বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, তৃতীয় পর্ব-৩.২

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৩-২৩ ১৪:১৬:৫৩

কাজী মাহবুব হাসান:

৩.২
ভুল বোঝা শব্দগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত অভিধান

সঙ্গীত:
ফ্রান্জের জন্য সঙ্গীত হচ্ছে এমন একটি শিল্পকলা যা মত্ততার অর্থে ডাইওনাইসিয়ান সৌন্দর্যের সবচেয়ে নিকটবর্তী। কেউই আসলে মাতাল হয়না সেই অর্থে কোনো একটি উপন্যাস বা চিত্রকর্ম দেখে, কিন্তু কে পারে মাতাল না হয়ে থাকতে বীটহোভেন এর নবম, বার্টোকের সোনাটা ফর টু পিয়ানো অ্যান্ড পারকাশন অথবা বীটলস এর হোয়াইট অ্যালবাম শুনে? ফ্রাঞ্জ ধ্রুপদী আর পপ সঙ্গীতের মধ্যে কোনো বিভেদ করে না। তার কাছে এই পার্থক্য করাটাকে মনে হয় পুরোনো ধ্যানধারণার আর ভণ্ডামীপূর্ণ, মোৎসার্ট যেমন, তেমনই রক সঙ্গীতও পছন্দ করে ফ্রান্জ।

সঙ্গীতকে মুক্তিদায়ী একটি শক্তি হিসাবে বিবেচনা করতো ফ্রান্জ, যা তাকে মুক্তি দিয়েছিল একাকীত্ব, অন্তর্মুখিতা, লাইব্রেরীর ধুলো থেকে, এটি তার শরীরের দরজাটিকে উন্মুক্ত করেছিলো, যেন তার আত্মা বাইরের এই পৃথিবীতে বেরিয়ে আসতে পারে বন্ধু বানাতে। নাচতে ভালোবাসতো ফ্রান্জ, এবং কিছুটা ক্ষেদ তার মনে ছিল কারণ সাবিনার পছন্দের সাথে তার এই তীব্র পছন্দের বিষয়টির গরমিল ছিল।

একবার একটি রেস্তোরাঁয় তারা একসাথে যখন খাচ্ছিল, খুব কাছের কোনো একটি স্পিকার থেকে উচ্চ স্বরের সঙ্গীত ও ড্রামের ভারী ছন্দ ভেসে আসলে শুরু করে।

সাবিনা বলেছিল, খুবই দুষ্ট চক্র এটি, মানুষ বধির হয়ে যাচ্ছে কারণ সঙ্গীত ক্রমেই আরো বেশী জোরে বাজানো হচ্ছে, কিন্তু যেহেতু তারা কানে শুনতে পারছেন না, সেকারণে সঙ্গীতও আরো বেশী জোরে বাজাতে হচ্ছে।

ফ্রান্জ সাবিনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো, তোমার সঙ্গীত ভালো লাগে না?

না,  সাবিনা উত্তরে বলেছিল এবং তারপর সে যোগ করে, যদিও ভিন্ন কোনো যুগে …. সাবিনা তখন ইয়োহান সেবাস্টিয়ান বাখের দিনগুলোর কথা ভাবছিল - যখন সঙ্গীত ছিল সীমাহীন তুষার আবৃত প্রান্তের উপর গোলাপ ফুল ফোটার মত।

সঙ্গীতের ছদ্মবেশে হট্টগোল তার শৈশব থেকেই তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। কমিউনিস্ট সরকারের অধীনে ফাইন আর্টস অ্যাকাডেমিতে পড়ার সময় শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বাধ্যবাধকতা ছিল পুরো একটি গ্রীষ্মের ছুটি তরুণদের কোনো ক্যাম্পে কাটানো। সবাইকে একই সাথে সেই ক্যাম্পে থাকতে হতো এবং সাধারণত কোনো প্রকল্পে কাজ করতে হতো। সাবিনাও একটি গ্রীষ্মের ছুটিতে ইস্পাতের কারখানা নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করেছিল। সেখানে সকাল পাঁচটা থেকে রাত নটা অবধি বিশাল লাউডস্পিকার ব্যবহার করে উচ্চ স্বরের সঙ্গীত বাজানো হতো। সাবিনার কাঁদতে ইচ্ছা হতো, কিন্তু সঙ্গীতগুলো ছিল আনন্দপূর্ণ, এবং সেই আওয়াজ কোথাও আত্মগোপন করে থাকার জায়গাও ছিলনা, বাথরুমে না, বিছানার চাদরের নীচে না। সবকিছুই ছিল লাউড স্পিকারগুলোর আওতার বলয়ে। পাগলা একদল কুকুরের মত মনে হয়েছিল তার সেই সঙ্গীতগুলো, অসুখের মত যারা তারা তাকে আক্রমণ করেছিল।

সেই সময়, সাবিনা ভেবেছিল, শুধুমাত্র কমিউনিস্ট বিশ্বেই সঙ্গীতের বর্বরতার এভাবে চূড়ান্তভাবে রাজত্ব সম্ভব। প্রবাসে, সে আবিষ্কার করেছিলো যে সঙ্গীতের এই অপ্রীতিকর অতিশব্দে রূপান্তর হবার প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ গ্রহব্যাপী চলমান একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে মানবজাতি সম্পূর্ণ কদর্যতার ঐতিহাসিক একটি পর্বে প্রবেশ করছে। সম্পূর্ণ কদর্যতা আবির্ভূত হয়ে সর্বপ্রথম এর উপস্থিতি সে জানান দেয় সর্বত্র বিরাজমান একটি ধ্বনিতাত্বিক কদর্যতায়: গাড়ী, মোটরসাইকেল, ইলেকট্রিক গিটার, ড্রিল মেশিন, লাউড স্পিকার, সাইরেনে। এরপর সর্বত্র বিরাজমান দৃশ্যগত কদর্যতা আসারও খুব বেশী বিলম্ব নেই।

রাতের খাবারের পর তারা উপরে তাদের ঘরে যায় এবং শারীরিকভাবে মিলিত হয়। এবং ফ্রান্জ যখন ঘুমিয়ে পড়ার প্রক্রিয়ায় ছিল, তখন চিন্তাগুলোর তাদের সংলগ্নতাও হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। রাতের খাবারের সময় বাজা উচ্চ শব্দ পূর্ণ সেই সঙ্গীত সে স্মরণ করেছিল এবং নিজেকে সে বলে, অতিশব্দের একটি সুবিধা আছে। এটি আমাদের মুখে উচ্চারিত শব্দাবলী গ্রাস করে। এবং হঠাৎ করেই সে অনুভব করে সারাজীবন ধরেই সে কথা বলা, লেখা, বক্তৃতা দেয়া, বাক্য আর সূত্র তৈরি করা ও তাদের সংশোধন ছাড়া আর কিছুই করেনি, যেন পরিশেষে কোনো শব্দই আর সুনির্দিষ্ট না থাকে, তাদের অর্থ মুছে ফেলা হয়, তাদের আধেয় হারিয়ে যায়, তারা রূপান্তরিত হয় আবর্জনায়, বর্জ্য, ধুলা আর বালিতে; মগজের ভিতর তারা ঘুর ঘুর করে, মাথা যেন ছিঁড়ে ফেলতে চায়, তারাই তার অনিদ্রা, তার অসুখ। এবং উচ্চস্বরের সঙ্গীতের সেই মুহূর্তটির সে আবারও তীব্রভাবে কামনা করে, অস্পষ্টভাবে কিন্তু তার সব শক্তি নিয়ে। সেই বাধাহীন সঙ্গীত, চূড়ান্ত শব্দ, আনন্দদায়ক, সর্বব্যাপী সুখকর, অদমনীয়, জানালা কাঁপানো হট্টগোল, যা চিরকালের জন্য গ্রাস করবে শব্দগুলোর সেই কষ্ট, অন্তঃস্বারশূন্যতা আর অহমিকাগুলোকে। সঙ্গীত বাক্যগুলোকে নাকচ করে দেয়, সঙ্গীত হচ্ছে শব্দ-বিরুদ্ধ! সাবিনার একটি দীর্ঘ আলিঙ্গন সে কামনা করে, কামনা করে আর কোনোদিনও একটি বাক্যও উচ্চারণ না করার জন্য, তার যৌনমিলনের চরমসূখ মিলে যাক সঙ্গীতের প্রমত্ত গর্জনে। এই আনন্দপূর্ণ কাল্পনিক শোরগোলের দ্বারা প্রশমিত হয়ে সে ঘুমিয়ে পড়ে।

আলো এবং অন্ধকার
সাবিনার জন্য বেঁচে থাকা হচ্ছে দেখা, আর দেখা সীমাবদ্ধ দুটি সীমানার দ্বারা: শক্তিশালী আলো, যা অন্ধ করে আর সম্পূর্ণ অন্ধকার। হয়তো সেটাই, তীব্র যে কোনো কিছুর প্রতি সাবিনার অপছন্দকে উৎসাহিত করেছে। চূড়ান্ত মানে সেই সীমানাগুলো, যার পরে জীবন সমাপ্ত হয় এবং কোনো তীব্র কিছুর প্রতি বাড়তি আবেগ, শিল্পকলা কিংবা রাজনীতিতে, হচ্ছে মৃত্যুর জন্য অবগুণ্ঠিত একটি কামনা।

ফ্রান্জের কাছে আলো শব্দটি দিনের হালকা আভায় উদ্ভাসিত কোনো ভূদৃশ্যচিত্র মনে করিয়ে দেয়না, এটি তাকে আলোর উৎসের কথা মনে করিয়ে দেয় : সূর্য, কোনো আলোর বাল্ব, একটি স্পটলাইট। পরিচিত রূপকের সাথে ফ্রান্জের এই সংশ্লিষ্টতা: ন্যায়পরায়ণতার সূর্য, বুদ্ধিমত্তার দীপ্ত শিখা ইত্যাদি।

অন্ধকারও আলোর মতই ফ্রান্জকে আকৃষ্ট করে। সে জানে ইদানীং সঙ্গমের আগে আলো নিভিয়ে দেয়াকে হাস্যকর বিবেচনা করা হয়, এবং সেকারণে সে সবসময়ই বিছানার পাশে একটি ছোট আলো জ্বালিয়ে রাখে। তবে যে মূহুর্তে সে সাবিনার ভিতরে প্রবেশ করে, সে চোখ বন্ধ করে ফেলে। তার শরীরে ক্রমশ পূর্ণ হতে থাকা আনন্দের জন্য প্রয়োজন তখন অন্ধকার। সেই অন্ধকার বিশুদ্ধ, নিখুঁত, চিন্তামুক্ত, লক্ষ্যহীন। সেই অন্ধকার অশেষ, সীমাহীন, সেই অন্ধকারই অসীমতা যা আমরা সবাই আমাদের নিজেদের মধ্যে বহন করি। (হ্যাঁ যদি আপনি অসীমতা খুঁজতে চান, শুধু আপনার চোখ বন্ধ করুন!);

এবং যে মূহুর্তে ফ্রান্জ তার সারা শরীরের আনন্দে পূর্ণ হয়ে ওঠাটি অনুভব করতে পারেন, ফ্রান্জ নিজেই বিখণ্ডায়িত হয়, দ্রবীভূত হয় তার অন্ধকারের অসীমতায়, নিজেই পরিণত হয়ে অসীমে। কিন্তু তার নিজের অভ্যন্তরের অন্ধকারে কোনো মানুষ আকারে যতই বড় হতে থাকে, তার বাইরের আকৃতি ততই ক্ষুদ্র হতে থাকে। চোখ বন্ধ করে থাকার কোনো মানুষ, মানুষেরই ধ্বংসাবশেষ মাত্র। এছাড়া, সাবিনার কাছে ফ্রান্জের এই  চোখ বন্ধ করে রাখার দৃশ্যটি খুবই অরুচিকর মনে হতো; ফ্রান্জের দিকে তাকানো এড়াতে সে নিজেও তার চোখগুলো বন্ধ করে ফেলতো। কিন্তু তার জন্য, অন্ধকার মানে অসীমতা নয়; তার জন্য, এটি সে যা দেখছে তার সাথে মতানৈক্য, যা দেখেছে সেটিকে নাকচ করে দেয়া, কিছু দেখতে অস্বীকার করা।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য