প্লেটোর বানানা রিপাবলিক

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৪-২৭ ১৪:১১:৫৪

মাসকাওয়াথ আহসান:

বিপ্লব সকালে উঠে চা খায়, টিভির ব্রেকিং নিউজ দেখে, ফেসবুকের হোমপেজ স্ক্রল করে। কোন মতে ফেসবুকের নেশা ছুটিয়ে লগ আউট করে অফিসের দিকে রওনা হয়। অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফেসবুকের হোমপেজে দেখে রক্তাক্ত মৃতদেহ। অফিসের ব্যালকনিতে অস্থিরভাবে সিগ্রেট পোড়ায়। ব্যালকনিতে বসা কাকদুটো তারস্বরে কা কা করে। ছোটবেলায় কাককে এমন কা কা করে চেঁচাতে দেখলে দাদীমা এসে  হুশ হুশ করে তাড়িয়ে দিতেন। কাক নাকি অমঙ্গলের প্রতীক।

বিপ্লব এসব সংস্কার মানে না। কারণ কাক তো কাকের মাংস খায়না; মানুষ খায়। তাই বরং মানুষ ব্যা ব্যা বা ঘেউ ঘেউ করলে তাকে তাড়িয়ে দিতে ইচ্ছা করে। যতো অমঙ্গল তা তো মানুষই নিয়ে আসে।

সহকর্মী ফুজুল এসে বলে, বিপ্লব ভাই আমি একটু সালাত আদায় করে আসি। আপনি তো আর সালাতে যাবেন না। খালি দুনিয়াবি জিনিস নিয়ে ভাবছেন ব্রাদার; আখেরাতে এর জবাব দিতে হবে আপনাকে।

বিপ্লব স্মিত হেসে বলে, দেখো ফুজুল লোকজন পকেট ভর্তি টাকা নিয়ে এই দপ্তরে আসে। একটা ফাইল ছুটাতে পকেট খালি করে চলে যায়। সেই টাকা হজম করে আখেরাত মেরামত করতে তোমরা যেইখানে সালাত আদায় করো; সে জায়গাটা পবিত্রতা হারিয়েছে। ওখানে আমি যাবো কোন আক্কেলে। আমার মনের মসজিদটা তার চেয়ে পবিত্র। সেটা নিশ্চয়ই বোঝো।

ফুজুল কেটে পড়ে। বিপ্লব নিজের কিউবিক্যালে ফিরে আসে। ফেসবুকে যেতে ইচ্ছা করে না। এতো ছিন্ন ভিন্ন লাশ; এতো বীভৎস নরকযজ্ঞ; মনটা নৈরাশ্যের বিষাদ মেরুতে ম্রিয়মাণ হতে থাকে। হেডফোন লাগিয়ে একটু সেতার শোনে।

ফুজুল কোত্থেকে এসে আশেপাশে ঘুরঘুর করে। বুঝতে চেষ্টা করে কী শুনছে বিপ্লব। একটু পর গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, এই সব বেদাতি মিউজিক শুনলে আল্লাহ গুনাহ দেয়। বিপ্লব ভাই আপনি হাফ-হিন্দু হইয়া গেছেন। এখনো সময় আছে, দ্বীনের পথে আসেন।

--হোয়াই ডোন্ট ইউ জাস্ট শাট আপ!

কাঁচুমাচু করে ফুজুল ছিটকে চলে যায় নিজের কিউবিক্যালে। সাঁঝে একটা রিইউনিয়ন হবে। ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে। চারিদিকে মৃত্যুর মড়ক; এখন এটা না করলেও চলে; কিন্তু একটা বয়সের পর মানুষের খুব রিইউনিয়নের নেশা হয়। হোক ক্ষতি কী!

রিইউনিয়নের তোরণে বড় করে লেখা, বখতিয়ার ব্যাংক হিরণ্ময় মেলবন্ধন। মেজাজটা খিচড়ে যায় বিপ্লবের। সব জায়গায় স্পন্সর এই বখতিয়ারের ঘোড়া। টাকার কাছে কত সহজেই বিক্রি হয়ে যায় রিইউনিয়ন। ভেতরে ঢুকতেই তার প্রভাব স্পষ্ট হয়। মনে হয় সৌদি আরবের কোন অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছে সে। এইতো পনেরো বছর আগে যে রিইউনিয়নে ঢুকলে মনে হতো এমেরিকার কোন অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছে সেখানে আজ মোটামরফসিসের কারণে অনেক সৌদি নারীকে দেখা যাচ্ছে । বিপ্লব নিজের সংস্কৃতির জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করেছে; একটা রিইউনিয়ন অন্তত: আত্মপরিচয়ের উদঘাটন করুক; সে প্রত্যাশা আজ ভীষণ হাস্যকর।

বিপ্লবের দেখা হয় এক পুলিশ বন্ধুর সঙ্গে। ছেলেটা বামপন্থী রাজনীতি করতো। খুব ডেডিকেটেড কর্মী ছিলো। বিপ্লব তাই জিজ্ঞেস করে, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় তোমরা কী প্রস্তুত!

পুলিশ বন্ধুটি অবাক করে দিয়ে বলে, তোমরা সিভিল সোসাইটির বুদ্ধিজীবীরা কোথাও একটা ককটেল ফুটলেই বলো, সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটেছে।

এই সংলাপটি আইডেন্টিক্যালি মিলে যায় এক অফিস সহকর্মীর সঙ্গে। ভদ্রলোক এর আগের সরকারের আমলে হুবহু এই বাণী দিয়েছিলেন।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি তার বক্তব্যে বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থাকে নূরানি আলোয় দীপিত করতে হবে।

বিশেষ অতিথি বলেন, আমাদের ধর্ম হচ্ছে পরিপূর্ণ জীবন বিধান।

বোঝা যায় এই দুই একদা বিপ্লবীর গোটামরফসিস হয়েছে। অফিসের ফুজুলটাকে দোষ দিয়ে আর কী লাভ!

নিজের বিপ্লব নামটা বাদ দেয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই বিপ্লবের সামনে। যুগে যুগে বিপ্লব একটা ব্যবসা। প্রতিটি বিপ্লবে কিছু লোক আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়; ভুলে যায় সহযোদ্ধাদের। প্রতিপক্ষের সঙ্গে আদর্শিক ঐক্য তৈরি করে বিপ্লবী নেতারা বিপ্লবটাকে বেচে দেয়। যারা বিপ্লবে জীবন দেয় তাদের ছবিগুলো নিয়ে বছরের পর বছর বিপ্লবের সাফল্য বিপণন করে এইসব প্রধান অতিথি-বিশেষ অতিথিরা।

তীব্র বিরক্তি নিয়ে বিপ্লব বেরিয়ে আসে রিইউনিয়নের ওরস থেকে। হঠাত-ই এক বিপ্লবীর ভাস্কর্যের দিকে তাকাতেই মনে হয় যেন বিপ্লবীর পাথরের চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। বিপ্লব এগিয়ে গিয়ে টিস্যু দিয়ে মুছে দেয় পাথুরে চোখের অশ্রু। পেছন থেকে একটা চাপাতির কোপ পড়ে বিপ্লবের কাঁধে; শেষবারের মতো তাকিয়ে দেখে অফিসের জুনিয়র ফুজুল তার কয়েকজনকে নিয়ে দাঁড়িয়ে।

--বিপ্লব খুন কইরা জিহাদ কায়েম করলাম; সেইটাও একটা বিপ্লব। ডোন্ট মাইন্ড বিপ্লব ভাই।

বিপ্লব হত্যাকাণ্ডের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিপ্লব সাহেব কী লিখতেন; কী ভাবতেন খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

প্রগতিশীলেরা কেউ কেউ স্টেটাস দেয়, বিপ্লবের লেখালেখিতে তার ভাবসাব ভালো ঠেকে নাই। সে ছিলো সরকারবিরোধী।

ফুজুল তাদের জিহাদ ডট কমে বিপ্লব হত্যার দায় স্বীকার করে লিখে, আমরা একজন শত্রু খতম করেছি। কারণ সে অবিশ্বাসী ছিলো। এরকম বিপ্লবদের হত্যাকাণ্ড অব্যাহত থাকবে।

দক্ষিণপন্থী এক একটিভিস্ট ফেসবুকে লিখে, এই লোক সমকামী ছিলো কীনা কে জানে! ছি ভাবতেও ঘেন্না লাগে।

বিপ্লবের দু’একজন বন্ধু ফেসবুকে হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচারের জন্য ইভেন্ট ডাকলে গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা ফোন করে বলে, কী হয় এসব ইভেন্ট করে; নিজেকে নিজে আগে প্রিভেন্ট করেন।

বিপ্লব হত্যার দাবীতে তার বন্ধুরা সোচ্চার হলে তাদের ফেসবুক পোস্টে সরকারী দলের পাণ্ডারা এসে শাসিয়ে যায়। বিরোধী পক্ষের লোকেরা কবরের আজাবের ভয় দেখায়।

বিপ্লবের জানাজা হচ্ছে দেখে টিটকারি দেয়  বিচারক সমাজ, নাস্তিকের জানাজা, সমকামীর জানাজা; দিনে দিনে আরো কতো কিছু দেখতে হবে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, নাস্তিকতাই হোক আর সমকামিতা কোনটাই আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে যায়না।

মহা পুলিশ পরিদর্শক বলেন, আমরা ঘরে ঘরে বিপ্লবের নিরাপত্তা দিতে পারবো না। বিপ্লব নিজ দায়িত্বে রাখুন।

কেউ কেউ প্রশ্ন তোলে, বিপ্লবের খুনিদের ধরা হচ্ছে না কেন! বিপ্লব অবিশ্বাসী নাকি সমকামী তার সঙ্গে বিচার প্রক্রিয়ার কী সম্পর্ক।

এর উত্তরে এক প্রাকবৃদ্ধা সরকার দলীয় একটিভিস্ট নাতিদীর্ঘ গাভীর রচনা লিখে।

বিপ্লবকে দেখেছি প্রতিটি বিপ্লবের সময় স্টেজের পিছে দাঁড়িয়ে গাঁজা খেতে। আর বিপ্লব এতো টাকা পেলো কোথায়! পাঁচতারা হোটেলে সে ক্রিকেটার ক্রিস গেইলের মতো দুই-তিনটা গার্ল ফ্রেন্ড বাইসনের মতো ঘাড়ে নিয়ে ফূর্তিফার্তা করতো। এসব কথা ভাষায় প্রকাশ করা যায়না।

চারিদিকে বিপ্লবকে নিয়ে ছি ছি পড়ে যায়। বিপ্লবের সুহৃদেরা স্তব্ধ হয়ে যায়। বিপ্লবের খুন হওয়াটা বিপ্লবের অপরাধ হয়ে গেলো।

পুলিশ বিপ্লবের ঘর তল্লাশি করে কিছুই পায়না। তবে ফেসবুকের কিছু পোস্টে চলমান অন্যায়ের প্রতিবাদী স্টেটাস খুঁজে পায়। গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা টু প্লাস টু ইকুয়াল টু ফোর ফর্মুলায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানায়, বিপ্লব রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতায় যুক্ত ছিলো।

ফুজুল মাথায় পতাকা বেঁধে ছবি তুলে ফেসবুকে প্রোপিক ঝুলায়। কাভারে দিয়ে দেয় সরকার প্রধানের ছবি। সবাইকে খুশীর সংবাদ জানায়, তার চাচাতো ভাই জিহাদ ইউপি নির্বাচনে সরকারী দলের মনোনয়ন পেয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণার ছবি শেয়ার করে। প্রার্থী জিহাদ গলায় টাকার মালা পরে নির্বাচনী প্রচারণা করছে।

ঝুম ঝুম বৃষ্টিতে বিপ্লবের লাশ কবরে শুইয়ে দেয়া হয়। আকাশের কান্না দেখে বিপ্লব তাকে বৃষ্টি বলে। কোথাও থেকে যেন সেতারের সুর ভেসে আসে। সেই সুরের সাম্পানে বিপ্লব ভাসতে থাকে। বিপ্লব কে ছিলো; কী ছিলো এসব প্রশ্নের কলরোল থেমে গেলে সবাই পরবর্তী কোন বিপ্লবের মৃত্যুর অপেক্ষা করতে থাকে।

আপনার মন্তব্য