বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, তৃতীয় পর্ব-২

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৩-১৭ ০১:৪৪:৪২

কাজী মাহবুব হাসান:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]

ফ্রান্জ বের হয়ে যাবার পর সাবিনা এখন একা তার ফ্ল্যাটে, আবারো সে আয়নার সামনে ফিরে যায়, তখনো পরনে শুধু অন্তর্বাস । মাথায় বাওলার টুপি পরে নেয় আবার, নিজের দিকে খুব ভালো করে তাকায় সে। একটি বিশেষ হারানো মুহূর্ত ফিরে পাবার জন্য সে কতটা বছর খরচ করেছে অনুভব করে সাবিনা বিস্মিত হয়।

একবার, বহু বছর আগে তার স্টুডিওতে বেড়াতে আসার সময়, টমাসের খুব ভালো লেগেছিল বোওলার হ্যাটটি। নিজের মাথায় সেটি পরেছিল সে, জেনেভার স্টুডিওর মতই দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা একটি বড় আয়নার সামনে দাড়িয়ে তাকিয়ে ছিল, দেখতে চাইছিল তাকে কি উনবিংশ শতাব্দীর কোনো মেয়রের মত লাগছে কিনা। যখন সাবিনা তার কাপড় খুলছিল, সে হ্যাটটি সাবিনার মাথায় সে পরিয়ে দিয়েছিল, তারপর তারা আয়নার সামনে দাঁড়িয়েছিল ( তারা সবসময় আয়নার সামনে দাঁড়াতও যখন সাবিনা তার পরনের কাপড় খুলতো), নিজেদের দেখতো, সাবিনা তখনও তার অন্তর্বাস পরে, কিন্তু মাথায় সেই অদ্ভুত বোওলার টুপিটি। একই সাথে সে অনুধাবন করতো তারা দুজনেই আয়না তাদের প্রতিবিম্ব দেখে উত্তেজিত।

কোন বিষয়টি তাদের এত উত্তেজিত করতো? কিছু মুহূর্ত আগে, তার মাথার টুপিটাকে একটি ঠাট্টা ছাড়া কিছু মনে হচ্ছিল না। উত্তেজনা কি হাসি থেকে তাহলে মাত্র কয়েক পা দূরেই থাকে?  

হ্যাঁ, কিছুক্ষণ আগে যখন আয়নায় তারা তাদের দেখেছিল, সে শুধু একটি হাস্যকর পরিস্থিতির প্রথম কয়েক সেকেন্ডই দেখেছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সেই ঠাট্টাটি ঢেকে যায় উত্তেজনায়: বোওলার হ্যাট আর কোনো ঠাট্টার পরিচায়ক থাকে না; এটি তখন নিষ্ঠুরতার পরিচায়ক, সাবিনার বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতা, নারী হিসাবে তার সম্মানের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতা। সে তার নগ্ন পা, স্বচ্ছ প্যান্টি নীচ থেকে দৃশ্যমান তার তলপেটের নিচে ত্রিভুজ অংশটি দেখেছিল। অন্তর্বাস তার রমণীয়তায় মোহনীয় রূপটাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে বহু গুন, যা অস্বীকার করছে তার মাথার উপরের দৃঢ় পুরুষালী টুপিটি, উপেক্ষা আর ঠাট্টা করে। আর পাশে টমাস যে কাপড় না খুলে দাড়িয়ে থাকতো, সেই বাস্তব সত্যটি বোঝাতো তারা দুজনেই আয়নায় যা দেখতো, আসলে সেটি মূল পরিচ্ছন্ন কৌতুক থেকে ভিন্ন কিছু ছিল (কারণ যদি ঠাট্টা করাই তার উদ্দেশ্য হতো, তাহলে টমাস নগ্ন হতো আর মাথায় একটা বোওলার হ্যাট পরতো); এটি একধরনের  অবমাননা ছিল। কিন্তু প্রতিবাদ করার বদলে, সে গর্বের সাথে, উদ্দীপনা আর উস্কানীমূলকভাবে তার ভূমিকা পালন করা অব্যাহত রাখতো, যেন নিজের ইচ্ছায় সে আত্মসমর্পণ করছে জনসম্মুখে ধর্ষিত হবার জন্য। এবং হঠাৎ করে আর বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে না পরে সে টমাসকে টেনে মেঝেতে শুইয়ে ফেলতো, তার মাথার বোওলার হ্যাট গড়িয়ে যেত টেবিলের নীচে আর তারা আয়নার সামনের মেঝেতে বিছানো কার্পেটে লিপ্ত হতো সঙ্গমে ।  

কিন্তু আসুন, বোওলার টুপিটার প্রসঙ্গে একটু আলোচনা করা যাক।

প্রথমত, প্রায় ভুলে যাওয়া এক পিতামহের ম্লান হয়ে যাওয়া স্মৃতির স্মারক ছিল এটি, বোহেমিয়া প্রদেশের ছোট এক শহরে উনবিংশ শতাব্দীর কোনো এক সময় মেয়র ছিলেন যিনি।

দ্বিতীয়ত, এটা তার বাবারও স্মৃতিচিহ্ন। বাবার মৃত্যুর পর সাবিনার ভাইরা তাদের পারিবারিক সব সম্পত্তি যখন ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছিল এবং, সে, নিজের অধিকার আদায় করতে যুদ্ধ করার বিষয়ে স্বাধীন ঘৃণার কারণে, শ্লেষাত্মকভাবে ঘোষণা করেছিলো, এই বোওলার হ্যাটটাই সেই নিচ্ছে তার একমাত্র উত্তরাধিকার হিসাবে।

তৃতীয়, টমাসের সাথে তার ভালোবাসা খেলায় এটি একটি অনুষঙ্গ।

চতুর্থ,  তার মৌলিকতার চিহ্ন এটি, যে মৌলিকতা সে নিরন্তর প্রতিপালন করেছে সচেতনভাবে। যখন দেশ ছেড়ে পরবাসী হতে হয়েছিল, বেশী কিছু বহন করার সুযোগ ছিলনা  তার, আর এই বেঢপ আকারের অপ্রয়োজনীয় জিনিসটা নেয়া মানে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস পরিত্যাগ করা।

পঞ্চম, এখন যেহেতু সে প্রবাসে,  টুপিটি আবেগীয় একটি চিহ্ন, যখন জুরিখে টমাসকে সে দেখতে গিয়েছিল, এটি সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল সে, আর তার মাথায় পরা ছিল যখন টমাস হোটেল কক্ষের দরজা খুঁজেছিল সেদিন। কিন্তু তারপর সাবিনা যা কখনো ভাবেনি সেটাই ঘটেছিল: টুপিটি, আর সেই আগের মত লঘুচিত্ততা অথবা যৌনতার প্রতীক ছিল না, বরং রূপান্তরিত হয়েছিল অতীত সময়ের প্রতি একটি স্মারকে। দুজনকেই বিষয়টি স্পর্শ করেছিল। তারা সঙ্গম করেছিল যেন এর আগে তারা কখনোই মিলিত হয়নি। কোনো অশ্লীল খেলার উপলক্ষ ছিলনা। কারণ তাদের এই সাক্ষাৎটি তাদের ইতিপূর্বের ধারাবাহিক যৌন সাক্ষাতের কোনো ধারাবাহিকতা ছিলনা, যাদের প্রতিটি ছিল নতুন কোন ছোট অনাচার কল্পনা করার একেকটি সুযোগ। সেটি ছিল সময়ের পুনরাবৃত্তি বা পূণঃস্মরণ, তাদের সাধারণ অতীতের প্রতি একটি স্তবগাথা, ভাববিলাসমুক্ত একটি কাহিনীর ভাবালু সারাংশ, যা বহু দুরে হারিয়ে যাচ্ছিল।

বোওলার হ্যাটটি সাবিনার জীবনের সঙ্গীতের একটি মোটিফ। এটি বার বার ফিরে এসেছে, প্রতিবারই ভিন্ন ভিন্ন অর্থ নিয়ে এবং সেই সব অর্থই প্রবাহিত হয়েছে বোওলার টুপির মধ্য দিয়ে যেমন করে কোন নদীর বয়ে চলে নদীগর্ভ বেয়ে। আমি হয়তো এর নাম দিতে পারি হেরাক্লিটাসের নদীগর্ভ (আপনি একই নদীতে দুইবার পা ফেলতে পারবেন না) নদীগর্ভ: বোওলার হ্যাট হচ্ছে সেই নদীগর্ভ, যার মধ্য দিয়ে প্রতিবারই সাবিনা ভিন্ন ভিন্ন নদীকে প্রবাহিত হতে দেখে, অন্য কোনো শব্দার্থগত নদী। প্রতিবারই একই বস্তু পুনরায় জেগে ওঠে নতুন কোনো একটি অর্থ নিয়ে, যদিও পূর্ববর্তী সব অর্থই সেখানে প্রতিধ্বণিত্ব হয় (প্রতিধ্বনির মত, সারিবাঁধা প্রতিধ্বনিদের মত) যুগপতভাবে নতুন প্রতিধ্বনির সাথে। প্রতিটি নতুন অভিজ্ঞতা প্রতিধ্বনিত হয়, প্রতিবারই ঐকতানে সমৃদ্ধ হয়ে। বোওলার টুপিটি টমাস ও সাবিনাকে কেন আবেগাক্রান্ত করেছিল জুরিখের সেই হোটেলে এবং কেন তারা সঙ্গম করেছিল প্রায় চোখে অশ্রু নিয়ে? তার কারণ ছিল টুপিটির কৃষ্ণকায় উপস্থিতি শুধুমাত্র তাদের ভালোবাসা খেলার স্মৃতিস্মারকই ছিলনা, এছাড়াও এটি ছিল সাবিনার বাবার একটি স্মৃতিচিহ্ন এবং তার পিতামহের, যিনি এমন এক শতাব্দীতে বেঁচে ছিলেন যখন উড়োজাহাজ আর গাড়ী ছিলনা।

এখন, হয়তো, যে অতলস্পর্শী গহ্বরটি পৃথক করে রেখেছে সাবিনা এবং ফ্রান্জকে, সেটি বোঝার জন্য আমরা অপেক্ষাকৃত একটি ভালো অবস্থানে আছি:  ফ্রান্জ খুব আগ্রহ নিয়ে সাবিনার জীবনের কাহিনী শুনেছে এবং প্রায় সমানভাবে সাবিনাও উৎসাহী ফ্রান্জের জীবনের কাহিনী শোনার জন্য, কিন্তু যদিও তাদের সুস্পষ্ট ধারণা আছে তাদের বিনিময় করা শব্দগুলোর যৌক্তিক অর্থ কি হতে পারে, তবে তারা ব্যর্থ হয়েছে তাদের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত নদীর শব্দার্থগত গুঞ্জনটি শুনতে।

সুতরাং যখন ফ্রান্জের উপস্থিতিতে সে বোওলার টুপিটি তার মাথায় পরেছিল, ফ্রান্জ অস্বস্তি বোধ করেছিল, যেন তার সাথে কেউ কথা বলছে এমন একটি ভাষায় যা তার জানা নেই। এটি যেমন অশ্লীল নয় তেমনি ভাবাবেগে আক্রান্তও নয়, শুধুমাত্র অবোধ্য একটি ইশারা। তাকে যা অস্বস্তিতে ফেলেছিল, সেটা মূলত এর অর্থহীনতা।

যখন যুগলরা বয়সে বেশ তরুণ আর তাদের জীবনের সঙ্গীত তখনও এর সূচনা পর্বে, তারা একসাথে সেই সঙ্গীতটি রচনা করতে পারে, পরস্পর বিনিময় করতে পারে নানা মোটিফ (ঠিক যেভাবে টমাস আর সাবিনা বোওলার হ্যাট এর মোটিফ পরস্পর বিনিময় করেছিল), কিন্তু যদি তাদের দেখা হয় অপেক্ষাকৃত বেশী বয়সে, যেমন ফ্রান্জ ও সাবিনা, তাদের দুজনের জীবনের সঙ্গীতে কম্পোজিশন কম বেশী সমাপ্ত এবং প্রতিটি মোটিফ, প্রতিটি বিষয়, প্রতিটি শব্দ তাদের দুজনের কাছেই ভিন্ন অর্থ বহন করে।

আমি যদি ফ্রান্জ এবং সাবিনার সব কথোপকথন লিপিবদ্ধ করতাম, আমি অবশ্যই একটি দীর্ঘ অভিধান রচনা করতে পারতাম তাদের ভুল-বোঝাবুঝিগুলোর। এর চেয়ে বরং সন্তুষ্ট হওয়া যাক, একটি সংক্ষিপ্ত অভিধান নিয়ে।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য