ফ্রিজভী ফিউশান

 প্রকাশিত: ২০১৬-০১-৩০ ১৩:৫৪:০১

মাসকাওয়াথ আহসান:

ফ্রিজভীর যখন দশ বছর বয়স তখন একদিন তার দাদী গল্পে গল্পে বলেন ফ্রিজভীর জন্মের সময় অফিসের গুরুতর কাজে আটকে যাওয়ায় ফ্রিজভীর আব্বা উপস্থিত থাকতে পারেননি। একথা শুনেই ফ্রিজভী ক্ষুব্ধ হয়। আব্বাকে আর আব্বা বলতে ইচ্ছা করে না। নেহাত হাত খরচ নেবার জন্য তার শরণাপন্ন হতে হয়।

ফ্রিজভীকে রাজশাহীতে স্কুলে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত হয়। কারণ তাকে এলাকায় রাখা যাচ্ছে না। সে জনে জনে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনার জন্মের সময় আপনার আব্বা কী উপস্থিত ছিলেন! এরকম আচমকা প্রশ্নে অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়। অনেকে তেড়ে মারতে আসে। তাই তাকে এলাকা থেকে সরিয়ে দেয়াই নিরাপদ মনে হয় পরিবারের সদস্যদের কাছে।

রেলস্টেশানে পৌঁছেই ফ্রিজভী তার আব্বাকে জিজ্ঞেস করে, এই স্টেশনের পিতা কে!
--স্টেশান মাস্টার।
ফ্রিজভী ঘুরতে গিয়ে দেখে স্টেশান মাস্টার নেই। টিকেট কাউন্টারের লোকটা জানায় স্টেশান মাস্টার পাশেই রেল কোয়ার্টারে গেছেন। ফ্রিজভী খুঁজে খুঁজে চলে যায় স্টেশান মাস্টারের বাংলোয়। দরজা নক করতেই স্টেশান মাস্টার এসে দাঁড়ান। ফ্রিজভী রাগত স্বরে বলে, আপনি স্টেশানের পিতা; অথচ স্টেশান ফেলে বাসায় বসে আছেন কেন!
--চব্বিশ ঘন্টার চাকরী করি বাবা। একটু খেতে এসেছিলাম।
--কাজটা ঠিক করেননি স্টেশান পিতা!

স্টেশান মাস্টার হতভম্ব হয়ে যান। ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ পরে টিকেট চেকার আসেন। ফ্রিজভী তাকে জিজ্ঞেস করে,
--এই ট্রেনের পিতা কে!
কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে টিকেট চেকার বলেন, ট্রেনের পিতা তো জেমস ওয়াট। তিনিই প্রথম বাষ্পীয় ইঞ্জিন উদ্ভাবন করেছিলেন।
--তিনি এখানে উপস্থিত নাই কেন! জেমস ওয়াটকে আপনি কিছুতেই ট্রেনের পিতা দাবী করতে পারেন না।
ফ্রিজভীর আব্বা তার মুখ চেপে ধরে। টিকেট চেকারের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন।

লোকনাথ স্কুলে প্রধান শিক্ষক বলেন, নাম কী তোমার?
--ফ্রিজভী আহমেদ।
--পিতার নাম।
--বলতে ইচ্ছা করে না স্যার।
--কেনো!
--আমার জন্মের সময় উনি উপস্থিত ছিলেন না।

ফ্রিজভীর বাবা হেডমাস্টারকে বুঝিয়ে বলেন, দূরে পোস্টিং হওয়ায় আর গুরুতর দাপ্তরিক কাজে আটকে যাওয়ায় উনার আসতে কয়েকদিন দেরী হয়েছিলো।
ফ্রিজভী তাচ্ছিল্যভরে প্রধান শিক্ষককে জিজ্ঞেস করে, স্যার স্কুলের নাম রেখেছেন লোকনাথ হাইস্কুল; তা কোথায় আপনার লোকনাথ বাবু! এই স্কুলের পিতাও দেখছি আমার পিতার মত।

ফ্রিজভী বন্ধুদের জন্য এক চলন্ত যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়ায়। অলকা সিনেমায় ফিল্ম দেখতে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, অলকা কোথায়! লক্ষীপুরে ঘুরতে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, লক্ষী কোথায়! হেতম খাঁ মোড়ে বসে চা-সিঙ্গাড়া খেতে খেতে জিজ্ঞেস করে, কোথায় হেতম খাঁ। বরেন্দ্র মিউজিয়ামে ঘুরতে গিয়ে কিউরেটরকে জিজ্ঞেস করে, বলতে পারেন এই মিউজিয়ামের পিতা কে! তিনি কোথায়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর ফ্রিজভী একজন অধ্যাপককে জিজ্ঞেস করে, স্যার নাম দিয়েছেন রবীন্দ্র কলাভবন; অথচ রবীন্দ্রনাথকে একদিনও দেখলাম না এখানে। পিতা বটে। উপস্থিতি নেই; শুধু নাম আছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গ্রন্থমেলায় হাসান আজিজুল হকের এক গ্রন্থ হাতে নিয়ে ফ্রিজভী বলে, এই বইয়ের পিতা কোথায়! বই আছে; পিতা নেই; বই কিনবো কেন!

এরমধ্যে এক সেনাশাসক রাজশাহীতে আসেন ছাত্রদের নিয়ে খাল কাটতে। ফ্রিজভী খুব খুশী হয়। এই প্রথম খালের পিতা নিজের হাতে খাল কাটবেন। পরম সৌভাগ্যের বিষয়। প্রায় নালার মতো এক সরু সলিম বুঝ দেয়া খাল কাটা আসরে ফ্রিজভী খালের পিতাকে গভীর শ্রদ্ধা জানায়। ফ্রিজভী জনপ্রিয় ছাত্রনেতা হয়ে পড়ে। কিন্তু তার চেহারার মাঝে অস্বস্তির একটি অভিব্যক্তি স্থায়ী হয়ে যায়। সুখে-দুঃখে একই অভিব্যক্তি। একটা নার্ভাসনেস সারাক্ষণ কাজ করে। তবে তার অনুসন্ধিতসু মন থেমে থাকে না।

ফ্রিজভী ঢাকায় গিয়ে নতুন গবেষণা শুরু করে। জাতীয় সংসদ ভবন দেখতে গিয়ে সে তর্ক জুড়ে দেয়। এই ভবনের স্থপতি লুইকান কিছুতেই নন। উনি নিজে যেহেতু কোদাল-ডালি নিয়ে খালের পিতার মত কাজ করেননি; উনাকে জাতীয় সংসদ ভবনের স্থপতি দাবী করা অন্যায়।
অনেকেই বোঝাতে চেষ্টা করে, লুইকানের নক্সা অনুযায়ী সংসদ ভবন তৈরী হয়েছে। সেটাই আসল কাজ। এটা কম মানুষ পারে। কোদাল-ডালি নিয়ে কাজ করার মত নক্সাটা আরো বড় এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ। কিন্তু ফ্রিজভীকে বোঝাবে কার সাধ্য।

এরমধ্যে ফ্রিজভীর চীন সফরের সুযোগ জুটে যায়। প্লেনে উঠে এয়ার হোস্টেসকে জিজ্ঞেস করে, এরোপ্লেনের পিতার নাম কী!
--রাইট ভাতৃদ্বয়। অরভিল রাইট ও উইলভার রাইট।
--দূর কী যে বলেন, পিতা কখনো দুজন হয় নাকি! তা তাদের একজনকেও তো দেখছি না।
এ যাত্রী ভীষণ জ্বালাবে বুঝে এয়ার হোস্টেস পানির মধ্যে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয়। বাকী সময়টুকু ফ্রিজভী নাক ডেকে ঘুমায়।

চীনে কম্যুনিষ্ট পার্টির এক তরুণকে জিজ্ঞেস করে, মাও সে তুং কী নিজে বিপ্লবে অংশ নিয়েছিলেন?
--উনিই তো বিপ্লবের দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
--না না শুধু নির্দেশনা দিলে হবে না। উনি কী কোন খাল কেটেছিলেন!
--না তো।
--নাহ উনি কোন ভাবেই এই বিপ্লবের পিতা নন। প্লিজ এরকম দাবী করবেন না।

ফেরার পথে সিঙ্গাপুরে ফ্রিজভী এক ইতিহাসের অধ্যাপককে জিজ্ঞেস করে, আপনারা যে এতো লী কুয়ান লী কুয়ান করেন; উনি নিজে কী কখনো সন্ত্রাসী বিরোধী অভিযানে অংশ নিয়েছেন!
অধ্যাপক বলেন, উনিই তো পুরো সিঙ্গাপুর উদয়ের রুপকার।
--শুধু রুপকার হলে চলবে না। কোদাল দিয়ে খাল কাটতে হবে।

পরে ঢাকায় ফিরে বুদ্ধিজীবী গোলাপ রেহমানকে বলেন, গোলাপ ভাই গোটা পৃথিবী তন্ন তন্ন করে খুঁজলে দেখবেন খালের পিতার মত জেনুইন পিতা আর হয়না। মাও সে তুং, লী কুয়ান যেটা পারেননি সেটা খালের পিতা পেরেছেন।
কথাটা গোলাপ রেহমানের মনে ধরে। ফ্রিজভীকে দিয়ে কাজ হবে বলে মনে হয়। তাকে বোঝায়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় শেখ মুজিব যুদ্ধে অংশ নেননি; তাঁকেও মাও সে তুং, লী কুয়ানের মতোই বিপ্লবী পিতা হিসেবে গণ্য করা হয়।
ফ্রিজভী সরলভাবে বলে, কী বলবো গোলাপ ভাই; আমার নিজের পিতা তো আমার জন্মের শুভ মূহূর্তে উপস্থিতই ছিলেন না। তো প্রসঙ্গটা আপনি তোলেন না কেন!
--আমি তো আপনার মতো এ বিষয়টি নিয়ে এতো গবেষণা করিনি। বিষয়টা আপনিই তুলতে পারেন।

বেশ কিছু টিভি ক্যামেরা আর মাইক্রোফোনের সামনে প্রবল জোশে ফ্রিজভী প্রশ্নটা তুলেই ফেলে!
ফ্রিজভীর নিজের এলাকার লোকেরা বিরক্ত হয়ে বলে, ছইলডা ছোট বেলা থেকেই “পিতা কেন ছিলোনা” ভাঙ্গা রেকর্ড বাজিয়ে যাছে; নিজের পিতা ছেড়ে সে যে এবার জাতির পিতার দিকে আগাবে; এইড্যা বুঝতে পারিনি। ওখে হেমায়েতপুরে থুয়ে আসলেই পারে!

ফ্রিজভী বিরাট একটা কিছু করে ফেলেছে এমন খুশী খুশী মনে বাড়ী ফিরতেই তার ওয়াইফ বলেন, বুড়া বয়েসে ভীমরতি হলো নাকি তোমার! ভাট বকা তোমার বরাবরের বদ-অভ্যাস। কিন্তু এইটা খুব বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো।
ছেলে বলে, বাবা আমার জন্মের সময়ও তো তুমি জেলে ছিলে! তাই বলে তুমি কী আমার বাবা নও! ইউ শুড সি আ শ্রিংক।
মিসেস ফ্রিজভী বলেন, তুমি একজন মানসিক ডাক্তারের এপয়েনমেন্ট নাও। তোমার বাবাকে জোর করে নিয়ে যেতে হবে।

এমন সময় লন্ডন থেকে ফোন আসে, ওয়েলডান ফ্রিজভী সাহেব। গয়া বাবু হিট করেছে মুক্তিযুদ্ধের শহীদের সংখ্যায় আর আপনি হিট করেছেন ফাদার অফ নেশানের যথার্থতায়। দারুণ এটাক হয়েছে।
--এদিকে আমিও যে এটাকের স্বীকার; আমাকে এরা জোর করে পাগল বানাতে চায়। এমনিতেই পার্টি অফিসে রাতের পর রাত ভয়ে ভয়ে কাটিয়ে আমার প্যারানয়া হয়েছে; ডাক্তার যদি ধরে ফেলে!

পরদিন অনেকটা জোর করেই ফ্রিজভীকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।

ডাক্তার কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তাকে ফ্রিজভী জিজ্ঞেস করে, আপনার জন্মের শুভক্ষণে আপনার আব্বা কী উপস্থিত ছিলেন!

ডাক্তার খুব ধীর স্থিরভাবে উত্তর দেন, আমার আব্বা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। মাকে বলে গিয়েছিলেন, যুদ্ধ জিতে এসে নবজাত সন্তানের মুখ দেখবেন। উনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। তাই আর আমাদের দেখা হয়নি।

আপনার মন্তব্য