বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, দ্বিতীয় পর্ব ১৬-১৭

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-১৩ ১২:১৬:৪৪

কাজী মাহবুব হাসান:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]
১৬
তেরেজা তিনটি স্বপ্ন ধারাবাহিকভাবে দেখতো: যার প্রথমটা ছিল, হঠাৎ করে ক্ষেপে হয়ে যাওয়া একটি বিড়াল, যা তার জীবনে পাওয়া সব কষ্টগুলোর প্রতিনিধিত্ব করছে; দ্বিতীয়টি, তার মৃত্যুদণ্ডের দৃশ্য, যা অসংখ্য রূপে ফিরে আসতো তার কাছে; তৃতীয়, তার মৃত্যু পরবর্তী জীবন, যখন তার অপমান অসীম চিরন্তন একটি রূপ পায়।

অর্থ অনুধাবন করার জন্য স্বপ্নগুলো আসলেই কোনোকিছু অবশিষ্ট রাখে না। টমাসের প্রতি এদের অভিযোগ এত স্পষ্ট যে, তার একটি মাত্র প্রতিক্রিয়া ছিল মাথা ঝুঁকিয়ে নিশ্চুপ হয়ে তেরেজার হাতে মৃদু টোকা দিয়ে সমবেদনা জানানো।

স্বপ্নগুলো ছিল খুবই বাঙময়, কিন্তু তারা সুন্দরও বটে। এই বিষয়টা মনে হয় তার স্বপ্ন তত্ত্বে ফ্রয়েড ধরতে পারেননি। স্বপ্ন দেখা শুধুমাত্র যোগাযোগ (বা সাংকেতিক যোগাযোগ, আপনি যদি বলেন) করার একটি ক্রিয়াই শুধু নয়; এটা একটি নন্দনতাত্ত্বিক কর্মকাণ্ডও বটে, কল্পনার একটি খেলা, যে খেলা শুধু খেলা হিসাবে একক ভাবেই মূল্যবান। আমাদের স্বপ্নগুলো প্রমাণ করে, কল্পনা করা - এমন কিছু নিয়ে স্বপ্ন দেখা যা কিনা এখনও ঘটেনি- মানবজাতির গভীরতম প্রয়োজনের একটি। আর এখানেই এর বিপদ। যদি স্বপ্ন সুন্দর না হয়, খুব দ্রুত তাদের ভুলে যাই আমরা। কিন্তু তেরেজা বার বার তার স্বপ্নগুলোয় ফিরে আসে, তার মনের মধ্যে বার বার সে তাদের দেখে, সেগুলোকে রূপান্তরিত করে কিংবদন্তীতে। টমাস বেঁচে থাকে তেরেজার স্বপ্নগুলোর তীব্র যন্ত্রণাদায়ক সৌন্দর্যের সম্মোহনী শক্তির অধীনে।

‘প্রিয় তেরেজা, মিষ্টি তেরেজা, তোমার কাছে কি হারাচ্ছি আমি’? ওয়াইন সেলারে মুখোমুখি বসে টমাস একদিন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘প্রতি রাতে তুমি মৃত্যুর স্বপ্ন দেখো, যেন তুমি আসলেই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চাইছো…….’।

দিনের বেলা তখন , যুক্তি এবং ইচ্ছা শক্তি তখনও ঠিক জায়গাতেই ছিল। রেড ওয়াইনের এক ফোটা তার গ্লাস বেয়ে ধীরে নীচে নেমে যায় যখন সে উত্তর দেয়, ‘ আমার কিছুই করার নেই, টমাস, ওহ, আমি বুঝি তুমি আমাকে ভালোবাসো, আমি জানি তোমার অবিশ্বস্ততাগুলোও এমন বড় কোনো ট্র্যাজেডি নয়……’।

দুই চোখ ভরা ভালোবাসা নিয়ে সে টমাসের দিকে তাকায়। কিন্তু আসন্ন রাত তাকে শঙ্কাগ্রস্থ করে তোলে, স্বপ্নই তার আতঙ্কের কারণ। তার জীবন এখন দ্বিধাবিভক্ত, রাত এবং দিন দুটোই তাকে গ্রাস করার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ব্যস্ত ।

১৭
যে কেউই, যাদের জীবনের উদ্দেশ্য ‘কিছুটা উঁচুতে’, কোনো না কোনো একদিন অবশ্যই তাদের খানিকটা মাথা ঘোরার যন্ত্রণা বা ভার্টিগো সহ্য করতেই হবে। ভার্টিগো আসলে কি? পড়ে যাবার ভয়? তাহলে আমরা কেন এটা অনুভব করি, যখন সব উঁচু অবজারভেশন টাওয়ারগুলো মজবুত বেষ্টনী দিয়ে সুরক্ষিত থাকে? না, ভার্টিগো, মানে পড়ে যাবার ভয়ের চেয়েও ভিন্ন কিছু। এটি নীচের সেই শূন্যতা থেকে উঠে থেকে আসা আওয়াজ, যা আমাদের প্ররোচিত করে, প্রলোভন দেখায়। এটি সেই গভীরে পড়ে যাবারই আকাঙ্ক্ষা, যার বিরুদ্ধে ভীত সন্ত্রস্ত আমরা আত্মরক্ষা করি।

তেরেজার স্বপ্নে নগ্ন রমণীরা, যারা সুইমিং পুলের চারপাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছিল, বা শব-বহনকারী গাড়ীতে সেই মৃতদেহগুলো যারা আনন্দ করছিল, কারণ সেও তাদের মত মৃত- এই সবের অবস্থান ‘গভীর নীচে’, যা সে ভয় করেছে সবসময় এবং একবার পালিয়েছিল এদের কাছ থেকে, কিন্তু রহস্যময়ভাবে এটি তাকে আবার হাতছানি দিয়ে ডাকে। এই সবই তার ভার্টিগো, সে খুব মিষ্টি ( প্রায় আনন্দময়) একটা আহবান শুনতে পায় তার আত্মা আর নিয়তিকে পরিত্যাগ করার জন্য। আত্মাবিহীনদের সৌহার্দ্য তাকে আহবান করে। এবং তার দুর্বল মুহূর্তে, সেই ডাকে সাড়া দিয়ে এবং তার মায়ের কাছে ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুতও হয় । তার শরীরের উপরে আত্মার উপস্থিতি উপেক্ষা করে তার মায়ের বন্ধুদের মধ্যে কোনো একটি জায়গায় নিজেকে নামিয়ে ফেলে যখন তাদের মধ্যে কেউ একজন বায়ু ত্যাগ করবে তখন তাদের সাথে হাসতে, নগ্ন হয়ে পুলের চারপাশে মার্চ করতে ও গান গাইবার জন্যও প্রস্তুত হয়েছিল সে।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য