অবক্ষয় : সামাজিক পরিবর্তনশীলতার একটি রাজনৈতিক পরিভাষা

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-২০ ১৪:৩৭:২৭

 আপডেট: ২০১৬-০২-২০ ১৫:৪৫:২৩

শামীম সাঈদ:

সমাজ একটি নিয়ত পরিবর্তনশীল সত্ত্বা। যখনই অবক্ষয় প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়, তখন নিশ্চিতভাবেই একটি পরিবর্তনকে নির্দেশ করা হয় ও এই পরিবর্তনশীলতার প্রতি একটি দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করা হয়। এবং এটিকে নেতিবাচক পরিবর্তন বলেই চিহ্নিত করা হয়। এই সময়ে ধারণায় একটি আদর্শমানাবস্থাও (Standard State) প্রাসঙ্গিক থাকে ধারণায়িত, বিধায় কোনো পরিবর্তন সূচিত হলে এই আদর্শমানাবস্থার প্রেক্ষিতে তাকে নেতিবাচক বলে চিহ্নিত করা যায় বটে। বিপরীতমুখী ধারণায় ইতিবাচকতায় তা সমৃদ্ধিকেই নির্দেশ করতে পারে। আর যখন একটি আদর্শমানাবস্থার কথা বলা হয়, তখন একটি স্থিতিশীল (Static State) অবস্থাকেও কি স্বীকার করা হয় না? কিন্তু সামাজিক বাস্তবতায় এই আদর্শমানাবস্থাকে  (Standard State) স্বীকার করা চলে না; কেন না, পরিবর্তনশীলতাই সামাজিক বাস্তবতা। ফলে, মূলত, কখনো, কোথাও আদর্শমানাবস্থা বজায় থাকে না; যেহেতু, এটি নিয়ত পরিবর্তনশীল; তা নেতিই হোক আর ইতিবাচকই হোক। সুতরাং প্রথমত এবং চূড়ান্তভাবে এই পরিবর্তনশীলতাই স্বীকার্য। এর পরে যখন অবক্ষয়, অগ্রগতি, প্রগতি কিংবা উন্নয়ন বিষয়টি আলোচনায় আসে, তখন সেটি ঘটে এই পরিবর্তনশীলতার প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিগত কারণে। ফলত, কোনো একটি পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিকে উন্নয়ন, প্রগতি, অগ্রগতি বা অগ্রসরতা কিংবা অবক্ষয় হিসেবে চিহ্নিত করণ কখনোই চূড়ান্ত ও স্থির সিদ্ধান্ত হতে পারে না, হওয়া উচিৎ নয়।

একটি নির্দিষ্ট পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিকে কেউ অবক্ষয় হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেন, এটি তার দৃষ্টিভঙ্গিতে; কিন্তু, এই চিহ্নিত করণের বিপরীতে আরেকজন যে এটিকে ইতিবাচকতায় চিহ্নিত করবনে না তা বলা যায় না। এবং এটিই বাস্তবতা যে, একই পরিস্থিতি একই কালে, ভিন্ন ভিন্ন পাত্রে, ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হতে পারে। সুতরাং, বলা যায়, একই ঘটনার দুটি কিংবা ততোধিক বাস্তবতা থাকতে পারে। এই বাস্তবতা কে যতোখানি বলতে পারি সামাজিক বাস্তবতা ততোখানিই বলতে পারি এই সমাজস্থ ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তি সমষ্টির মন্ময় বাস্তবতাও। সুতরাং, সামাজিক বাস্তবতার এই মন্ময়তার ধারণাটিকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া চলতে পারে, কিন্তু অস্বীকার করা চলে না। বলা হয়ে থাকে, সামাজিক বাস্তবতা মন্ময়। আর কোনো একটি সামাজিক বাস্তবতার প্রতি ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক মনোভঙ্গি প্রকৃতই এই মন্ময় বাস্তবতারই প্রতিফলন। প্রশ্ন হতে পারে, কোনো একটি সামাজিক বাস্তবতার স্বরূপ আসলে কি? কোনো একটি পরিস্থিতির কোনো স্বয়ং স্বরূপ আছে কি? সম্ভবত নেই। আদতেই তা পাওয়া প্রায় অসম্ভব, কেন না, কোনো একটি পরিস্থিতি যেভাবে বর্ণিত হবে, সেই বাস্তবতা আসলে তা-ই। সুতরাং যা-কিছু ঘটে, সেই ঘটনাগুলি সকল ক্ষেত্রেই যে পুনর্নির্মিত হয়, এটিও অস্বীকার করা চলে না।

আর এই পুনর্নির্মাণের বিষয়টিই আসলে একটি পরিস্থিতি বা ঘটনার মন্ময় অবস্থা বা ঘটনার মন্ময়তা, আর প্রতিনিয়তই এই পুনর্নির্মিত বাস্তবতার দ্বারা প্রকৃত ঘটনাজাত বাস্তবতাটি প্রতিস্থাপিত হয় এবং এটিই হলো সামাজিক বাস্তবতা, প্রকৃত ঘটনাটি নয়। কেন না, প্রকৃত ঘটনাটি বর্ণিত হওয়ার পূর্বে কিংবা তা সমাজস্থ কোনো মানুষ কর্তৃক বর্ণিত হওয়ার পূর্বে সেই ঘটনা বাস্তবতার অস্তিত্ব কোথায়? সুতরাং বাস্তবতা মন্ময়তার বিষয়টি কিছুতেই নাকচ করা চলে না। আর সেই ঘটনা, বাস্তবতা কিংবা পরিস্থিতির মন্ময়তার কারণেই পরিস্থিতিটি ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক অথবা সেটি অবক্ষয় কিংবা উন্নয়ন, অগ্রগতি বা প্রগতি বলে চিহ্নিত হতে পারে। কিন্তু, এই মন্ময় বাস্তবতা রূপায়নে কিংবা বাস্তবতার পুনর্নির্মাণে  পেছনে কতো কতো সমাজসংশ্লিষ্ট, সমাজজাত, মানুষের অভিজ্ঞতারূপক বিষয় যে ক্রিয়াশীল তার ইয়ত্তা নেই। আর এই বিষয়গুলি একটি পরিস্থিতি নির্মাণের সাথে সাথে সেই পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিক ধারণায়িত সূচকও নির্মাণ করে থাকে বোধহয়, যার মানদ-ে নির্ণীত হতে পারে ঘটনার ইতিবাচকতা বা নেতিবাচকতা কিংবা এর কারণ ঐ ব্যক্তিসকলের মানসিক-সামাজিক ক্রিয়াকলাপের মধ্যে নিহিত থাকতে পারে। আলোচ্য করা যাকÑকি কি কারণে কোনো একটি পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিকে নেতিবাচকতায় ‘অবক্ষয়’ বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে, আর এর বিপরীত যুক্তিখণ্ডন ও কারণ সমূহ ইতিবাচকতাকে প্রতিষ্ঠিত করেই নেতিবাচকতার কারণসমূহকে চিহ্নিত করতে পারে।

প্রসঙ্গ হিসেবে ‘অবক্ষয়’ আলোচ্যটির সাথে সমাজতত্ত্বের নাড়ির সম্পর্ক অনুসন্ধান ও আবিষ্কারের পূর্বেই ‘অবক্ষয়’ সম্পর্কিত আরো কিছু প্রাককথা প্রাসঙ্গিক হতে পারে। বাস্তবতার স্বরূপটি আসলে কি? এই প্রশ্নটিকে অনুসরণ করেই এগুনো যেতে পারে। বাস্তবতা স্বরূপ অনুসন্ধিৎসার মধ্যে উত্তরটি পাওয়া যাবে বোধ করি। সম্ভব হলে সম্ভবতার স্বরূপটি চাক্ষুষ কিংবা ছুঁয়ে দেখে অনুধাবনে নেয়া যেতে পারে; প্রয়োজনে এর স্বরূপটিকে ধারণায়িতও করা যেতে পারে। আর ‘অবক্ষয়’ বিষয়টিকে বাস্তবতার একটি রূপ ধরে নিয়েই  এর স্বরূপটিকে অভিজ্ঞতায় নেয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। বুঝে নেয়া যেতে পারে ‘অবক্ষয়’-রূপ বাস্তবতা আমাদের বোধে ধরা দেয় কিনা কিংবা বিষয়টিকে ধারণায়িত করা যায় কিনা? এবং এর প্রেক্ষিত বিচার করা যেতে পারে। এবং এই প্রশ্নটিও উত্থাপিত হতে পারে, অবক্ষয় প্রসঙ্গটি কেন আলোচিত হয়? যারা অবক্ষয় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে তাদের আলোচনা থেকেই অবক্ষয় সম্পর্কে ধারণা পেতে চেষ্টা করা যেতে পারে। এই ধারণা থেকেই বিষয়টির একটি সংজ্ঞা প্রদান করা যেতে পারে কিংবা প্রচলিত কোনো সংজ্ঞা থেকে থাকলে তাও পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। বুঝে নেয়া যেতে পারে কি সেই মানদণ্ড বা মানসের কারণরূপক নিহিতার্থ, যার সাথে তুলনা করে কোনো পরিবর্তনশীল বাস্তবতা বা পরিস্থিতিকে ‘অবক্ষয়’ হিসেবে সনাক্ত করা যেতে পারে? এবং অবক্ষয়ও পরিমাপ যোগ্য, এরও কি মাত্রা ভেদ আছে?

সমাজ বাস্তবতার প্রেক্ষিত থেকে বিষয়টি দেখার আগে ‘অবক্ষয়’ শব্দটির ভাষাতাত্ত্বিক স্বরূপ ও এর প্রায়োগিক ক্ষেত্রটি সচেতনভাবেই দেখা দরকার মনে হয়। খুব সম্ভব ‘ক্ষয়’ শব্দটির পূর্বভাগে ‘অব’ উপসর্গ যোগেই ‘অবক্ষয়’ শব্দটি ভাষারূপ পায় ও এর অর্থ দ্যোতনা তৈরি হয় এবং এর প্রায়োগিক উপযোগিতা তৈরি হয়। ক্ষয় ও অবক্ষয় শব্দ দুটি কি সমার্থক? এ-দুটি কি একে অপরের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে এক-ই পরিস্থিতিকে জ্ঞাপন করতে পারে? প্রকৃত অবস্থা যে, শব্দ দুটির প্রয়োগ ক্ষেত্রের ভিন্নতা দৃশ্যমান হয়। শুধুমাত্র, ‘অব’ উপসর্গ যুক্ত কিংবা বিযুক্তের মাধ্যমে এর অর্থরূপ বদলে যায়। সুতরাং এখান থেকেও ‘অবক্ষয়’ শব্দটির অন্তর্গত নিহিতার্থ পাওয়া যায় যা এর প্রয়োগ ক্ষেত্র তথা প্রেক্ষিত পরিস্থিতিকে জ্ঞাপন করতে পারে। যেমনÑভূমি ক্ষয়, পাহাড় ক্ষয়ের কথা বলা হলেও ভূমি অবক্ষয় কিংবা পাহার অবক্ষয় কথাটি বলা হয় না। যদিও ক্ষয়ও  একটি পরিবর্তনশীল অবস্থা, তবে ক্ষয় প্রক্রিয়া ও অবক্ষয় প্রক্রিয়ার স্বরূপ আলাদা নিশ্চয়।

‘ক্ষয়’ নিশ্চয় একটি পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়ার নাম, যে প্রক্রিয়ায় কোনো বস্তু বাহ্যিক কিংবা অভ্যন্তরীণ শক্তির বা কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া কিংবা কোনো সংঘর্ষের ফলস্বরূপ আকারে সংকোচিত হয়ে ক্রমশ: নিঃশেষ হবার দিকে এগোয়। সুতরাং বুঝতে পারি, ক্ষয় প্রক্রিয়ায় কোনো বস্তুর আকারগত পরিবর্তন সাধিত হয়। কিন্তু অবক্ষয় বোধকরি সেরূপ কোনো প্রক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়াজাত ব্যাপার নয়। ফলত, ‘অব’ উপসর্গ যোগে ক্ষয় শব্দটি নিশ্চিতভাবেই ভিন্নার্থে বিশেষায়িত হয়। অভিধান বলে ‘অবক্ষয়’ বিষয়টি ধীর অথচ নিয়মিত ক্ষয়, লয় প্রাপ্তি ও অধোগতি বোঝায় এবং উদাহরণ হিসেবে যে বিষয়গুলি তুলে ধরে তা সমস্তই অবস্তুগত বিষয়কেই ইঙ্গিত করে, যেমন- নৈতিক অবক্ষয়, মূল্যবোধগত অবক্ষয়, সাংস্কৃতিক অবক্ষয়; আরো বহু বহু রকম উদাহরণ আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। তবে? আমাদের, সামাজিক মানুষের শুধুমাত্র ক্ষয় শব্দটি দিয়ে চলে না বোধহয়, তাই বিশেষায়িত ‘অবক্ষয়’ শব্দটির প্রয়োজন পড়ে। সমাজজৈবনিকতায় মানুষ তার যাপনের অংশ হিসেবে আরেকটি বিষয় যুক্ত করেছে, সেটি হলো সংস্কৃতি। আর সংস্কৃতির রূপটাও দ্বিবিধ: বস্তুগত ও অবস্তুগত।  

এই সংস্কৃতিই হলো সামাজিক বাস্তবতাসমূহ সংঘটনের আধার; প্রেক্ষিত বা পরিক্ষেপ, যার অনুষঙ্গ বিচারে বাস্তব পরিস্থিতিসমূহের স্বরূপ জানতে সচেষ্ট হওয়া যাবে। সুতরাং তার, মানুষের, বস্তুগত ও অবস্তুগত দ্বিবিধ জীবনানুষঙ্গের জন্য দরকার পড়েছে দ্বিধিত শব্দসমাবেশ; কেন না, দুটি আবিষ্কারে মানুষের চেতনা ও অভিজ্ঞতাজাত বোধ সুনির্দিষ্টভাবেই ভিন্নতর। যেহেতু মানুষের বস্তুগত সংস্কৃতির অংশসমূহ কোনো না কোনো বস্তু, ফলত, এগুলির বিনির্মাণের ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও আমাদের মূল্যবোধ তাড়িত বিবেচনা চলে আসতে পারে কিন্তু, ব্যবহারে এগুলো যখন ক্রমধ্বংসপ্রাপ্ত হয় তখন এটির সাথে কোনো মূল্যবোধ তাড়িত ইতি বা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত করি না। যদিও অবস্তুগত সংস্কৃতি সমূহ মানুষের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানরূপ ধারণার সমাবেশ, যা বস্তু থেকে রূপলাভ করতে পারে কিংবা মানুষের সৃজনশীলতায় প্রচলিত কোনো ধারণা থেকেই নতুন কোনো বস্তু রূপলাভ করতে পারে, বিপরীত মুখি ধারণাসঙ্গম স্বীকার্য। এই অবস্তুগত সংস্কৃতি ব্যবহার, নির্মাণ ও অবয়বরূপ দানে যে দৃষ্টিভঙ্গি রেখাপাত করে, সেগুলো অবস্তুগত সংস্কৃতিরই অনস্বীকার্য উপাদান, যেমন- মূল্যবোধ, শিক্ষা, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, নৈতিকতা, ধর্মবিশ্বাস প্রভৃতি; এবং এই উপাদানসমূহ মানুষের বিবিধ ধারণায়নে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে যা মূলত, সমাজজীবনকে পরিচালিত করে, নিয়ন্ত্রণ করে।

সেই বিধিনিষেধ, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ যখন এতোটা প্রভাব বিস্তারিত তখন, সমাজের বিভিন্ন পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির মূল্যায়ন ব্যক্তি, গোষ্ঠিগত মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতার দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে তা বলাই যায়। সুতরাং, এখানেই নিহিত আছে কোনো একটি পরিস্থিতিকে কোনো এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কেন ‘অবক্ষয়’ হিসেবে সনাক্ত করবে কিংবা এটিকে ইতিবাচকতায় দেখবে। মানুষের নান্দনিকতার বোধ, রুচির বিচারে গ্রহণ-বর্জন ও মত-অমতের ভিন্নতা বিরাজমান। বিশ্বাস-অবিশ্বাস, নৈতিকতা, শিক্ষা, প্রথা, সংস্কার; যা মূলত ব্যক্তিক ও সামষ্টিক আচরণের রূপরেখা দাঁড় করিয়ে দিতে পারে ও দেয়। এই ব্যক্তিক-সামষ্টিক আচরণের সাথে মূল্যবোধ যুক্ত হবার বিষয়টি মানুষের জন্য বিপদের, কেন না, যার সঠিক মানদ- নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব এবং ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও সমাজ-রাষ্ট্রের প্রেক্ষিতভেদে বিভিন্ন। সুতরাং এই এই বিচারে কোনো একটি রূপান্তশীল পরিস্থিতির গতিমুখকে অবক্ষয়শীল বলে সনাক্ত করা যায় কীভাবে?

সদা পরিবর্তনশীল সমাজ বাস্তবতার প্রতি যেসকল দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রেক্ষিত বা পরিক্ষেপসমূহ বিবেচনা করা হয় সেগুলির আলোচনা থেকেও কোনো পরিবর্তনশীল বাস্তবতাকে ‘অবক্ষয়’ বলে সনাক্ত করার বা না-করার জন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গিগত দিক নির্দেশনা খুঁজে পাওয়া যাবে। সুতরাং সমাজ বাস্তবতার একটি তাত্ত্বিক অনুধ্যান ও অধ্যয়নও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হতে পারে ও জরুরিও বলে বিবেচিত হতে পারে। রূপান্তরশীল সামাজিক বাস্তবতার স্বরূপ অনুধাবনে যেসকল প্রেক্ষিত বা পরিক্ষেপ সমূহ আলোচ্য হতে পারে তা হলো: ক্রিয়াবাদী পরিক্ষেপ (Functional Perspective),  সংঘাত পরিক্ষেপ (Conflict Perspective), বিনিময় পরিক্ষেপ (Exchange Perspective), আন্তঃক্রিয়াবাদী পরিক্ষেপ (Interactionalist Perspective), অবভাসতাত্ত্বিক পরিক্ষেপ (Phenomenological Perspective)  ও লোকপদ্ধতিতাত্ত্বিক পরিক্ষেপ (Ethnomethodological Perspective)।

ক্রিয়াবাদী পরিক্ষেপ সমাজস্থ প্রতিষ্ঠানসমূহের ক্রিয়া বা ভূমিকার দিকটি গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে থাকে। এবং, এই দৃষ্টিভঙ্গি স্বীকার করে যে, সামাজিক ক্রিয়াসমূহ স্বাধীনভাবে বিরাজমান; পরস্পর নির্ভরশীল ও সম্পর্কশীল সিস্টেম ও সাব-সিস্টেম সমূহের ক্রিয়াশীলতায়  সমাজ কাঠামোকে রূপায়িত করে। এই সিস্টেম ও সাব-সিস্টেমসমূহের ক্রিয়াশীলতা সমাজ ব্যবস্থার (Social System) মধ্যে একটি ভারসাম্যাবস্থা বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে এবং সামাজিক অস্থিতিশীলতা, সংঘাত ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিকে সাময়িক অসুস্থতার লক্ষণ বলে গণ্য করে। সুতরাং এই অস্থিতিশীল, সংঘাতময় ও নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতিকে সামাজিক পরিবর্তনশীলতার অনিবার্য ও অমোঘ বাস্তবতা হিসেবে না-দেখে, এটিকে ইতি-নেতিবাচক মূল্যবোধ যুক্ত করে দেখার পেছনে কি কারণসমূহ নিহিত থাকতে পারে তা অবশ্য অনুসন্ধিৎসার বিষয়। এটুকু বোধে নেয়া যায় যে, কোনো পরিস্থিতি সম্পর্কে বক্তা যখন সোচ্চার হয় ও বাস্তবতাকে ইতি-নেতি দৃষ্টিযোগে দেখে, তখন বক্তার সোচ্চারতার অভিসন্ধিটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়। কেন না, এই ক্রিয়াবাদী পরিক্ষেপটির সাথে একই সময়ে সংঘাত পরিক্ষেপটিও অস্তিত্বমান। সামাজিক রূপান্তরশীলতার সাথে অন্তঃস্রোতা হয়ে স্বার্থগত দ্বন্দ্ব ভীষণভাবেই সক্রিয় থাকে।

পরিবর্তনশীল অবস্থাকে ‘অবক্ষয়’ হিসেবে চিহ্নিত করার পিছনে যে মূল্যবোধের রঙ থাকে তাও আদর্শায়িত নয়, এবং বলা যেতেই পারে যে, এটিকে সচেতনভাবে কোনো প্রেক্ষিতালোকে স্বার্থতাড়িত হয়ে আরোপ করা হয়ে থাকতে পারে ও প্রক্ষেপিত হয়ে থাকতে পারে এবং স্বার্থগত প্রয়োজনেই বাস্তবতাটির প্রচলিত মূল্যবোধজনিত রঙ বদল করে অন্য আরেকটি মূল্যবোধের রঙ চড়ানো হতে পারে। ফলত, প্রেক্ষিতের মূল্যায়নে ও স্বরূপ  বর্ণনায় মূল্যবোধ কোনো স্থির বিষয় নয়; একটি পণ্য মোড়কের মতো কোনো একটি বাস্তব পরিস্থিতির আবরণ মাত্র যা প্রকৃত বাস্তবতাকে লুকায়িত করে কিংবা পছন্দসই বাস্তবতা নির্মাণে সচেষ্ট থাকে। সামাজিক বাস্তবতা অধ্যয়নের সংঘাত-স্বার্থবাদী এই প্রেক্ষিতটিকে অবভাসতাত্ত্বিক পরিক্ষেপ (Phenomenological Perspective) ও সমর্থন দান করে ও বিপরীতক্রমে সমর্থন লাভ করে। এই পরিক্ষেপটি আরো বিস্তৃতরূপে আলোচ্য হতে পারে।

মহামতি সমাজ-আর্থ-রাজনৈতিক তাত্ত্বিক কার্ল মার্ক্স সমাজ পরিবর্তনের যে মহামন্ত্রের কথা উল্লেখ করেন, তা এই সংঘাত পরিক্ষেপ ও বিনিময় পরিক্ষেপ ভিত্তিক পাঠ্য হতে পারে। সামাজিক পরিবর্তনটি বৈপ্লবিক হবে নাকি ধীরানুক্রমের হবে তা সমাজে ক্রিয়াশীল শ্রেণী সংঘাতের ব্যাপকতা কিংবা মাত্রাগত তারতম্যের মাধ্যমে নির্ধারিত হতে পারে। সামাজিক বাস্তবতাকে বুঝতে সমাজস্থ শ্রেণীকাঠামো, এর প্রাতিষ্ঠানিক বিন্যাস, সমাজস্থ প্রতিষ্ঠান সমূহের আন্তক্রিয়া ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সাথে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিপরীতমুখী ক্রিয়াশীলতাকে বোধে ও অনুসন্ধিৎসায় নিতে হবে। কেন না, সমাজ কাঠামোর মধ্যেই আন্তঃশ্রেণি, আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থগত দ্বন্দ্ব, সামাজিক বাস্তবতার আপেক্ষিক স্থিতি ও বিরতিহীন পরিবর্তনশীলতার মৌল কারণ বলে চিহ্নিত। এই দ্বন্দ্বের স্বরূপ অনুধাবনে উৎপাদনকাঠামোতে শ্রেণির বিন্যাসটা জানা অতীব জরুরি। সুতরাং এই শ্রেণি ও প্রতিষ্ঠানসমূহের কারা কোন পরিস্থিতিকে ‘অবক্ষয়’ বলে চিহ্নিত করছে ও এর বিপরীতমুখে কারা থাকছে এবং এর মধ্যস্থিত প্রকৃত স্বার্থটা কি, খুঁজলেই পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সাথে মূল্যবোধরঙ যুক্ত করণের কারণটি পাওয়া যাবে।

সামাজিক বাস্তবতার বিনিময় পরিক্ষেপ (Exchange Perspective)-টি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকে সচল রাখতে অস্বীকার্য ভূমিকা রাখে। বিনিময় পরিক্ষেপের মূল কথা হলো মুনাফা বা সুবিধা লাভ করা। আবার এই বিনিময় পরিক্ষেপ ও আন্তঃক্রিয়াবাদী পরিক্ষেপ বিপরীতমুখীভাবে পরস্পরকে ক্রিয়াশীল রাখে সামাজিক পরিবর্তনশীলতায়। সামাজিক বাস্তবতার বৃহৎ কাঠামোটি মূলত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আন্তঃব্যক্তিক মিথস্ক্রিয়ার নীতিমালার উপর প্রতিষ্ঠিত। সমাজ কাঠামো মূলত ব্যক্তিসকলের আন্তক্রিয়ার (Interaction)  দ্বারা কাঠামোরূপ লাভ করে, সংরক্ষিত হয় ও  পরিবর্তিত হয়। এই আন্তক্রিয়ার (Interaction) স্বরূপটি প্রকৃত পক্ষে রূপায়িত হয় আন্তঃব্যক্তিক ও আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক ও ভূমিকা পালনের দ্বারা। সুতরাং ক্রিয়াবাদী পরিক্ষেপটিও এখানে সমান যৌক্তিক। কিন্তু আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক নির্মাণে ব্যক্তি তার মনোভঙ্গি প্রয়োগ করে। মানুষ তার স্বাধীন ইচ্ছার দ্বারা পরিচালিত হয় এবং তার সৃজনশীল ভূমিকার দ্বারা ক্রিয়াশীল মানবীয় সচেতনতায় ভূমিকাশীল থাকে। সুতরাং সামাজিক বাস্তবতার মন্ময়তার দাবিটি আরো দৃঢ় করে এই পরিক্ষেপ বিবেচনা।

ফলে, অবভাসতাত্ত্বিক পরিক্ষেপ (Phenomenological Perspective)সহ অন্যান্য সকল পরিক্ষেপসমূহ সামাজিক বাস্তবতা নির্মাণে পারস্পরিক প্রভাবকরূপে ক্রিয়াশীল থাকে। অন্যতম ক্রিয়াশীল অতীব গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হলো লোকপদ্ধতিতাত্ত্বিক প্রেক্ষিত (Ethnomethodological Perspective) বা পরিক্ষেপ। এই প্রেক্ষিতটি, বাস্তবতা রূপায়নের পেছনে সামাজিক, লৌকিক মানুষের, তাদের নীতিনিয়ম, মূল্যবোধ, বিশ্বাস, সংস্কার প্রভৃতিকে তাদের আন্তক্রিয়ার চেতনা কাঠামোর উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে বলে স্বীকৃত। পূর্বেই বলেছি, চেতনা কাঠামোয় মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও সংস্কারের প্রভাব সম্ভাবনা থাকে; তা থাকে স্বতন্ত্রভাবে ক্রিয়াশীল স্বার্থচেতনার প্রেক্ষিতে, সংঘাতময় বাস্তবতায়। এইসব প্রেক্ষিত, পরিক্ষেপের আন্তক্রিয়ায় যে সামাজিক বাস্তবতা নির্মিত হয়, সেগুলোকে মূলত আর্থ-রাজনৈতিক আবরণ বা মোড়কে চিহ্নিত করতে যে প্রবণতা দেখা যায়, তা-ই প্রকৃতপক্ষে কোনো বাস্তবতার প্রতি অপ্রতিদ্বন্দ্বী দৃষ্টিভঙ্গি। সুতরাং এটিকে স্বাভাবিক সামাজিক পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির রাজনীতিকীকরণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

এটি রাজনীতিকীকরণই বটে। অর্থনীতির সকল নীতিই ক্রিয়াশীল; উৎপাদন কাঠামোর অন্তর্গত শ্রেণি বিন্যাস, শ্রেণীদ্বন্দ্ব, বিনিময় ব্যবস্থার অনিবার্যতা, মুনাফা লাভের প্রত্যাশা, পুঞ্জিভূত মুনাফার মাধ্যমে পুঁজির কলেবর বৃদ্ধি, শোষণ-নিপীড়ন, বিচ্ছিন্নতাবোধ প্রভৃতি প্রত্যয় সমূহের পেছনে ক্ষমতা লিপ্সা, ক্ষমতার দ্বন্দ্বও মুখ্যত ক্রিয়াশীল। অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্পদের মেরুকরণ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্র দখল ও ক্ষমতাকাঠামোয় কর্তৃত্ব দখল প্রক্রিয়া একটি অপরটির জন্য বিপরীতমুখীভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। সুতরাং এই দুটির একটি কিংবা দুটি ক্ষেত্রই দখলের প্রতিযোগিতায় যারা লিপ্ত তারা, প্রকৃত প্রেক্ষিত, পরিক্ষেপ থেকে উদ্ভূত বাস্তবতার প্রতি পরস্পর বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করে ও বক্তব্য দান করে, যার ফলশ্রুতি হলো পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির ‘অবক্ষয়’, ‘উন্নয়ন’, ‘অগ্রগতি’, ‘প্রাগ্রসরতা’, ‘প্রগতি’-নাম পরিচয়। স্বার্থগত প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে একটি বাস্তবতাকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে ব্যক্ত করা! প্রতিপক্ষের সুবিধাজনক অবস্থানের বিপরীতে কোনো পরিবর্তনশীলতাকে ‘অবক্ষয়’ বাচকতায় প্রতিষ্ঠা করাটা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একটি হাতিয়ার স্বরূপ ব্যবহার। এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে বৃহত্তর জনমানুষকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধ শক্তি হিসেবে পক্ষে টানা যায়। কেন না, যে সমাজ প্রেক্ষাপটে বৃহত্তর মানবগোষ্ঠী উচ্চশিক্ষিত নয়, যুক্তির দ্বারা চালিত নয়; বরং বিশ্বাস, ধর্মীয় মূল্যবোধ, নৈতিক বিচারবোধ, সামাজিক সংস্কার দ্বারা চালিত, সেখানে তাদের নাজুক অনুভূতিসমূহে নাড়া দিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে বিশেষ ক্ষমতা কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে জনশক্তি হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়া যায়।

সুতরাং ‘অবক্ষয়’ প্রসঙ্গটি আলোচনাতে আসেই একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার বিবেচনায়। যদিও প্রসঙ্গটি আসে সামাজিক পরিবর্তনশীলতার স্বরূপ ব্যক্ত করতে, কিন্তু বিশেষ বিবেচনায় এটি হলো পরিস্থিতিটিকে পুনর্নির্মাণের প্রচেষ্টা, যা দিয়ে একটি সংগঠিত প্রেশার (চাপ) সৃষ্টি করা যায়।  আর এই দলটি প্রেসারগ্রুপ (Pressure Group) হিসেবে কাজ করে। পরিবর্তনশীলতায় যে পরিক্ষেপ সমূহ অন্তর্গত শক্তি হিসেবে কাজ করে, যেমনÑঅর্থনীতি,  সংঘাত, সমাজের প্রতিষ্ঠানসমূহের আন্তক্রিয়া, আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ককাঠামো, বিনিময় প্রথা, পুঁজি ও মুনাফা, ক্ষমতা ও মানুষের সৃজনশীল সত্ত্বা- এই সকলকে চিহ্নিত না করে অবস্তুগত সংস্কৃতির একটি বিশেষ দিক- মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও ধর্মীয় বিশ্বাস প্রভৃতির প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয় ও ঘটনাটির একটি মন্ময় স্বরূপ রূপায়নের চেষ্টা করা হয়। সংস্কৃতির এই বিষয়েও পরিবর্তনের স্বাভাবিকতায় পরিবর্তনের ঢেউ লাগে, অনিবার্য। পরিবর্তনশীলতার অনেক অনেক ফলশ্রুতির মধ্যে এটিও একটি ফলশ্রুতি যার জন্য কোনো বিশেষ কর্তত্ব বা কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়, দায়ী করা উচিৎ নয়। কিন্তু, অপরাপর আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও প্রভাবকসমূহকে পাশ কাটিয়েই এই বিষয়সমূহকে আলোচনার কেন্দ্র করা হয় ও ক্ষমতাকাঠামোর কোনো একটি কর্তৃত্বের বা কর্তৃপক্ষের প্রতি অভিযোগরূপ অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয় ও পরিবর্তনশীলতার অনুঘটক হিসেবে দায়ী করা হয়। সকল কিছুকে বাদ দিয়ে যখন শুধুমাত্র মূল্যবোধ, নৈতিকতা, বিশ্বাস, সংস্কার বিষয় সমূহ আলোচিত হয় এবং পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিকে নেতিবাচকতায় ‘অবক্ষয়’ নাম-পরিচয় দেয়া হয় তখন এটিকে পরিবর্তনশীলতার রাজনীতিকীকরণ বলাই যায়।

সমাজ ব্যবস্থার (Social Syntem) মধ্যে সামাজিক গতিশীলতা (Social Dynamics) কীভাবে ক্রিয়াশীল থাকে? বলা বাহুল্য যে, সামাজিক গতিশীলতার সাথে সামাজিক পরিবর্তনশীলতার নিবিড় ও পরস্পর নির্ভরশীল আন্তঃসম্পর্ক বিদ্যমান। সামাজিক গতিশীলতা ব্যতিত সামাজিক পরিবর্তনশীলতাকে অনুধাবন করা সহজ নয় এবং অনুধাবনটি পূর্ণাঙ্গ না-হবার সম্ভাবনাই বেশি। সামাজিক গতিশীলতায় সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের আন্তক্রিয়া ও আন্তঃব্যক্তিক মিথস্ক্রিয়া ভূমিকামান থাকে। এই আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কটিই সমাজকাঠামোর সার কথা। সুতরাং এখানে, এই আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের মধ্যে একটি শৃঙ্খলা বিধান করা জরুরি। সামাজিক নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়া এই শৃঙ্খলা বিধানের কাজটি করে থাকে। ‘অবক্ষয়’ প্রসঙ্গটি আলোচিত হবার গুঢ় কারণ এখানেই নিহিত আছে বলা যেতে পারে। সামাজিক বিধিবিধান, ব্যক্তির ও গোষ্ঠীর নৈতিকাদর্শ, ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশাসন, মূল্যবোধগত নিয়মনীতি ব্যক্তি ও গোষ্ঠী আচরণকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে ও নিয়ন্ত্রণ করে।

সুতরাং এই বিষয়গুলিকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার ধারকগণ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ও প্রতিপক্ষ যারা ক্ষমতায় আসীন কর্তৃপক্ষকে দুর্বল করে ক্ষমতা দখল করতে চায় তাদেরকে দমিয়ে রাখতে, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রিত করে পক্ষে নিতে ও প্রয়োজন মতো চালিত করতে চায়। একইভাবে বিপরীতক্রমে এই সব অনুষঙ্গের প্রেক্ষিতে কোনো একটি পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিকে ‘অবক্ষয়’ নাম দিয়ে একদল স্বার্থান্বেষী মানুষ, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়, কিন্তু, ক্ষমতাকাঠামোতে ভূমিকাশীল থাকতে চায়, তারা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে এই পরিবর্তনশীলতার বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিতে চায়, দেয় ও প্রতিষ্ঠিত ক্ষমতাকে টলিয়ে দিয়ে এই শক্তিকে জনগণের শক্তি) পুঁজি করে ক্ষমতা দখল করতে চায়। যেহেতু, মূল্যবোধের নির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই, বিশ্বাসগত অনুশাসন যুক্তি তাড়িত ও চালিত নয় এবং সামাজিক বিধিবিধানগুলোও ক্ষমতাকাঠামোর গহ্বর থেকে উদগত; সুতরাং কোনো বাস্তবতাকে ‘অবক্ষয়’ নাম দিয়ে মন্ময় করে তোলার প্রচেষ্টা অনেক পক্ষ থেকেই থাকতে পারে। সামাজিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ারগুলো যখন ক্ষমতাকাঠামোর নিয়ন্ত্রকদের হাতে কিংবা ক্ষমতা দখলার্থে সচেষ্টদের হাতে চলে যায় তখন বৃহত্তর জনগোষ্ঠী শক্তির বিপক্ষ শক্তি কিংবা বিপক্ষ শক্তির বিপরীতে সংগঠিত শক্তিরূপে ব্যবহৃত হতে পারে। সুতরাং নৈতিক অবক্ষয়, মূল্যবোধের অবক্ষয় ও বিশ্বাসের অবক্ষয় বক্তব্যগুলি যে স্বার্থপ্রণোদিত তা বলাই যায়।

সমাজ পাঠে বৃহত্তর সমাজ বা বৈশ্বিক সমাজ হিসেবে পাঠ করতে গেলে থা পাওয়া যাবে না সম্ভবত। সুতরাং সীমায়িত করে পাঠ যৌক্তিক। এই সীমায়িত সমাজগণ্ডিতেও কোনো সংস্কৃতির আদর্শমান (Standard) স্বরূপ নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব, ধারণা হয়। কোনো সমাজ-সংস্কৃতি অন্য কোনো সমাজ-সংস্কৃতি থেকে কতোটা অগ্রসর তা নির্ধারণ করা সহজ নয়, কেন না, কেবল মাত্র অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত অগ্রসরতাই সাংস্কৃতিক প্রাগ্রসরতার মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয় না ও কেবল শিক্ষার উন্নতিও নয় বিচার্য নয় এই অগ্রসরতা বিচারে, কেন না, সেখানে শিক্ষাটির মানও বিচার্য হয়ে ওঠে যার জন্য একটি মানদণ্ড রিরূপণ জরুরি হয় পড়ে, কিন্তু তাও চূড়ান্ত করা যায় না, কেন না, এর সাথে আরো আরো অনেক বিষয় জড়িত হয়ে পড়ে। নৈতিক শিক্ষার মাপকাঠিও নয় চূড়ান্ত। দার্শনিক শিক্ষা ও মুক্তচিন্তার বিষয়টিও নয় সকল সমাজে সমান স্বীকৃত। সুতরাং ‘অবক্ষয়’ অভিধাটি সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কি বিবেচনায় ব্যবহৃত হতে পারে? প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাবার নয় কিছুতেই। সংস্কৃতির, বিশেষত অবস্তুগত সংস্কৃতির উপাদান সমূহÑশিক্ষা, ধর্মীয় বিশ্বাস, নৈতিকতা, মূল্যবোধ প্রভৃতি বিষয়ের পরিবর্তনশীলতার ক্ষেত্রেই ‘অবক্ষয়’ বিশেষণ বেশি ব্যবহার হতে থাকে।

এই সকল বিষয়ে যতোটা ব্যবহার হয়, আর্থ-রাজনৈতিক পরিবর্তনশীলতার ক্ষেত্রে এতোটা উচ্চকিত হয় না এই অভিধাটি। এই তারতম্যটিও একটি জিজ্ঞাসার উদ্রেক করে বটে। বেশি ব্যবহার হয় না, বিবৃতি একটি। কিন্তু, আর্থ-রাজনৈতিক পরিবর্তন অবস্তুগত সংস্কৃতির পরিবর্তনশীলতায় ভীষণ গভীরভাবে প্রভাব রাখে। এটিও একটি যুক্তি। বস্তুগত সংস্কৃতির অতীব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রযুক্তির উন্নয়নে উৎপাদনকাঠামোতে কখনো কখনো আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। কৃষি থেকে যেভাবে শিল্পসমাজে উত্তরণ হয় একটি সমাজ বাস্তবতার, সেখানে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রসরতাই কারণ। বর্তমান সময়ে বলা যেতে পারে যে, প্রযুক্তিই পুঁজি, প্রযুক্তিই পুঁজির চালিকা শক্তি ও উৎপাদনের হাতিয়ার। প্রযুক্তির অবিশ্বাস্য-প্রায় অগ্রসরতা ও এর ব্যবহারের ব্যাপকতা সমাজকাঠামোতে এনেছে আমূল পরিবর্তন। মানুষের চৈতন্য-চিন্তাকাঠামোর পরিবর্তন, মূল্যবোধের গুণগত পরিবর্তন, প্রচলিত বিশ্বাস ভেঙে বিজ্ঞান মনস্কতা ও যুক্তি তাড়নার বিশ্বাসের স্থান দখল, নৈতিক বিধিবিধান ও বোধের আপেক্ষিকতার ধারণা এখন পরিবর্তিত বাস্তবতা; এটি পরিবর্তনশীলতার স্বাভাবিকতা ও অনিবার্যতা, স্বীকার্য। এখন এটির ব্যবহার যখন সামাজিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সমূহের ভূমিকা বদলে দিয়েছে তখন প্রযুক্তির ব্যবহারগত কারণে পরিবর্তনশীলতাকে ‘অবক্ষয়’ রূপে চিহ্নিত করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।  এর কারণও অনুমেয় যে, প্রযুক্তি শক্তির বাহক ও ক্ষমতাকাঠামোর ধারক হয়ে উঠেছে এই সময়ে। এবং বিশ্বাস, মূল্যবোধ, নৈতিক বিধিনিষেধের বেড়ায় যারা সমাজের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ব্যবহার করেছে, তা এখন অনেকাংশে খর্ব হয়েছে। সুতরাং ‘অবক্ষয়’ প্রসঙ্গটি রাজনৈতিক ভাষ্য হিসেবেই আলোচনায় উঠে এসেছে, বলা যায়। এবং ‘অবক্ষয়-অবক্ষয়’ বলে সোচ্চার হওয়াটাকে একটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বলেই দাবি করা যায়।

সমাজস্থ প্রত্যেক ব্যক্তিই তার সৃজনশীল ইচ্ছার দ্বারা পরিচালিত, এটি ব্যক্তিক সত্যি। কিন্তু, দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডসমূহ, স্বার্থগত চিন্তা ব্যক্তির আন্তক্রিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেই। ফলত, মানুষ নানামাত্রিক সৃজনশীলতার কৌশল অবলম্বন করে তার স্বার্থোদ্ধারে। রাজনীতি যতোখানি ক্ষমতাকাঠামোর অধ্যয়ন, ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ ও প্রয়োগের বিজ্ঞান; মানুষের সৃজনি শুক্তি ও অভিযোজনী বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগবিজ্ঞানও কোনো অংশে কম নয় রাজনীতির আগ্রহের। ব্যক্তি স্বার্থে ‘অবক্ষয়’ প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়, যদিও এর সংঘটনা খুব সামান্যই; কিন্তু হয় দলগত স্বার্থে, সাংগঠনিক ভিত্তিতে ব্যাপকভাবে। ক্ষমতাকাঠামোর অংশ হিসেবে কিংবা অংশ হতে চেয়ে ‘অবক্ষয়’ রূপ মন্ময় বাস্তবতার কথা তুলে জনগণকে পাশে পেতে চাওয়ার যে রাজনীতি তা সংগঠনের বা সংগঠনসমূহের এই সৃজনি বুদ্ধির পরিচায়ক। সুতরাং অবভাসতাত্ত্বিক পরিক্ষেপ (Phenomenological Perspective) আবারো আলোচ্যে আসে। এই প্রেক্ষিত দিয়ে বেশ ভালোভাবে, ‘অবক্ষয়’ প্রসঙ্গটি যে একটি মন্ময় রাজনৈতিক পরিভাষা তা প্রতিষ্ঠা করা যায়। সংঘাত পরিক্ষেপও পুনঃ পুনঃ আলোচিত হবার দাবি ছাড়ে না। সমাজস্থ যে দ্বান্দ্বিক বাস্তবতা, এরও রূপগত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, হচ্ছে। ক্রিয়াবাদী পরিক্ষেপ সমাজদেহে নতুনতর বাস্তবতার উদয় ঘটিয়ে চলেছে। স্পষ্টতই সামাজিক ব্যবস্থা, উপ-ব্যবস্থা ও আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা ও ক্রিয়াশীলতায় গুণগত ও রূপগত পরিবর্তন এসেছে। সমাজের মৌলিকতম প্রতিষ্ঠান পরিবার। পরিবার প্রতিষ্ঠানটির কাঠামোগত পরিবর্তন ও কার্যগত পরিবর্তন তথা ভূমিকার আমূল পরিবর্তন বহুমূখিভাবে সমাজের অপরাপর প্রতিষ্ঠান সমূহকে প্রভাবিত করে সেগুলোর পরিবর্তনশীলতাকে ত্বরান্বিত করছে।

কিন্তু, পরিবার কাঠামোর ভাঙ্গনের পেছনে উৎপাদনকাঠামোর পরিবর্তন, প্রযুক্তিগত বিপ্লব তথা অর্থব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তনের প্রভাব ক্রিয়াশীল। সুতরাং এই পরিবর্তনশীলতার ফলে যখন পরিবার প্রতিষ্ঠানটি সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় আর ভূমিকাশীল থাকছে না তখন এর অমোঘ প্রভাব গিয়ে পড়ছে সামাজিক মূল্যবোধ কাঠামোতে, নৈতিক চেতনা কাঠামোতে; শিথিলতা আসছে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায়। সমাজ-রাষ্ট্রিক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সমূহের জন্য এই প্রেক্ষিতটিকে কার্যকারণে আনা আবশ্যক। এই পরিস্থিতিতে যারা সামাজিক নিয়ন্ত্রণের শক্তি সমূহকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাকাঠামোকে প্রভাবিত করতে চায় ও যারা ক্ষমতা কাঠামোর কর্তৃত্বে থেকে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি সমূহ যেমন- রাষ্ট্রীয় আইন, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা প্রভৃতি শক্তি সমূহকে ব্যবহার করতে চায়, তারা আর তা স্বাভাবিকতায় প্রয়োগ করতে পারছে না ও এগুলির কোনোটিকেই স্বাভাবিক ক্রিয়াশীল রাখতে পারছে না। ফলশ্রুতিতে সামাজিক শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হচ্ছে। আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থাও সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় যথার্থ ভূমিকা রাখতে পারছে না। এরূপ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ‘অবক্ষয়’ নাম দেয়া যায় কি? তা কি বিচারে, যেহেতু এটি কোনো রকম চিবারেরই ধার ধারে না, যা অনিবার্যতা? যিনি বা যারা এই পরিস্থিতিকে ‘অবক্ষয়’ বলে চিহ্নিত করবে তারও এই পরিবর্তনশীলতারই অংশ ও ভূমিকাশীল। সুতরাং কাকে দায়ী করতে চায় তারা? এই জিজ্ঞাসার উত্তরোনুসন্ধানেই আছে প্রকৃত বিষয়টি। ক্ষমতাকাঠামোকে ঘিরে পক্ষের বিপক্ষের দুটি দলই হয় এটিকে ‘অবক্ষয়’ বলে স্বীকার করছে অথবা দুটি দলই এটি নিয়ে বিশেষ ভাবিত নয় কিংবা অস্বীকার করছে। কেন না, উদ্ভূত এই পরিস্থিতি দুপক্ষের স্বার্থের জন্যই বিরূপ। সুতরাং যখনই ‘অবক্ষয়’ প্রসঙ্গটি আলোচিত হয়, সেখানে অবধারিত রাজনৈতিক প্রেক্ষিত সচল থাকে, বলতে পারা যায়।

বিনিময় পরিক্ষেপটি আলোচনায় ফিরে এলো আবারো। যে মূল্যবোধ ও নৈতিকতা, বিশ্বাস ও সংস্কৃতি নিয়ে এতো কথা, এতো রাজনীতি-মুক্তবাজার অর্থনীতিক ব্যবস্থায় হাজারো পণ্যের সাথে পণ্য তালিকায় মূল্যবোধ, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান, অনুষঙ্গ পণ্য হিসেবেই স্থান পেয়ে যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে কি ‘অবক্ষয়’ প্রসঙ্গটি আলোচনায় আসছে? বাজার ব্যবস্থা হাজারো পণ্যের মূল্য তৈরি করছে, সাথে সাথে নতুন নতুন মূল্যবোধও তৈরি করছে বাজারের পণ্য সমূহ বিকোবার উপযোগি করে। সেক্ষেত্রে প্রচলিত মূল্যবোধের অবস্থা কি দাঁড়াচ্ছে? নতুন মূল্যবোধের কাছে পূর্বপ্রচলিত মূল্যবোধগুলি অকেজো, মূল্যহীন প্রতিভাত হচ্ছে। কিন্তু এইরূপ পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে নতুন মূল্যবোধের বিপরীতে পূর্বপ্রচলিত মূল্যবোধ সমূহের কথা ভেবে আর ‘অবক্ষয়’ প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হচ্ছে না।

এর কারণ হতে পারে এই যে, বাজার যাদের হাতে নিয়ন্ত্রিত তারা ক্ষমতাকাঠামোতে সুবিধাজনক অবস্থানে, কিন্তু, যারা ক্ষমতা কাঠামোতে প্রতিদ্বন্দ্বী তারাও বাজার ব্যবস্থার সুবিধা ভোগি; ফলত, কেউ-ই ‘অবক্ষয়’ বলে আর সোচ্চার হয় না, হচ্ছে না। সুতরাং ‘অবক্ষয়’ প্রসঙ্গটিকে রাজনৈতিক পরিভাষা বলা যাবে না কেন? আর সাধারণ মানুষ সম্ভবত নিজে থেকে এসকল বিষয়ে সোচ্চার হয় না। তাদের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো ঘটে থাকতে পারে তা হলো, তারাও এখান থেকে সুবিধা ভোগ করছে কিংবা বাজার শক্তির কাছে অবদিমত, কিংবা তাদের অভ্যন্তরীণ সংহতি দুর্বলতার কারণে সংগঠিত হতে পারে না অথবা তাদের মধ্যে শ্রেণীস্বার্থ কাজ করে না, এখানে ব্যক্তি এককতায় ঘুরপাক খায়। সংহতির প্রশ্নটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ।

সামাজিক বাস্তবতার এইরূপ পরিস্থিতিতে দ্বন্দ্ব ও শ্রেণির অস্তিত্ব স্বীকার করা গেলেও মহামতি কার্ল মার্ক্স বর্ণিত শ্রেণি ও শ্রেণীসংঘাতের পথ বেয়ে পুঁজির বিলুপ্তি ও মহান সমতা ভিত্তিক সমাজ রূপায়নের আশাটি সুদূর পরাহত। জনসাধারণ স্বয়ং রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে পারছে না, ফলে এখান থেকে এই বাজার ব্যবস্থাজনিত কারণে পরিবর্তনশীলতায় সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকেও ‘অবক্ষয়’ বিষয়টি উচ্চকিত হচ্ছে না। জনসাধারণ শুধু মাত্র সংগঠিত রাজনৈতিক শক্তির (ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিও হতে পারে) অনুগত, আজ্ঞাবহ, বস্তুবৎ ব্যবহৃত হচ্ছে। এই ব্যবহৃত হবার পেছনেও একটি ব্যক্তি স্বার্থ কাজ করে বলে অনুমেয় যা তাদেরকে নিজ কিংবা সগোত্র বা আত্মশ্রেণি বোধে সংগঠিত হতে দেয় না, আর এই ব্যবস্থা করা হচ্ছে রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্য থেকেই।

জনগণ যখন ‘অবক্ষয়-অবক্ষয়’ বলে, সমাজ-জাত-ধর্ম গেলো বলে পথে নামে তখনও তা কোনো না কোনো রাজনৈতিক শক্তির প্ররোচনায়, দেখা যায়। সুতরাং সামাজিক পরিবর্তনশীলতার প্রেক্ষিতে ‘অবক্ষয়’ প্রসঙ্গটি নিছক রাজনীতির পরিভাষা হয়ে দেখা দিচ্ছে।

আপনার মন্তব্য