অপারেশান তালপট্টি

 প্রকাশিত: ২০১৫-১২-২২ ১৬:৪৪:১৬

মাসকাওয়াথ আহসান:

মায়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র বিজয়ের পর ম্যাডাম ভূগোল শিক্ষক মনিরুজ্জামান মিয়াকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন, ব্যাপারটা কী! বাংলাদেশ আর মায়ানমায়ারের মধ্যে কী কোন সাংগ্রেই বা পানি ছোড়াছুড়ি প্রতিযোগিতা হয়েছে নাকি যে বিজয়ী দল সমুদ্রের পানি পেয়েছে! বাংলাদেশ এতো পানিই বা ছুড়লো কীভাবে; হরতালের সময় অনুশীলনের কারণেই কী বাংলাদেশ পানি বেশী ছুড়তে পেরেছে! তাহলে তো আমাদের এর মধ্যে অবদান রয়েছে; আমরা ক্ষমতায় থাকতেই পানি ছুড়ে মিছিল অবরোধ বেশী ছত্র ভঙ্গ করতে হয়।

মিয়া স্যার হেসে বলেন, না ম্যাডাম সমুদ্রেও তো রাষ্ট্রীয় সীমানা থাকে সেটা পুননির্ধারিত হয়েছে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে।

আমরা সমুদ্র বিজয় করলাম না কেন?

আমরাতো ম্যাডাম হাওয়া বিজয় করেছি।

ম্যাডাম এবার ড মঈন খানকে ফোন করেন, আওয়ামী লীগ তো মায়ানমারের সঙ্গে সমুদ্র বিজয় করেছে; ভারতের সঙ্গে তো সাহস পাবে না।

মঈন খান বলেন, মামলা যখন করেছে; ফলতো ভারতের সঙ্গেও আসবে।

ম্যাডাম খুব বিরক্ত হন। আজকের জন্য এটুকু মেনে নিলে ক্ষতি কী ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ আপোষ করবে; ইচ্ছা করে মামলা হেরে যাবে। কিছুদিনের জন্য শান্তি দিলে ক্ষতি কী! lলোকটা প্রবোধ দিতেও জানেন না।

এরপর বেশ কিছু সময় চলে যায়। ম্যাডাম ব্যাপারটা ভুলে যান। ব্যস্ত হয়ে যান ‘চুপ কর বেয়াদপ কোথাকার কনসার্টে’; সময় ও সুযোগের অপেক্ষা করছেন, কখন বাজে এক এগারোটা।

হঠাত ভারতের সঙ্গে সমুদ্রবিজয়ের খবর আসে। ম্যাডাম বিমর্ষ হয়ে পড়েন। শমশের মোবিন আসেন দেখা করতে। মোবিন বলেন এটা বড় কোন ব্যাপার না। এখানে একটা ডিপ্লোম্যাটিক লুপহোল খুঁজে বের করা যাবে।

ম্যাডামের ভালো লাগে। এমন সময় চা নাশতা আসে। তালের পিঠা।

শমশের মবিন মুগ্ধ হয়ে যান। আহা কতদিন পর তালের পিঠা। ম্যাডাম রেয়ার আইটেম; কতদিন তালের পিঠা খাইনা।

ম্যাডাম কেবল হাসেন। হঠাত তার তালপট্টির কথা মনে পড়ে।

শমশের সাহেব, তালপট্টি কে পেলো বাংলাদেশ না ভারত!

ম্যাডাম ভারত পেয়েছে। দিয়ে দিল আওয়ামী লীগ। এই আইল্যান্ডস আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা কীভাবে নতজানু হতে হতে মাটিতে শুয়ে পড়লাম।

শমশের সাহেব এটাইতো সবচেয়ে বড় লুপহোল সমুদ্র বিজয়ের।

ম্যাডাম তাহলে আর দেরী করি কেন। আমাদের তো মিডিয়া রাখেনি বাকশালীরা। শফিক রেহমানকেই ফোন করে বলি; শুনেছি উনার পারসোনাল সার্কুলেশান ইত্তেফাকের চেয়ে বেশী।

সেটা কীরকম?

ম্যাডাম উনি একটা চলন্ত মিডিয়া। একাই একশো।

বিএনপির পক্ষ থেকে দাবী করা হয়, তালপট্টি কোথায়?

আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীরা বিছানার তলায়, সোফার চিপায়, ব্যালকনীর কোণায় তালপট্টি খুঁজে আঁতিপাতি করে। শেষে ফেসবুকে এক বিশেষজ্ঞ বলেন, তালপট্টি ডুবে গেছে সেই কবে। ওটা দেখে আওয়ামী লীগের পেশাদার বুদ্ধিজীবীরা প্রধান মন্ত্রীকে জানান তালপট্টি নাই।

প্রধানমন্ত্রী তার সাপ্তাহিক পঞ্চায়েতী রগড়ে বিএনপিকে বলেন, খোঁজেন; আপনারাই খুঁজে দেখেন তালপট্টি কোথায়?

বিএনপির নেতারা জেলখানার সেলে, বাগানে নিজেদের পকেটে সব জায়গায় তন্ন করে খোঁজে।

শামসুজ্জামান দুদু ম্যাডামকে ফোন করেন, ম্যাডাম তালপট্টি নিশ্চয়ই আছে। এতো আর সাঈদীকে চাঁদে দেখার মতো ঘটনা নয় যে আমরা রটিয়েছি। অনেক নির্দলীয় নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকার হবার মতো লোকও বলছে, তালপট্টি আছে। আমরা দরকার হয় সমুদ্র অভিযানে যাবো। খুঁজে বের করে দেখিয়ে দেবো তালপট্টি আছে।

গুলশান কার্যালয়ে সমুদ্র অভিযানের কন্ট্রোল রুম স্থাপিত হয়। মঈন খান, শমশের মবিন, শফিক রেহমান, দুদু সবাই গম্ভীর মুখে বসে। এক আইটি গিক পাওয়ার পয়েন্ট প্রেসেন্টেশান করছে। তাকে লন্ডন থেকে সেনাপতি তারেক পাঠিয়েছেন। গুগুল ম্যাপ জুম ইন আউট করে কিছুক্ষণের মাঝে মাথা ধরিয়ে দেয়।

মীর্জা ফখরুল ঢুকেই বলেন, এই স্ক্রিণে একটা উত্তম-সুচিত্রার ছবি দেখলে মন্দ হোতো না।

শফিক রেহমান বলেন, আইডিয়া! আমাদের অপারেশান তালপট্টির শ্লোগান হবে, এই পথ যদি না শেষ হয়।

মীর্জা ফখরুল বলেন, এই বয়েসে এতো বড় অভিযান। ইস তারেক চে গুয়েভরা থাকলে খুব ভালো হোতো।

শমশের টিস্যু দিয়ে চোখ মোছেন। তারেক নামটির সঙ্গে তার চোখের অশ্রুগ্রন্থির কোন সম্পর্ক তৈরী হয়েছে। শুনলেই উনার চোখে পানি আসে।

দুদু দৃপ্ত কন্ঠে বলেন, যে কোন ভাবে ক্ষমতায় যেতে হবে; দরকার হয় এ অভিযানে আমি একাই যাবো।

পাপিয়া এসেছেন। উনাকে কন্ট্রোলরুমে বসে স্যাটেলাইট ফোনে কথা বলে যোগাযোগ রক্ষার কাজ দেয়া হয়েছে। পাপিয়ার সুবিধা হলো, বাই চান্স স্যাটেলাইট কানেকশান কাজ না করলেও উনার গলা বঙ্গোপসাগর থেকে শোনা যাবে, সি শার্পের কন্ঠের এই এক সুবিধা।

শফিক রেহমান একটি লাল গোলাপ এগিয়ে দেন, ওয়েল কাম টু মিশন তালপট্টি টিম।

মঈন খান বলেন, ভারতের সমুদ্র পরীবীক্ষণ প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে এই ‘মুর’ আইল্যান্ডস বিলুপ্ত হয়েছে!

শমশের বিরক্ত হন, ভারত কতো কিছুই বলে!

লন্ডন থেকে আসা আই টি গিক ঘন ঘন ওয়াশরুমে যাতায়াত করছে। হঠাত ঢাকায় এসে কাচ্চি বিরিয়ানী খেয়ে এটা হয় বেশীর ভাগ পশ্চিমার।

তাকে কোন প্রশ্ন করার অবকাশ পাওয়া যাচ্ছে না। কঠিন প্রশ্ন শুনলেই সে দৌড়ে যাচ্ছে মরুদ্যানের খোঁজে।

ঠিক হলো, একটি টিম যাবে হেলিকপ্টারে; আরেকটি টিম ছোট জাহাজ নিয়ে; কিছু স্পীড বোটও থাকবে।

শমশেরের নিজেকে জেমস বন্ড মনে হতে থাকে। দুদু ভুগছেন মাসুদ রানা বাতিকে। শফিক রেহমান তো আগে থেকেই শারলক হোমস। সুতরাং বিব্রত মুখে বসে মঈন ও মীর্জা। এখানে তাদের কোন রোল নেই; একটা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি হাল।

গভীর রাতে হেলিকপ্টার উড়িয়ে অভিযাত্রীরা মংলা বন্দরে গিয়ে নামেন। হিজবুল বাহার জাহাজটি মেরামত করে রাখা আছে। জিয়ার স্মৃতিধন্য জাহাজে অপারেশান তালপট্টি শুরু করতে পেরে শমশের আবার অশ্রুসিক্ত। গয়েশর রায় নারকেল ফাটিয়ে অভিযানের শুভ সূচনা করেন। হেলিকপ্টারে যাচ্ছেন মঈন খান, মীর্জা ফখরুল আর ব্ল্যাক ওয়াটারের এক ভাড়া করা অভিযাত্রী।

জাহাজটি তালপট্টির কাছাকাছি গেলে ওপর থেকে তাদের গাইড করার কাজ হেলিকপ্টার অভিযাত্রীদের।

কন্ট্রোলরুম থেকে পাপিয়ার কন্ঠ ভেসে আসে, এই পথ যদি না শেষ হয়!

শমশের বলেন রজার দ্যাট।

দুদু বলেন, ওভার ওভার।

শফিক রেহমান বলেন, এখানে এই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট দেখে রামপালের জন্য প্রাণ কাঁদে। হায় সুন্দরবন।

গয়েশর বলেন, যদি মন কাঁদে তুমি চলে এসো।

দুদু স্মরণ করিয়ে দেন এটি অভিযান তালপট্টি; অপারেশান রামপাল নয়।

শমশের আক্ষেপ করেন, এসব উলফা, আই এস আই কানেকশানগুলো এই অভিযানে কাজে এলোনা। ব্যাক্কলগুলিতো সাঁতার জানেনা।

গয়েশর বুদ্ধি করে কয়েকজন ডুবুরী নিয়ে নিয়েছেন।

জাহাজ বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে; জ্যোতস্নার মাখামাখি শান্ত সমুদ্রে। হিজবুল বাহার সাঁই সাঁই করে পানি কেটে এগিয়ে যায়। দুদু হঠাত যেন রেলিং-এ দাঁড়ানো একটা পরিচিত ছায়া দেখেন। গোলাম ফারুক অভি। সেতো ক্যানাডায়; এখানে এলো কোত্থেকে!

এই জাহাজ ভ্রমণটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো। অভি চিৎকার করে বলে যেন সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়।

দুদু ভূতের ভয়ে দৌড়ে ভেতরে এসে দেখেন শফিক রহমান তার কন্সপিরেসী থিওরী শুরু করেছেন। এই মামলায় জিতে কার্যত বাংলাদেশ কিছুই পায়নি। ভারত একটু বাড়িয়ে দাবী করেছিল, বাংলাদেশ কমিয়ে; ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট মাঝখানে দাগ দিয়ে দিয়েছে। যা ছিল তাই আছে; এসবই পরিসংখ্যানের খেলা।

হেলিকপ্টার জাহাজের ওপরে উড়তে থাকে। উপর থেকে সার্চ লাইট ফেলে সিগন্যাল দেন ব্ল্যাক ওয়াটার অভিযাত্রী। দুদু একটা টর্চ লাইট দিয়ে উত্তর দেয়।

পাপিয়ার কণ্ঠ ভেসে আসে কন্ট্রোল রুম থেকে। ম্যাডাম আমাদের সঙ্গে জায়ান্ট স্ক্রিণে নিজে দেখছেন এই অপারেশান। অনেক গুলো সালাম ম্যাডাম সালাম ম্যাডামের ধাক্কা গিয়ে বাড়ী খায় মাস্টার কন্ট্রোল রুমের স্পীকারে।

লন্ডন থেকে স্কাইপে যোগ দিয়েছেন তারেক।

ম্যাডাম ধমক দেন, কী এক এক্সপার্ট পাঠিয়েছো; স্টমাক আপসেট নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করছে।

তারেক পিনু পিনু করে বলেন, স্টমাকের উপর তো আর কারো হাত নাই আম্মু। লন্ডনে তো এই ছেলে ওয়াশরুমেই যায়না।

শমশের মোবিন বাইনোকুলার দিয়ে দেখতে থাকেন। শফিক রেহমানের রানিং কমেন্ট্রি চলছে। আমার ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং করা গেলোনা। সব কিছু টলারেট করতে রাজী; কিন্তু এই টিভিশোটা মিস হলে হার্ট হই।

গয়েশদা বলে, ও শফিক ভাই আমাকে একদিন ইনভাইট করেন আপনার শোতে।

শফিক রেহমান চটে যান, আমি এরকম মোচ অলা লোক ডাকিনা; শুধু মেয়েরা আসে। ওরা গুছিয়ে কথা বলতে জানে।

গয়েশদা বলেন, ভগবানের কাছে প্রার্থনা, এই পরের জন্মে গয়া রাণী কোরো।

শফিক রেহমান বলেন, আমি যদি পরের জন্মে শমী রেহমান হই তখন কিন্তু অনুষ্ঠানে গয়া রাণীকে ডাকবো না। গয়েশর রায়কে ডাকবো।

দুদু এসে বলেন, বাইরে আসেন, বাইনোকুলার হাতে নেন; ম্যাডাম কিন্তু দেখছেন আপনাদের খোশ গল্প।

হঠাত হেলিকপ্টার থেকে মেসেজ আসে সামান্য দূরে একটা তালপট্টি জাতীয় কিছু দেখা যাচ্ছে।

আনন্দে হিজবুল বাহারে ঈদ নেমে আসে। ম্যাডাম কন্ট্রোলরুমে বসে হাততালি দেন।

পাপিয়ার কন্ঠ ভেসে আসে মিশন তালপট্টি একোমপ্লিশড।

মার্কিন নেভি সিল থেকে অবসর নেয়া ব্ল্যাক ওয়াটার হিটম্যান হেলিকপ্টার থেকে দড়ি বেয়ে নামে।

দেখে জনা তিনেক লোক মাথা চাপড়াচ্ছে আর কাঁদছে। স্পীড বোটে করে শমশের মবিন এসে দেখেন এ এক অভিনব আইল্যান্ডস; তাল দিয়ে সাজানো ইনস্টলেশান যেন; দুদু মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখেন এ তালশিল্পের জাদু।

সেকি লতিফ সিদ্দীকী, হাছান আর হানিফ বসে বিলাপ করে কাঁদছেন। তার মানে তারা আগেই পৌঁছে গেছেন। দুদু এগিয়ে যান, কী হয়েছে লতিফ ভাই?

আর কইয়ো না, হাছান বলছিলো সে সাগর পাড়ের ছেলে; তার ধারণা তালপট্টি নিশ্চয়ই আছে। আমরা ভেবেছিলাম কেউ কিছু জানার আগেই তালপট্টির মাটি কেটে ট্রলারে করে নিয়ে যাবো। এসে দেখি এ অন্য ঘটনা।

কী ঘটনা ভাইয়া?

আরে ভাই বলিউডের ‘তাল সে তাল মিলা’ ফিল্মের শুটিং-এর জন্য ওরা তাল দিয়ে সেট বানিয়ে ফিল্মের শুটিং করে গেছে; প্রত্যক্ষদর্শী জেলেরা জানালো একটু আগে। হাছানকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গেন পড়ে দুদু।

শমশের মবিন উদাস চোখে দূরবর্তী সীমাহীন সমুদ্রের দিকে তাকান।

মাস্টার কন্ট্রোল রুম থেকে পাপিয়ার কন্ঠ ভেসে আসে; কনগ্রাচুলেশানস স্যার।

শমশের কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, এই পথ যদি না শেষ হয়।

আপনার মন্তব্য