বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, তৃতীয় পর্ব-৬

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৪-০৯ ২৩:৫৫:৫১

কাজী মাহবুব হাসান:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]

‘আমি কখনোই গাড়ি চালাবো না, আমি দুর্ঘটনা খুবই ভয় পাই, এমনকি যখন দুর্ঘটনায় যদি মৃত্যু নাও হয়, দুর্ঘটনা ঠিকই আপনার উপর স্থায়ী একটি চিহ্ন রেখে যায়’। আর এই কথাটি বলেই ভাস্করটি অভ্যাসবশত তার হাতের আঙুলগুলো ধরে, একটি কাঠের মূর্তি খোদাইয়ের সময় দুর্ঘটনাবশত যেগুলো সে প্রায় কেটে ফেলেছিল। অলৌকিকভাবেই তার আঙ্গুলগুলো রক্ষা পেয়েছে।

‘কি বলছেন আপনি’? মারি ক্লদ তার উচ্চ কর্কশ কণ্ঠে প্রশ্ন করে। তার মেজাজ তখন বেশ ভালো। ‘আমি একবার ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম, এবং পৃথিবীর কোনো কিছুর বিনিময়েই  আমার জীবন থেকে ঘটনাটা বাদ দিতে পারবো না। হাসপাতালে যখন শুয়ে ছিলাম, আমি আর কখনোই এত আনন্দ পাইনি এর আগে। আমি এক ফোটা ঘুমাতে পারিনি ঠিকই, তবে দিন রাত সারাক্ষণই কেবল বই পড়েছি’।
 
সবাই তার দিকে অবাক হয়ে তাকায়। বিষয়টি মারি-ক্লদ উপভোগ করে সবসময়। ফ্রান্জ তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বিরক্তি ( কারণ সে জানতো যে দুর্ঘটনা নিয়ে কথা বলা হচ্ছে সেটি ঘটার পর তার স্ত্রী  গভীর হতাশায় আক্রান্ত হয়েছিল এবং সেটা নিয়ে বিরতিহীন ভাবেই সে অভিযোগ করেছিল) আর প্রশংসার (অভিজ্ঞতার সব কিছুকেই রূপান্তর করার যোগ্যতা আসলে মারি-ক্লদের সত্যিকার প্রাণশক্তির পরিচয়) মিশ্রিত একটি অভিব্যক্তি দিয়ে।

‘হাসপাতালে থাকার সময়ই আমি বইগুলোকে  দিনের বই আর রাতের বই হিসাবে ভাগ করতে শুরু করেছিলাম’ - কথা বলা অব্যাহত রাখে সে। আসলেই, কিছু বই আছে যা দিনের বেলায় পড়ার জন্য এবং কিছু বই আছে, যা শুধু পড়া যায় রাতে’।

এখন সবাই তার দিকে বিস্ময় আর সপ্রশংস দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে । সবাই, শুধুমাত্র ভাস্করটি ছাড়া, যে তখনও তার আঙ্গুলগুলো ধরে আছে, তার মুখের ভাজ ও অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছে দুর্ঘটনার স্মৃতিটি তার মনে পড়ছে।

মারি-ক্লদ তার দিকে তাকায় এবং জিজ্ঞাসা করে, স্টেনডালকে আপনি কোন গ্রুপে রাখবেন? ভাস্কর সেই প্রশ্নটি শুনতে পায়নি এবং অস্বস্তির সাথে সে তার কাঁধ ঝাঁকায়। তার পাশে দাঁড়ানো এক শিল্প সমালোচক বলেন তিনি মনে করেন স্টেনডালকে রাখা উচিৎ দিনের বেলার পাঠ্যতালিকায়। মারি-ক্লদ সজোরে মাথা নাড়িয়ে স্বভাবসুলভ উচ্চ স্বরে ভিন্নমত প্রকাশ করে বলে, ‘না, না, আপনি ভুল বলছেন, ভুল বলছেন, স্টেনডাল হচ্ছে রাতের লেখক’!

রাত আর দিনের শিল্পকলা নিয়ে এই বিতর্কে ফ্রান্জের নিজের অংশগ্রহণকে বিঘ্নিত করছিল আরেকটি জরুরী বিষয়, যে কোনো মূহুর্তে সাবিনার সেখানে উপস্থিত হওয়া সে প্রত্যাশা করছিল। তারা বহু দিন ধরেই বিষয়টি নিয়ে ভেবেছে এই ককটেল পার্টির নিমন্ত্রণটি সাবিনার গ্রহণ করা উচিৎ হবে কিনা। এই পার্টিটির আয়োজন করেছিল মারি-ক্লদ, সব চিত্রকর আর ভাস্করদের জন্য, যারা তার ব্যক্তিগত গ্যালারীতে কোনো না কোনো একসময় প্রদর্শনী করেছে। ফ্রান্জের সাথে সাবিনার পরিচয় হবার পর, সাবিনা তার স্ত্রীকে এড়িয়ে চলেছে। কিন্তু যেহেতু তাদের জানাজানি হয়ে যাবার ভয় আছে, তারা উপসংহারে পৌছায়, বিষয়টি আরো বেশী স্বাভাবিক হবে আর সেকারণে কম সন্দেহজনকও হবে, যদি সাবিনা এই নিমন্ত্রণটি গ্রহণ করে।

প্রবেশে পথের হলের দিকে হালকা নজর রেখে, ফ্রান্জ তার অষ্টাদশী কন্যা, মারি-অ্যানের কণ্ঠ শোনে, যে কক্ষের অন্যদিকটি ব্যস্ত রেখেছে। তার স্ত্রী তত্ত্বাবধানে থাকা গ্রুপটিকে ফেলে সে তার মেয়ের তত্ত্বাবধানে থাকা গ্রুপটির দিকে অগ্রসর হয়। কেউ চেয়ারে বসে কেউ দাড়িয়ে, কিন্তু মারি-অ্যান মেঝেতে আসন পেতে বসা। ফ্রান্জ নিশ্চিত যে  মারী-ক্লদও খুব শীঘ্রই রুমে তার দিকে মেঝেতে থাকা কার্পেটের বসে পড়বে। যখন অতিথি থাকে এবং আপনি মাটিতে বসে পড়েন, সেই ভঙ্গিমাটি সরলতা, অনানুষ্ঠানিকতা, উদারবাদী রাজনীতি, আতিথেয়তা এবং পারিসীয় জীবনের প্রতিনিধিত্ব করে। তীব্র আবেগ নিয়ে মারি-ক্লদ এর যে কোনো মেঝেতেই বসে পড়ার অভ্যাস প্রায়শই প্রদর্শন করেছে, কখনো ফ্রান্জ চিন্তিত হতে শুরু করেছিল, যেখানে সে সিগারেট কিনতে যায় সেই দোকানের মেঝেতেও না আবার বসে পড়ে।

‘তুমি এখন কি নিয়ে কাজ করছো এখন, অ্যালেন? মারী-অ্যান একজন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করে, যার পায়ের কাছে সে বসে আছে।

অ্যালেন এতই সরল এবং আন্তরিক যে. আসলেই সে চেষ্টা করে গ্যালারী মালিকের কন্যাকে সৎ একটি উত্তর দেবার জন্য। সে মারি-অ্যানকে ব্যাখ্যা করতে শুরু করে তার নতুন কৌশলটিকে, আলোকচিত্র আর তেল রঙের মিশ্রণ, কিন্তু কোনমতে সে তিনটি বাক্য শেষ না করতেই, মারি-অ্যান শিষ দেয়া শুরু করে। শিল্পী এত ধীরে ও মনোযোগ দিয়ে কথা বলছিলেন যে সে শীস দেয়াটি শুনতে পায়নি। ফ্রান্জ ফিসফিস করে তার কাছে জানতে  চায়, তুমি কি আমাকে বলবে, কেন তুমি শীস দিচ্ছো ? সে উচ্চস্বরেই বলে, ‘কারণ আমি শুনতে চাইনা কেউ এখানে রাজনীতি নিয়ে কথা বলুক”।

এবং আসলেই, একই চক্রের মধ্যে দাড়িয়ে দুজন মানুষ ফ্রান্সের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে কথা বলছিল।  মারী-আন, যে কিনা অনুভব করেছিল এই আলোচনার সভাটি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, সে তাদের জিজ্ঞাসা করে, তারা কি রসিনির অপেরায় যাবার কথা ভাবছে কিনা, যে অপেরাটি পরে সপ্তাহে অনুষ্ঠিত করতে যাচ্ছে ইতালীয় একটি কোম্পানি। ইতিমধ্যে অ্যালান- শিল্পী সেই মানুষটি আরো গভীরভাবে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা অব্যাহত রাখে পেইন্টিং এর প্রতি তার নতুন দৃষ্টিভঙ্গির নিয়ে। ফ্রান্জ তার মেয়ের জন্য লজ্জাবোধ করে। তাকে অপ্রস্তুত করার জন্য, সে বলে, যখনই মারি-অ্যান কোনো অপেরায় গিয়েছে সে ভয়ানক বিরক্তির অভিযোগ করেছে।

‘তুমি খুব খারাপ, বসে থাকা অবস্থায় পেটের মধ্যে ঘুষি মারার চেষ্টা করে। মূল তারকা গায়ক কিন্তু খুব সুদর্শন, খুবই সুদর্শন, দুবার আমি তাকে দেখে ফেলেছি, আমি মনে হয় তার প্রেমে পড়েছি’।

ফ্রান্জ এখনও সেই বিস্ময়টি কাটিয়ে উঠতে পারে না যে  মা এবং মেয়ে কত বেশী একই রকম। কেন সে তার মত হয়নি? এ বিষয়ে তার কিছুই করার নেই। তার মেয়েটি তার মত না। কতবার সে মারি-ক্লদকে বলতে শুনেছে, সে কোনো না কোনো চিত্রকর, গায়ক, রাজনীতিবিদ এবং একবার এমন কি রেসিং সাইকেল চালকের প্রেমে পড়েছে। অবশ্যই, এই সবই ককটেল পার্টির বাক্যলঙ্কার মাত্র, কিন্তু সে মনে না করে থাকতে পারে না যে, এখন এবং বিশ বছরের বেশী সময় আগে থেকেই সে তার সম্বন্ধেও একই কথা বলে বেড়াচ্ছে এবং তাকে আত্মহত্যার হুমকি দেখিয়ে যাচ্ছে।

সেই মূহুর্তে সাবিনা ঘরে ঢোকে। মারি-ক্লদ তার দিকে এগিয়ে যায়। মারি-আন যখন রসিনি নিয়ে কথা বলা চালিয়ে যাচ্ছিল, ফ্রান্জ মনোযোগ দেবার চেষ্টা করলো দুই রমণী কি কথা বলছে সেটা বোঝার জন্য। কিন্তু বন্ধুসূলভ শুভেচ্ছা বাক্য বিনিময়ের পর, সাবিনার গলায় পরা সিরামিকের একটি লকেট হাতে তুলে খুব উচ্চস্বরে বলে ওঠে, ‘এটা কি? কি কুৎসিত’!

এই শব্দগুলো ফ্রান্জের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। এমন নয় যে শব্দগুলো কোনো দ্বন্দ্বের আহবান। উচ্চস্বরে হাসির শব্দ যা এই বাক্যের পর পরই শোনা যায়, তা বিষয়টি স্পষ্ট করে লকেটটিকে প্রত্যাখ্যান করে মারি-ক্লদ সাবিনার সাথে তার বন্ধুত্বে কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছা পোষণ করছে না। কিন্তু এই ধরণের কথা সে সাধারণত বলে না।

‘আমি নিজেই এটা বানিয়েছি’, সাবিনা বলে।

‘লকেটটা কুৎসিত, আসলেই’! বেশ জোরেই মারি-ক্লদ তার মন্তব্যটির পুনরাবৃত্তি করে, ‘তোমার পরা উচিৎ না’।

ফান্জ জানতো তার স্ত্রী আদৌ গ্রাহ্য করেনা লকেটটি কুৎসিত কিনা। কোনো একটি কিছু কুৎসিত কারণ সে এটিকে কুৎসিত বলছে, সেটি সুন্দর, যদি সে এটিকে সুন্দর বলে। তার বন্ধুদের পরা লকেট আগেই থেকেই সুন্দর, এবং এমনকি যদি সেগুলো দেখতে কুৎসিত হয়েও থাকে, সে কিছু বলে না কখনো, কারণ চাটুকারিতা তার দ্বিতীয় স্বভাবে পরিণত হয়েছে বহুদিন আগে থেকেই।

কেন, তাহলে, সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে সাবিনার পরা লকেটটি, যা সাবিনা নিজেই তৈরি করেছে, সেটিকে কুৎসিত বলবে? ফ্রান্জ হঠাৎ করেই এর উত্তরটা স্পষ্টভাবে দেখতে পায়। মারি-ক্লদ  সাবিনার লকেটটাকে কুৎসিত বলছে কারণ সে সেটি সে নিজের কোনো ক্ষতি না করে বলতে পারে। অথবা আরো সুস্পষ্টভাবে: মারি ক্লদ দাবী করে সাবিনার লকেটটি কুৎসিত তার কারণ সে সুস্পষ্টভাবে সাবিনার লকেটটি কুৎসিত সেটি বলার ক্ষমতা সে রাখে।

এক বছর আগে মারি-ক্লদের গ্যালারীতে অনুষ্ঠিত সাবিনার প্রদর্শনীটি তেমন বেশী সফল হয়নি, সুতরাং সাবিনার কাছে মারি-ক্লদের কোনো পাওনা নেই, বরং সাবিনার বহু কারণ আছে মারি-ক্লদের সুনজরে থাকার জন্য। কিন্তু তার আচরণে সেটি প্রতীয়মান নয়। হ্যাঁ, ফ্রান্জ স্পষ্টই দেখতে পায়, মারি-ক্লদ এই সুযোগটি নিচ্ছে তাদের দুজনের মধ্যে সত্যিকার ক্ষমতার ভারসাম্যটা কোনদিকে ঝুঁকে আছে সেটি স্পষ্ট করে বোঝানোর জন্য।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য