বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, তৃতীয় পর্ব-৪

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৩-২৭ ২৩:৩৪:৫১

কাজী মাহবুব হাসান:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]

সাবিনা একবার নিজেকে অনুমতি দিয়েছিল পরিচিত প্রবাসীদের একটি জমায়েতে তাকে নিয়ে যাবার জন্য। যথারীতি তারা আলোচনা করছিল রুশদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়া তাদের উচিৎ হবে কি হবে না সেই বিষয়ে। প্রবাসের নিরাপদ পরিবেশে, তারা সবাই স্বাভাবিকভাবেই  যুদ্ধে স্বপক্ষেই সমর্থন দিয়েছিল। সাবিনা বলেছিল, তাহলে তোমরা কেন ফিরে যাচ্ছো না যুদ্ধ করতে?

সাধারণত এভাবে কিছু বলার কথা না। কৃত্রিমভাবে ঢেউ খেলানো ধূসর চুলের একজন ভদ্রলোক তার দিকে দীর্ঘ তর্জনী তুলে ধরে। এভাবে কথা বলা উচিৎ না, তোমরাও সবাই দায়ী সেখানে যা ঘটেছে তার জন্য। তুমিও। তুমি কিভাবে কমিউনিস্ট সরকারের বিরোধিতা করেছিলে? তুমি শুধু ছবি এঁকেছিলে।

জনগোষ্ঠীকে যাচাই করা, তাদের উপর সারাক্ষণ নজরদারী করা‍, কমিউনিস্ট দেশগুলোর প্রধান এবং কখনোই শেষ হবার নয় এমন একটি সামাজিক কর্মকাণ্ড। কোনো শিল্পী যদি তার কাজের প্রদর্শনী করতে চায়, একজন সাধারণ নাগরিককে যদি সমুদ্র পারে বেড়াতে যাবার জন্য ভিসা নিতে হয়, জাতীয় ফুটবল দলে কোন খেলোয়াড় খেলবে সেটি নির্ধারণ করতে হয়, তাহলে বহু ধরনের প্রস্তাবনা, সুপারিশ আর রিপোর্ট প্রস্তুত করতে হয় (তার বাসস্থানের পাহারাদার, প্রতিবেশী, সহকর্মী, পুলিশ, স্থানীয় পার্টি, সংশ্লিষ্ট ট্রেড ইউনিয়নের পক্ষ থেকে)।

তারপর তার পক্ষে বিপক্ষে সব সুপারিশ পর্যালোচনা করা হয়, প্রয়োজন মাফিক গুরুত্ব দেয়া হয়, যার একটি সার সংক্ষেপ করে বিশেষ কর্মকর্তারা। আর এই সব রিপোর্টগুলোর সাথে সেই ব্যক্তির কোনো মেধা বা শৈল্পিক দক্ষতা, ফুটবলে লাথি মারার দক্ষতা, লবণাক্ত সমুদ্রের বাতাসে তার অসুখের নিরাময় হবার সম্ভাবনার সঙ্গে আদৌ কোনো যোগাযোগ নেই। তারা শুধু একটি বিষয় নিয়ে চিন্তা করে: সেই আবেদনকারী নাগরিকের রাজনৈতিক পরিচিতি কি (অন্যার্থে তার সম্বন্ধে অন্য নাগরিকরা কি বলছে, কি সে চিন্তা করে, কিভাবে সে আচরণ করে, কিভাবে মে দিবসের প্যারেডে যোগ না দেবার জন্য অজুহাত প্রদান করে)। কারণ সব কিছুই (দৈনন্দিন অস্তিত্ব, কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতি, ছুটি) নির্ভর করে সেই পর্যালোচনার পরীক্ষার ফলাফলের উপর, প্রত্যেকেই (জাতীয় দলের জন্য সে ফুটবল খেলতে, প্রদর্শনী আয়োজন  অথবা সমুদ্রের পারে তার ছুটি কাটাবে যা কিছুই কেউ কামনা করুক না কেন) এমন ভাবে অবশ্য আচরণ করতে হবে যে তারা অনুকূল রিপোর্ট পায় কর্মকর্তাদের পর্যালোচনায়।

ঠিক সেটাই সাবিনার মনের মধ্যে ভেসে উঠেছিল যখন সে ধূসর চুলের ভদ্রলোকটির কথা শুনছিল। তার স্বদেশী ভালো শিল্পী  কিংবা ভালো ফুটবলার কিনা ( প্রবাসী চেকদের সেই জমায়েতে উপস্থিত কোনো চেকই কখনোই আগ্রহ দেখায়নি সাবিনা শিল্পকলা নিয়ে) সে বিষয়ে তার আদৌ কোনো ভাবনা নেই; তার চিন্তা শুধুমাত্র তারা কি সক্রিয়ভাবে অথবা শুধু অক্রিয়তার সাথে, আসলেই এবং সত্যিকারভাবে অথবা শুধু লোক দেখানোর খাতিরে, শুরু থেকে নাকি শুধুমাত্র অভিবাসী হবার পর থেকে কমিউনিজমের বিরোধিতা করেছিল।

যেহেতু সে শিল্পী চিত্রকর, নানা খুঁটিনাটি বিষয় লক্ষ্য করার মত চোখ ছিল সাবিনার এবং প্রাহার সেই মানুষদের, যারা অন্যদের নানা বিষয়ে খতিয়ে দেখার বিশেষ তাগিদ অনুভব করতো, তাদের একটি শারীরিক বৈশিষ্ট্যের স্মৃতি তার মনে ছিল। তাদের সবার হাতের মধ্যমার চেয়ে তর্জনীটি ছিল কিছুটা দীর্ঘ, এবং  যে কোনো কারো সাথে যখনই তারা কথা বলতো তাদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করার জন্য সেটি ব্যবহার করতো। বাস্তবিকভাবে, প্রেসিডেন্ট নভোতনি, ১৯৬৮ সালের আগের চৌদ্দ বছর যিনি দেশটি শাসন করেছিলেন, তারও ঠিক একরমই নাপিতের হাতে গড়া ধূসর রুপালী ঢেউ খেলানো চুল ছিল, এবং মধ্য ইউরোপের অধিবাসীদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বড় তর্জনীটি ছিল তার।

যখন বিশিষ্ট এই অভিবাসী এক চেক শিল্পীর মুখ দিয়ে শুনলেন, যে শিল্পীর কোনো চিত্রকর্মই তিনি কোনোদিনও দেখেননি যে, তিনি দেখতে কমিউনিস্ট প্রেসিডেন্ট নভোতনির মত, তার মুখ দ্রুত লাল হয়ে ওঠে, তারপর সাদা, তারপর আবার লাল, তারপর আরো একবার সাদা। তিনি কিছু বলার চেষ্টা করেন, কিন্তু সফল হয়ে উঠতে পারেননি এবং অবশেষে নীরব হয়ে যান। বাকী সবাই চুপ থাকে যতক্ষণ না অবধি সাবিনা উড়ে দাড়িয়ে সেখান থেকে চলে না যায়। ’

বিষয়টি তাকে অসুখী করেছিল, আর রাস্তায় নেমে আসার পর সে নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কেন চেকদের সাথে সম্পর্ক রাখার দরকার মনে করেছিল। কোন জিনিসটি তাকে সংযুক্ত করে রেখেছে তাদের সাথে? দেশের ভূদৃশ্য? যদি তাদের প্রত্যেককে জিজ্ঞাসা করা হয়, তা মাতৃভূমির নাম শুনলে তাদের মনে কোন দৃশ্যটি ভেসে ওঠে, সেই দৃশ্যগুলো এত বেশী ভিন্ন হবে যে সেখানে ঐক্যের কোনো ভাবনার সম্ভাবনা বাদ দেয়া যায় অনায়াসে।

অথবা সংস্কৃতি?কিন্তু সেটাই বা কি? দিভোরজাক * আর ইয়ানাচেক** ? হ্যাঁ, কিন্তু কোনো একজন চেকের যদি সঙ্গীতের প্রতি কোনো আগ্রহ না থাকে? তখন চেক হবার সেই  মূলসারটিও বাতাসে অদৃশ্য হয়ে যায়।

অথবা মহান ব্যক্তিরা ? ইয়ান হুস***? সেই রুমের কোনো চেকই কখনোই তার একটি বাক্যও পড়ে দেখেনি। শুধুমাত্র একটি জিনিস তারা বুঝতে সক্ষম হতে পারে, সেটি হচ্ছে অগ্নিশিখা, সেই আগুনের মাহাত্ম্য, যখন তাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল, সে গর্বিত ছাই, সুতরাং তাদের জন্য চেক হবার মূলসার হচ্ছে শুধু ছাই আর বেশী কিছু নয়। শুধুমাত্র যা তাদের একসূত্রে বেধেছে তাহলো তাদের পরাজয় এবং পরস্পরের ছুড়ে দেয়া সমালোচনা।

সাবিনা দ্রুত হাটতে থাকে। স্বদেশীদের সাথে তার সম্পর্কচ্ছেদের চেয়ে নিজের চিন্তাই তাকে বেশী অশান্ত করে তুলেছিল। সে জানে তার অবস্থান এখানে নিরপেক্ষ নয়। অন্য চেকরাও তো আছে, লম্বা তর্জনীসহ মানুষটা থেকে যারা ভিন্ন। তার ছোট বক্তৃতার পর নেমে আসা অস্বস্তিকর নীরবতা কোনভাবেই ইঙ্গিত দেয় না যে তারা সবাই তার মতামতের বিপক্ষে। না, তারা সম্ভবত চমকে গেছে হঠাৎ করেই প্রকাশিত হওয়া ঘৃণা, বোঝার ঘাটতির দ্বারা, অভিবাসনে যারা সবাই এর স্বীকার। তাহলে কেন সে তাদের জন্য কোনো দুঃখ বোধ করে না? কেন সে ব্যর্থ হয় তারা আসলেই যেমন, করুণ, পরিত্যক্ত প্রাণী, সেভাবে তাদের দেখতে?

আমরা জানি কেন। তার বাবার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করার পর, তার সামনে উন্মুক্ত হয়েছিল জীবনের দরজা, বিশ্বাসঘাতকতার সুদীর্ঘ একটি পথ, যার প্রতিটি তাকে আকর্ষণ করেছে অনাচার আর বিজয় রূপে। সবাইকে অনুসরণ সে কখনোই করবে না, সবাইকে অনুসরণ করতে সে অস্বীকার করেছে - সব সময় একই মানুষের সাথে, একই বক্তৃতার সাথে ! সে কারণেই সে এত বিচলিত হয় তার নিজের অবিচারের প্রতি। কিন্তু এই অনুভূতিটা অপ্রীতিকর নয়, বরং এর ব্যতিক্রম। সাবিনার মনে হচ্ছিল, এই মাত্র সে একটি বিজয় অর্জন করেছে এবং অদৃশ্য একজন তাকে এর জন্য সমর্থন জানাচ্ছে।

তারপর হঠাৎ করেই এই মত্ততাটি রূপান্তরিত হয় উৎকণ্ঠায়: কোথাও না কোথাও এই রাস্তার শেষ হতে হবে! । আগে কিংবা পরে তার সব বিশ্বাসঘাতকতায় তার ইতি টানতে হবে! আগে কিংবা পরে তার নিজেকে তার থামাতে হবে!

তখন সন্ধ্যাবেলা, রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যে দিয়ে সে দ্রুত হেটে যায়। আমস্টারডামমুখী ট্রেন এসে গেছে প্ল্যাটফর্মে। বন্ধুসূলভ একজন প্রহরীর সহায়তায় সে তার কোচটি খুঁজে পায়। কম্পার্টমেন্টের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলে সে ফ্রান্জকে ছোট কাউচের উপর বসে থাকতে দেখে।  ফ্রান্জ উঠে দাড়ায় সাবিনাকে শুভেচ্ছা জানাতে; সাবিনা তাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে, অনেকগুলো চুমু দিয়ে প্রায় তার দম বন্ধ হবার উপক্রম করে।

সাবিনা প্রায় অনতিক্রম্য একটি বাসনা অনুভব করে তাকে বলতে, খুব সাধারণ কোনো নারীর মত, আমাকে কোথাও চলে দিতে দিও না, আমাকে শক্ত করে ধরে রাখো, আমাকে তোমার খেলার সামগ্রী বানাও, তোমার ক্রীতদাস, শক্ত হও! কিন্তু  এই শব্দগুলো সে বলতে পারে না।

ফ্রান্জের আলিঙ্গন থেকে তার মুক্তি দেয় করার পর শুধুমাত্র যে কথাটি সে বলতে পারে, সেটি ছিল, তুমি জানো না তোমার কাছে এখানে আসতে পেরে আমি যে কতটা সুখী হয়েছি। খুব চাপা স্বভাবের তার চরিত্র সর্বোচ্চ এতটুকু প্রকাশ করার অনুমতি দিয়েছিল।

টিকা:
*আন্তোনিন দিভোরজাক ১৮৪১-১৯০৪, বিখ্যাত চেক সঙ্গীতজ্ঞ
** লেওশ ইয়ানাচেক ১৮৫৪-১৯২৮, চেক সঙ্গীতজ্ঞ, সুরস্রষ্টা, লোকসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ
*** ইয়ান হুস, ১৩৬৯-১৪১৫, চেক যাজক,দার্শনিক, চার্চের পুনসংস্কার আন্দোলনের একজন তাত্ত্বিক, খ্রিষ্টীয় চার্চের প্রথম দিককার একজন সংস্কারক হিসাবে তাকে চিহ্নিত করা হয়।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য