বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, দ্বিতীয় পর্ব ২৬-২৭

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৩-০৭ ২০:৩৮:১৭

কাজী মাহবুব হাসান:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]
২৬
কিন্তু টমাস একটানা বহু সময় কাটাতো হাসপাতালে, আর তেরেজাকে বাসায় থাকতে হত একা। অন্ততপক্ষে তেরেজার কাছে তাদের পোষা কুকুর কারেনিন থাকতো, যাকে নিয়ে বহু দূর হাটতে যেত পারতো সে। তারপর আবার বাসায় ফিরলে সে ব্যস্ত হত জার্মান এবং ফরাসী গ্রামার পড়া নিয়ে। কিন্তু বিষণ্ণতা তাকে গ্রাস করে, মনোযোগ দিতে পারে না সে। বারবার তার, মস্কো থেকে ফেরার পর দুবচেক(*) এর দেয়া ভাষণটার কথা মনে পড়ে; যদিও সে পুরোপুরি ভুলে গেছে সেই ভাষণে দুবচেক কি কি বলেছিলেন, কিন্তু সে এখনও শুনতে পায়, তার কাঁপতে থাকা গলার স্বর।

তেরেজা ভাবে, কেমন করে স্বাধীন একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, যাকে তার নিজের দেশেই ভিনদেশী সৈন্যরা গ্রেফতার করেছিল, ইউক্রেনের কোনো পর্বতমালার কোথাও তাকে চারদিন বন্দীও করে রাখা হয়, তাকে জানানো হয়, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে, ঠিক যেমন করে এর দশ বছর আগে তারা তাদের হাঙ্গেরীয় প্রতিপক্ষ ইমরে নজে(**) হত্যা করেছিল- এরপর তাকে মস্কোতে পাঠানো হয় ও তাকে আদেশ দেয়া হয়, গোছল করতে এবং দাড়ি গোঁফ কামাতে, তার কাপড় বদলে একটা টাই পরে নিতে এবং তারপর তাকে জানানো হয়েছিল যে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ পরিবর্তন করা  হয়েছে, নির্দেশ দেয়া হয় আরো একবার নিজেকে চেক রাষ্ট্রপ্রধান ভাবতে, ব্রেজনেভের বিপরীতে টেবিলে তাকে বসানো হয় এবং  জোরপূর্বক তাকে দিয়ে কাজ করানো হয়।

অপমানিত, দুবচেক দেশে ফিরে এসে তার দেশের অপমানিত জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন; এত বেশী অপমানিত হয়েছিলেন তিনি যে কোনো কথাই তিনি বলতে পারছিলেন না। তেরেজা কোনোদিনও ভুলবে না, তার ভাষণের বাক্যের মধ্যবর্তী দীর্ঘ বিরতিগুলোকে। তিনি কি খুবই ক্লান্ত ছিলেন? অসুস্থ? তাকে কি কোনো ঔষধ খাওয়ানো হয়েছিল? নাকি, সেটা শুধু হতাশা ছিল ? দুবচেক এর যদি কোনো কিছু অবশিষ্ট নাও থাকে, অন্ততপক্ষে ভাষণের সেই ভয়ঙ্কর দীর্ঘ বিরতিগুলো অবশিষ্ট থাকবে চিরকাল, যখন মনে হচ্ছিল তিনি শ্বাস নিতে পারছেন না, বাতাসের জন্য হাহাকার করছেন আর সমস্ত জাতির রেডিওতে কান পেতে অপেক্ষা করছিল। এই বিরতিগুলোর মধ্যেই নিহিত ছিল সেই সত্যটি - তাদের দেশ কি ভয়াবহ বিপর্যয়ের  মুখে পড়েছে।

রুশ আগ্রাসনের সপ্তম দিন ছিল সেটি। তেরেজা ভাষণটা শুনেছিল একটি পত্রিকার সম্পাদকের অফিসে, যা রাতারাতি রূপান্তরিত হয়েছিল রুশ আগ্রাসন প্রতিরোধের অংশ হিসাবে। সেই মূহুর্তে সবাই দুবচেককে ঘৃণা করেছিল। সমঝোতা করার জন্য সবাই তাকে ভৎর্সনা করেছিল, তার অপমান দিয়েই সবাই অপমানিত বোধ করেছিল, তার দুর্বলতা তাদের আঘাত করেছিল।

জুরিখে বসে সেই দিনগুলোর কথা ভাবার সময়, তেরেজার সেই মানুষটাকে আর অসহ্য বোধ হয়না। ‘দুর্বল’ শব্দটা আর কোনো বিচারের অপরিবর্তনযোগ্য রায়ের মত শোনায় না। যে কোনো মানুষ তার চেয়ে শক্তিশালী কারো মুখোমুখি দুর্বল, যতই  দুবচেকের মত পেটানো খেলোয়াড়ের শরীর থাকুক না কেন তার। সেই দুর্বলতাটা যে একসময় মনে হয়েছে দুঃসহ আর ঘৃণ্য, যে দুর্বলতা তেরেজা আর টমাসকে দেশত্যাগ করতে প্ররোচিত করেছে, হঠাৎ করে তাকে সেটি আকর্ষণ করে। সে বুঝতে পারে, সে আসলে দুর্বলদের দলেরই একজন, দুর্বলদের শিবিরে, দুর্বলদের দেশের একজন এবং তাকে এদের প্রতিই বিশ্বাসভাজন থাকতে হবে কারণ তারা দুর্বল, বাক্যের মাঝামাঝি যারা শ্বাস নেবার জন্য বাতাস খোঁজে।

ভার্টিগো বা মাথার ঘুরে ওঠার মতই সে তাদের দুর্বলতার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে। সে আকর্ষণ বোধ করে কারণ, সে নিজেকেও  দুর্বল ভাবে। আবার সে ঈর্ষায় আক্রান্ত হয়, তার হাত আবার কাপতে শুরু করে। যখন টমাস ব্যাপারটা লক্ষ্য করে, সাধারণত সে যেটা করে তাই করে: সে তেরেজার হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে , জোরে চাপ দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করে। তার হাত থেকে তেরেজা হাত সরিয়ে নেয়।

সে জিজ্ঞাসা করে, ‘কি হয়েছে’?

‘কিছু না’।

তুমি কি চাইছো আমি তোমার জন্য করি?

‘আমি চাই তুমি বুড়ো হয়ে যাও, আরো দশ বছর বেড়ে যাক তোমার, বিশ বছর!’;

তেরেজা যেটা বোঝাতে চাইছিল তা হলো, ‘আমি চাই তুমি দুর্বল হও, আমার মত দুর্বল’।

২৭
তাদের কুকুর কারেনিনের সুইজারল্যান্ডে আসাটা একদম পছন্দ হয়নি, যে কোনো ধরনের পরিবর্তন কারেনিন ঘৃণা করে। কুকুরের সময়তো আর সরলরৈখিকভাবে প্লট করা যাবেনা, এটা ক্রমাগত চলতে থাকে না, একটা কিছু থেকে পরবর্তী অন্য কোনো কিছুতে। বরং এটা বৃত্তাকার ঘড়ির কাটার মত, যা – এবং তারাও, দ্রুত পাগলের মত সামনের দিকে দৌড়াতে অনিচ্ছুক – ফিরে আসে মুখ ঘুরিয়ে দিনের পর দিন একই পথ ধরে। প্রাহাতে টমাস আর তেরেজা যখন কোনো নতুন চেয়ার কেনে বা ফুলের টব নাড়া চড়া করে, কারেনিন অসন্তুষ্ট চোখে তাকাতো, এটা তার সময়ের বোধকে এলোমেলো করে দিত, যেন তারা ঘড়ির কাটাকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে এর উপরের সময় চিহ্নের সংখ্যা বদলে দিয়ে।

যাই হোক জুরিখের ফ্ল্যাটেও, খুব তাড়াতাড়ি আগের অবস্থা, আগের আচারও সে পুনপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রাহাতে থাকাকালীন সময়ের মতই খুব সকালে সে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নতুন দিনকে শুভেচ্ছা জানাতো, সকাল বেলা বাজারের সময় তেরেজার সঙ্গী হতো, এবং নিশ্চিত করতো তার ভাগের অন্যান্য হাঁটাগুলোও যেন ঠিক থাকে।

কারেনিনকে তাদের জীবনের ঘড়ি বলা যায়। হতাশার সময়, তেরেজা নিজেকে মনে করিয়ে দিত, কারেনিনকেও তার দেখে রাখতে হবে, কারণ সে তার চেয়েও দুর্বল, হয়তো দুবচেক এবং তার পরিত্যক্ত জন্মভূমি থেকে।

একদিন বাইরে থেকে হেটে তেরেজা এবং ক্যারেনিন যখন ঘরে ফেরে, তখন ফোনটা বাজছিল, সে ফোনটা ধরে জিজ্ঞাসা করে, ‘কে বলছেন’?

অপরদিকে একটি নারীর কণ্ঠস্বর, জার্মান ভাষায় জানায় সে টমাসকে খুঁজছে। অস্থির একটা গলার স্বর। তেরেজার মনে হলো খানিকটা অবজ্ঞা মেশানো ঠাট্টার আভাস ছিল সেই নারীকন্ঠে। যখন সে তাকে জানালো, টমাস বাসায় নেই এবং সে জানেনা কখন সে ফিরবে, লাইনের অপর প্রান্তের মহিলা হাসতে শুরু করে এবং কোনো বিদায় সম্ভাষণ ছাড়াই সে ফোনটা রেখে দেয়।

তেরেজা জানতো, এটা হয়তো এমন কোনো ব্যাপার না; হাসপাতালের নার্সও হতে পারে, কোনো রোগী বা সেক্রেটারি, কিংবা যে কেউই। কিন্তু তারপরও সে বিরক্ত হয়, কোনো কাজে মন বসাতে পারেনা। এই সময় সে বুঝতে পারে বাড়িতে থাকাকালীন সেই সময়কার শক্তির শেষ বিন্দুটিও সে হারিয়ে ফেলেছে; চুড়ান্তরকম তুচ্ছ কোনো কিছু সহ্য করার ক্ষমতাও তার এখন নেই। ভিন দেশে থাকা মানে নীচে কোনো সুরক্ষার জাল ছাড়াই শূন্যে টান টান করে বাঁধা দড়ির উপর দিয়ে হাটার মত, নিজ দেশে যে সুরক্ষা জাল যোগায় স্বজন, সহকর্মী বা সুহৃদরা। যেখানে তার শৈশব থেকে পরিচিত ভাষায় সে সহজে যা বলতে চায়, বলতে পারে। প্রাহাতে শুধুমাত্র হৃদয়ের ব্যাপারে সে টমাসের উপর নির্ভরশীল ছিল, কিন্তু এখানে সবকিছুর জন্যই সে নির্ভরশীল টমাসের উপর। তার কি হবে এখানে যদি সে তাকে ছেড়ে চলে যায় ? সে কি তাকে হারানোর ভয় নিয়েই সারা জীবন কাটাবে।

নিজেকেই সে বলে: তাদের পরিচয় প্রথম থেকেই একটা ভুলের উপর প্রতিষ্ঠিত;  তার বাহুর নীচে ’আনা কারেনিনা’ বইটি অনেকটা জাল কাগজপত্রের মত; টমাসকে যা একটা ভুল ধারণা দিয়েছিল তার সম্বন্ধে। তাদের ভালোবাসা সত্ত্বেও, একে অপরের জীবনকে তারা নারকীয় করে তুলেছে। তারা যে একে অপরকে ভালোবাসে, এই বাস্তব সত্যটা  শুধুমাত্র প্রমাণ করে যে, অপরাধটা আসলে তাদের নিজেদের নয়, তাদের আচরণে বা তাদের অনুভূতির অনিত্যতায় নয় বরং তাদের পারস্পরিক অসামঞ্জস্যতায়। টমাস শক্তিমান, তেরেজা দুর্বল। তেরেজা দুবশেকের মত, যে প্রতিটি বাক্যের মধ্যে ত্রিশ সেকেন্ডের বিরতি নেয়। সে তার দেশের মত, যে তোতলায়, একটু শ্বাস নেবার জন্য বাতাস খোঁজে, কথা বলতে পারেনা।

কিন্তু যখন শক্তিশালী এতই দুর্বল হয় যে সে দুর্বলকে আঘাত করতে পারেনা, তখন প্রস্থান করার জন্য দুর্বলের যথেষ্ট শক্তিশালী হতে হয়।

নিজেকে এই কথাগুলো বলে, সে কারেনিনের লোমশ মাথায় তার মুখটা চেপে ধরে বলে, ‘দুঃখিত কারেনিন, মনে হচ্ছে তোমাকে আবার অন্য কোথাও যেতে হবে’।

নোটস:
* দুবচেক: অ্যালেক্সান্ডার দুবচেক (Alexander Dubček: ১৯২৭-১৯৯২) স্লোভাক রাজনীতিবিদ, সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য চেকোস্লোভাকিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন (১৯৬৮-৬৯); তিনি কমিউনিস্ট চেকোস্লোভাকিয়াকে সংস্কার করার চেষ্টা করেছিলেন প্রাগ স্প্রিং এর সময়। ১৯৮৯ সালে কমিউনিস্ট সরকারের পতন হলে তিনি আবার চেক-স্লোভাক ফেডারেল সংসদের সভাপতি হয়েছিলেন।

** ইমরে নজে (Imre Nagy ১৮৯৬-১৯৫৮) হাঙ্গেরির কমিউনিস্ট রাজনীতিবিদ, দুই বার যিনি Council of Ministers of the People’s Republic of Hungary র সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন। তার ক্ষমতার দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হয়েছিল ১৯৫৬ সালে ব্যর্থ হাঙ্গেরীয় বিপ্লবের পর, যখন তার সোভিয়েত বিরোধী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল সোভিয়েত সেনাবাহিনীর সরাসরি আগ্রাসন। এর দুবছর পরে তাকে বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য