বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, তৃতীয় পর্ব- ৭.১

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৪-১২ ০২:৫৬:৪৬

কাজী মাহবুব হাসান:

ভুল বোঝা শব্দগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত অভিধান (শেষাংশ) - ৭.১

আমস্টারডামের পুরনো চার্চ:  
রাস্তার এক পাশে সারি বেধে দাড়িয়ে আছে বাড়িগুলো, আর নীচ তলার দোকানের সামনের প্রশস্ত কাচের জানালার পেছনে বারাঙ্গনাদের ছোট ছোট কক্ষ , কাচের পেছনে বিলাসী বালিশে সাজানো চেয়ারে যেখানে তারা অন্তর্বাস পরে অপেক্ষা করে বড় কোনো বিরক্ত বিড়ালের মত।

রাস্তার অন্য দিকে দাড়িয়ে আছে  সুবিশাল একটি গথিক ক্যাথিড্রাল, যার নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছিল চতুর্দশ শতাব্দীর কোনো এক সময়ে।

বেশ্যাদের জগত আর ঈশ্বরের জগতে মাঝখানে, দুটি সাম্রাজ্যকে বিভেদ করা কোনো নদীর মত বিস্তৃত হয়ে আছে প্রস্রাবের তীব্র গন্ধ।

পুরনো চার্চের ভিতরে, গথিক শৈলীর যা অবশিষ্ট আছে তাহলো এর উঁচু, নগ্ন সাদা দেয়াল, ঋজু স্তম্ভগুলো, বিস্তৃত ছাদ এবং জানালাগুলো। দেয়ালে একটি ছবিও নেই, কোনো মূর্তিও নেই কোথাও। কোনো জিমনেশিয়ামের মতই শূন্য চার্চটি, শুধুমাত্র একেবারে মাঝখানে বর্গাকারে সাজানো কয়েক সারি চেয়ার যা ঘিরে আছে যাজকের জন্য ক্ষুদ্রাকৃতির একটি মঞ্চ। চেয়ারগুলোর পেছনে ধনী নাগরিকদের জন্য বিশেষভাবে নির্মিত কতগুলো কাঠের ছোটো বুথ আর বসার জায়গা।

চেয়ার আর স্টলগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে  যেন সেগুলো সাজানোর সময় দেয়ালের আকার কিংবা স্তম্ভগুলোর অবস্থানের প্রতি সামান্যতম নজর দেয়া হয়নি। গথিক স্থাপত্যের প্রতি যেন তারা তাদের ঘৃণা ও নির্বিকারতা প্রকাশ করছে। বহু শতাব্দী আগে ক্যালভিনিষ্ট মতবাদীরা এই ক্যাথিড্রালটিকে বিমান ছাউনির মত ফাঁকা একটি কক্ষে রূপান্তরিত করেছিল এর সব আড়ম্বর মুছে ফেলে, যার একটি মাত্র কাজ ছিল প্রার্থনা করার সময় বৃষ্টি আর তুষারপাত থেকে বিশ্বাসীদের নিরাপদে রাখা।  

ফ্রান্জে মুগ্ধ হয়েছিল এটি দেখে, ইতিহাসে একটি মহা মিছিল যেন এই সুবিশাল হলের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে!

সাবিনা স্মরণ করেছে কিভাবে কমিউনিস্টরা ক্ষমতা দখলের পর বোহেমিয়ায় সব দুর্গকে রাষ্ট্রীয়করণ করা হয় এবং সেগুলোকে রূপান্তর করা হয়েছিল হাতে কলমে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, বৃদ্ধ নিবাস এবং এমনকি কোথাও গরুর খোঁয়াড় হিসাবে। এধরনের একটি গরুর খোঁয়াড়ে তার একবার যাবার সুযোগ হয়েছিল। স্টাক্কো করা দেয়ালে হুক লাগানো হয়েছে গরুদের শিকল বাধার জন্য। রিঙ এর সাথে বাধা গরুগুলো স্বপ্নালু চোখে তাকিয়ে আছে জানালার বাইরে দুর্গের মাঠের দিকে, যা এখন দখল করে আছে অতিরিক্ত সংখ্যক মুরগী।

‘এই জায়গাটির শূন্যতা আমাকে মুগ্ধ করে’, ফ্রান্জ বলেছিল। ‘মানুষ পুজোর বেদী, মূর্তি, চিত্রকর্ম,চেয়ার, কার্পেট সংগ্রহ করে, আর তারপর একটি সময় আসে আনন্দপূর্ণ মুক্তির জন্য এবং তারা সব কিছু ছুড়ে ফেলে দেয় আগের রাতে খাবার টেবিলের আবর্জনার মত। তুমি কি শুধুমাত্র কল্পনা করতে পারছ না, যেন হারকিউলিসের বিশাল ঝাড়ু এই ক্যাথিড্রালের ভিতরে ঝাড়ু দিয়ে সব পরিষ্কার করছে’?

‘গরীবদের দাড়িয়ে থাকতে হয়, অথচ ধনীদের বসার জায়গা আছে’, স্টলের দিকে নির্দেশ করে সাবিনা বলে, ‘কিন্তু কিছু বিষয় আছে যা ব্যাঙ্কার আর গরীবদের একই সুতোয় বাধে: সৌন্দর্যের প্রতি ঘৃণা’। ‘সৌন্দর্য কি’? ফ্রান্জ বলে, এবং সে নিজেকে কল্পনা করে  তার স্ত্রীকে পাশে নিয়ে সাম্প্রতিক কোনো আর্ট গ্যালারীর প্রাক প্রদর্শনীতে, যেখানে যাবার জন্য তার উপর জোর খাটানো হতো।‘ বক্তৃতা, আর শব্দের সীমাহীন আত্মম্ভরিতা, সংস্কৃতি আর শিল্পকলার অহংকার’।    

যখন সাবিনা কমিউনিস্টদের স্টুডেন্ট বিগ্রেডে কাজ করতো,তার আত্মা বিষাক্ত হয়েছিল অতি আনন্দপূর্ণ মিছিল সঙ্গীতের দ্বারা, লাউড স্পিকার থেকে যেগুলো বের হয়ে আসতো অবিরামভাবে। এক রোববারে সে একটি মোটর সাইকেল  ধার করে পাহাড়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছিল, খুব দূরের ছোট একটি গামে এসে সে থামে, যেখানে এর আগে কখনোই আসেনি, গ্রামের চার্চের দেয়ালে মোটর সাইকেল হেলান দিয়ে রেখে সে ভিতরে প্রবেশ করেছিল। তখন রোববারের প্রার্থনাসভা চলছে। ধর্ম পালনকে নিষিদ্ধ করেছিল কমিউনিস্ট রাষ্ট্র, আর বেশীর ভাগ মানুষই তাই চার্চ এড়িয়ে চলতো।  চার্চের বেঞ্চে বসা মানুষগুলো কেবল বৃদ্ধ আর বৃদ্ধরা, কারণ তারা কমিউনিস্ট সরকারকে ভয় করে না, ভয় করে শুধুমাত্র মৃত্যুকে।

যাজক সুরেলা সুরে শব্দগুলো উচ্চারণ করছিলেন, আর উপস্থিত মানুষগুলো তাকে অনুসরণ করে একসাথে পুনরাবৃত্তি করছিল। একটি প্রার্থনা ( বা লিটানি), একই শব্দ বার বার ফিরে আসে, কোনো পথভ্রষ্ট পথিকের মত যে কিনা কোনো একটি গ্রামের দৃশ্য থেকে চোখ ফেরাতে পারেনা, অথবা এমন কোনো মানুষের মত, যে জীবন থেকে বিদায় নিতে পারছে না। বেঞ্চের শেষ সারিতে বসেছিল সাবিনা, চোখ বন্ধ করে সুর আর শব্দগুলো শুনতে শুনতে উপরে নীল ছাদে আকা বড় সোনালী তারাগুলো সে মুগ্ধ হয়ে দেখেছিল।

গ্রামের চার্চে অপ্রত্যাশিতভাবে সাবিনা যা সন্ধান পেয়েছিল সেটি ঈশ্বর ছিল না;  সেটি ছিল সৌন্দর্য। সে খুব ভালো করেই জানতো,  চার্চ কিংবা প্রার্থনা এই দুটোর কোনোটাই এর বিষয়ে কিংবা এককভাবে সুন্দর নয়, কিন্তু তারা সুন্দর যদি কোনো দালান নির্মাণের স্থলের সাথে তুলনা করা হয়, যেখানে সাবিনাকে তার দিন কাটাতে হতো দিনভর সঙ্গীতের বিশৃঙ্খল কোলাহলে।  রোববারের এই প্রার্থনা সভা সুন্দর কারণ এটি তার কাছে আবির্ভূত হয়েছিল  প্রবঞ্চিত একটি বিশ্বের  আকস্মিক আর রহস্যময় উন্মোচন হিসাবে।

সেই সময় থেকেই সে জানতো, যে সৌন্দর্য হচ্ছে বিশ্বঘাতকতার শিকার হওয়া একটি পৃথিবী। আর একটি মাত্র উপায়ে আমরা তার মুখোমুখি হতে পারি যদি এর নিপীড়নকারীরা কোথাও বিষয়টি উপেক্ষা করে থাকে। সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকে মে দিবসের প্যারেডের দৃশ্যের পেছনে। আমরা যদি এটি খুঁজে পেতে চাই, আমাদের অবশ্যই সেই দৃশ্যটা ভাঙ্গতে হবে।

ফ্রান্জ বলে, ‘এই প্রথম বারের মত কোনো চার্চ দেখে আমি মুগ্ধ হলাম’।

প্রোটেস্টান্টবাদ কিংবা কোনো কৃচ্ছব্রতও নয়, যা তাকে এত বেশী উৎসাহী করেছিল সে বিষয়টি ছিল অন্যকিছু, কিছু খুবই ব্যক্তিগত, সাবিনার সাথে যা আলোচনার করার মত সাহস সে রাখে না। ভেবেছিল যেন কোনো কণ্ঠস্বর সে শুনছে, যা তাকে নির্দেশ দিচ্ছে হারকিউলিসের ঝাড়ু হাতে নিতে আর মারি-ক্লদের সব আগাম প্রদর্শনী, তার সব সঙ্গীত শিল্পী, সব বক্তৃতা আর আলোচনা, অসার সব ভাষণ, দাম্ভিক শব্দাবলী - সব কিছু যেন সে ঝাড়ু দিয়ে তার জীবন থেকে বের করে দেয়। অ্যামস্টারডামের পুরনো চার্চে বিশাল শূন্য পরিসর তার সামনে আবির্ভূত হয় তার সামনে তার নিজের মুক্তির ছবির এক আকস্মিক আর রহস্যময় প্রত্যাদেশ হিসাবে।

আপনার মন্তব্য