরকার হলে পরাগ-পান্না সবাই যাবে।

মা তখন চশমা ছাড়াই নিউজ পেপার পড়তেন। পড়ে শোনাতেন পাড়া পড়শীদের।

আকাশ বাণীর খবর শুনতেন।সাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান শুনে আশায় বুক বাঁধতেন। তাঁর সন্তানেরা নিশ্চয়ই মুক্তি নিয়ে ফিরবে।

রাত ফরসা না হতেই ছেলেরা ফিরলো। মায়ের সঙ্গে একটু দেখা করতে আসা। অন্ধকার কেটে যাবার আগেই আবার ফিরে যেতে হবে। মা দ্রুত হাতে রুটি বানায়, মেয়ে ফজিকে সেমাই রাঁধতে বলে। কতোদিন পর ছেলেদের মুখে তুলে খাওয়াবে।রান্নাঘরের খড়ের চালার মধ্যে দিয়ে ধোয়া ওঠে। দারুণ সুখে মিশে যায় কুয়াশায়—মায়ের আদর মাখা এমন ভোর আর আসেনি কখনো। ফজরের আজান পড়ছে-কোকিলের ডাক,হলুদ ক্ষেত থেকে ভেসে আসা কাঁচা হলুদের গন্ধ।

আচম্বিতে সারদা থানাপাড়ার মাটির রাস্তায় জলপাই রঙের ট্যাংকের শব্দ। আল বদর ইনফরমাররা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি।

--মুকতি কৌন হ্যায়

খেঁকিয়ে ওঠে পাঞ্জাবী অফিসার—ততোক্ষণে থানাপাড়ার সমস্ত মানুষ জমা হয় পুলিশ একাডেমি মাঠে। আলাদা করে আর কাউকে চেনার উপায় নাই; অন্তরে বাইরে সবাই মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠে-শিবলী-পরাগ-পান্নার সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। ফায়ারিং স্কোয়াডে সবাইকে গুলি করা হয়। শিবলী,পরাগ,পান্না,শিবলীর বাবা, বড় বোন ফজির জীবনসঙ্গী সবাই শহীদ হন। শিবলীর চাচাতো ভাই জিন্নাতুল আলম প্রাণে বেঁচে যান দৈবক্রমে। শিবলীর বড় ভাই ফেরদৌস আলম পদ্মায় লাফিয়ে পড়ে প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু হত্যাযজ্ঞের দুঃসহ স্মৃতি তাকে ভীষণ পোড়ায়।হার্টের জটিল অপারেশানের পরে পেস মেকার নিয়ে তিনি একাত্তরের স্মৃতির সঙ্গে বসবাস করেন। আর তাদের মা –ঊনিশ শো একাত্তরের মা—যিনি সন্তান হত্যার বিচার চাইতে বধ্যভূমিতে ছুটে গিয়েছিলেন। পাঞ্জাবী অফিসারের শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে চিতকার করে বলেছিলেন, আল্লাহ তোদের বিচার করবে। দেশ একদিন মুক্ত হবেই।

সেদিন এই বাঙ্গালী মায়ের রুদ্রমূর্তি দেখে পাকিস্তানী আর্মি অফিসার ঠিকই বুঝতে পেরেছিল বাংলা মায়ের অন্তর্গত শক্তি।

সেই মা ক্রমশঃ শক্তিহীন।অন্ধকার ব্যালকনিতে একা। ক্রমশঃ অবশ হয়ে আসে তার শরীর, দৃষ্টি ঝাপসা। এখনো খবরের কাগজের খুব কাছে চোখ রেখে দেখে ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া সুমন কিংবা তাপসের মৃত্যুর খবর;মন্দির ভেঙ্গে ফেলার খবর; মায়ের গলার মধ্যে কষ্ট আটকে যায়।

আর কতো সন্তানের মৃত্যু দেখতে হবে? মা কড়ে আঙ্গুল গুণে হিসাব করতে চেষ্টা করে মৃত্যুর সংখ্যা। এক জীবনে কতো মৃত্যুর হিসাব করতে হবে? এ এক সর্বনাশা অংক।

অনি ডাকতে আসে—দিদা খাবে এসো।

কিছু খেতে ইচ্ছা করেনা।শরীর ভেঙ্গে পড়ছে। শুতে ইচ্ছে হচ্ছে। দেয়াল ধরে ধরে শোবার ঘরে এসে শুয়ে পড়ে,সংজ্ঞাহীনতার মতো কিছুক্ষণ অথচ ঘুম আসেনা। চোখ বুঁজলেই পদ্মার চরের বধ্যভূমি শিবলী-পরাগ-পান্নার লাশ। বিধবা মেয়ে ফজির অশ্রু শুকিয়ে যাওয়া ঘন নীল চোখ।

অনি এসে তার উষ্ণ আঙ্গুল দিদার কপালে রাখে—দিদা তুমি ঘুমোও, আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিই।

আপনার মন্তব্য