বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, চতুর্থ পর্ব: ১-২

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৫-১৬ ০৩:২৮:১৮

 আপডেট: ২০১৬-০৫-১৬ ০৩:২৯:২৭

কাজী মাহবুব হাসান:

আত্মা এবং শরীর

যখন তেরেজা বাসায় ফেরে, তখন প্রায় রাত দেড়টা। বাথরুমে গিয়ে, তার পাজামা পরে, সে টমাসের পাশে  শুয়ে পড়ে। টমাস ঘুমিয়ে ছিল। ঝুঁকে সে টমাসের মুখের উপর চুমু খায়, তার চুল থেকে ভেসে আসা অদ্ভুত একটি গন্ধ সে শনাক্ত করে।গন্ধটা আরো ভালোভাবে নেবার জন্য সে আরেকবার গভীর শ্বাস নেয় তার চুলের কাছে নাক এনে, তারপর আরো একবার। তেরেজা কুকুরের মত টমাসের চুল থেকে আসা গন্ধটা শোঁকার চেষ্টা করে যতক্ষণ না গন্ধটা কি সেটি সে উপলব্ধি না করতে পারে: কোনো এক নারীর যৌনাঙ্গের গন্ধ।

ভোর ছয়টায় ঘড়ির অ্যালার্ম বেজে ওঠে, তাদের পোষা কুকুর কারেনিনের সবচেয়ে আনন্দের সময় এটি। টমাস আর তেরেজার অনেক আগেই তার ঘুম ভেঙ্গে যায়, কিন্তু তাদের বিরক্ত করতে সে সাহস পায় না, অধৈর্য হয়ে সে অপেক্ষা করে অ্যালার্ম বাজার জন্য, কারণ এটি তাকে অধিকার দেয় বিছানায় টমাস আর তেরেজার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য, তাদের শরীর দাপিয়ে বেড়ানো জন্য, তার মুখ দিয়ে তাদের ধাক্কা দেবার জন্য। কিছুটা সময় তারা চেষ্টা করে তাকে থামাতে, বিছানা থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে, কিন্তু কারেনিন তাদের চেয়ে অনেক বেশী একগুঁয়ে এবং পরিশেষে তার অধিকারের কাছে নতি স্বীকার করতে হয়।

কিছুদিন হলো, তেরেজা অনুভব করে, আসলেই কারেনিনের দিনের শুরুর এই স্বাগতম জানানো আচরণটি সে উপভোগ করে। ঘুম থেকে জেগে ওঠাটাই কারেনিনের জন্য তীব্র আনন্দের একটি কাজ। সবসময়ই সে নিষ্পাপ আর সরল বিস্ময় প্রদর্শন করে আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছে এমন আবিষ্কারে।আন্তরিকভাবেই সে সন্তুষ্ট। অন্যদিকে তেরেজা ঘুম থেকে ওঠে অনিচ্ছা আর চোখ বন্ধ রেখে দিনটাকে প্রতিহত করার বাসনা নিয়ে।

এখন কারেনিন দাড়িয়ে আছে দরজার সামনের হলে, টুপি রাখার স্ট্যান্ডের দিকে তার চোখ, যেখানে তার গলা বাধার জন্য কলার আর বন্ধনী প্রস্তুত হয়ে ঝুলে আছে। কলারের মধ্য দিয়ে সে তার মাথাটি গলিয়ে দেয়  এবং এর পর তেরেজার সাথেই সে বাজার করতে বের হয়। তেরেজার প্রয়োজন কিছু দুধ, মাখন, রুটি এবং যথারীতি কারেনিনের দরকার তার মর্নিং রোল। কিছুক্ষণ পরেই দেখা যায় কারেনিন, তার মুখের মধ্যে রোলটি ধরে তেরেজার সাথে মহানন্দে হেটে যাচ্ছে, আর গর্বিত চাহনি দিয়ে তার চারপাশে সব কিছু দেখছে; কোনো পথিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার সফলতায় তাকে আমরা তৃপ্ত হতে দেখি। ঘরে ঢোকার পর, শোবার ঘরে দরজার সামনে সে রোলটা রাখে, অপেক্ষা করবে কখন টমাস তাকে লক্ষ্য করে। টমাস তাকে ভয় দেখিয়ে, মুখে আওয়াজ করে বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করবে তার কাছ থেকে রোলটা সে কেড়ে নেবে, এভাবে প্রতিদিনই ঘটনাটা ঘটে, ফ্লাটের সবকটি ঘর ঘুরে দুজনে কমপক্ষে পাঁচ মিনিট দৌড়াদৌড়ি করার পর অবশেষে কারেনিন টেবিলের নীচে বসে তার রোলটা মুখে পুরে দেয়।

এইবার, যদিও, সে তার সকাল বেলার নিত্য এই খেলাটির জন্য সে নিষ্ফল অপেক্ষায় কাটালো। টমাস তার ঠিক সামনে রাখা টেবিলে ছোট একটি ট্রানজিসটর রেডিতে গভীর মনোযোগের সাথে কিছু শুনছিল।


এটি চেক অভিবাসন সংক্রান্ত একটি প্রোগ্রাম, ব্যক্তিগত নানা কথাবার্তার একটি মন্তাজ যা এক চেক গুপ্তচর গোপন আড়িপাতা যন্ত্র দিয়ে রেকর্ড করেছে, যে কিনা প্রবাসী চেকদের গ্রুপে ছদ্মপরিচয়ে অনুপ্রবেশ করেছিল এবং তার তথ্য নিয়ে বিজয়ীর বেশে সে ফিরে এসেছে প্রাহাতে। পুরোটাই পূর্ণ তুচ্ছ কিছু কথোপকথনে, যার মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দখলকারী ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে কিছু কর্কশ শব্দ, কিন্তু কখনো কখনো সেখানে শুনতে পাওয়া যায় এক প্রবাসী আরেক প্রবাসীকে নির্বোধ বা প্রতারক বলে গালমন্দ করছে। এই তুচ্ছ মন্তব্যগুলোই ছিল সম্প্রচারের মূল বিষয়।

তারা যা প্রমাণ করতে চাইছিল তাহলো প্রবাসীরা যে শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নকেই গালমন্দ করছে না ( যা দেশের কাউকে বিস্মিত যেমন করবে না তেমনি মর্মাহতও করবেনা), কিন্তু তারা একজন আরেকজনকে গালি দিচ্ছে, নোংরা শব্দগুলোর মুক্ত ব্যবহার করছে। মানুষ সারা দিন ধরেই বহু নোংরা কথা বলে, কিন্তু যখন তারা রেডিও খোলে এবং কোনো পরিচিত ব্যক্তিত্ব- যাকে কিনা তারা শ্রদ্ধা করে, যে প্রতিটি বাক্যে অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে, কোনো না কোনোভাবে তারা নিজেদের হতাশ মনে করে প্রত্যাশা ভঙ্গের বেদনায়।

এর শুরু হয়েছিল প্রোশাজকাকে দিয়ে, টমাস বলে।

ইয়ান প্রোচাজকা, বছর চল্লিশের চেক ঔপন্যাসিক, ষাঁড়ের মত যার শারীরিক আর প্রাণশক্তি ছিল, ১৯৬৮ সালের বেশ আগে থেকেই তিনি রাষ্ট্রপরিচালনার নানা বিষয়ে সমালোচনায় সরব হয়েছিলেন। পরবর্তীতে যিনি প্রাগ স্প্রিং - সেই কমিউনিজমের সেই হতবিহবল উদারীকরণ যার সমাপ্তি ঘটেছিল রুশ আগ্রাসনের মাধ্যমে - এর একজন জননন্দিত চরিত্রে পরিণত হয়েছিলেন । আগ্রাসনের অল্প কয়েকদিন পরে সংবাদপত্রগুলো তার বিরুদ্ধে বিরূপ প্রচারণার শুরু করে, কিন্তু যতই তারা অপপ্রচার করেছে, মানুষ তত বেশী তাকে পছন্দ করেছে। তারপর (সুনির্দিষ্টভাবে ১৯৭০) চেক রেডিও প্রোচাজকা ও তার এক অধ্যাপক বন্ধুর মধ্যে ব্যক্তিগত কথাবার্তার ধারণকৃত নানা অংশ ধারাবাহিকভাবে প্রচার করতে শুরু করে, যে কথোপকথনটি ঘটেছিল দুই বছর আগে ( অর্থাৎ ১৯৬৮ সালের বসন্তে), অনেকদিন ধরেই, তাদের কেউ জানতেন না যে অধ্যাপকের ফ্ল্যাটটিতে আড়িপাতা যন্ত্র লাগানো ছিল, এবং তাদের প্রতিটি পদক্ষেপই অনুসরণ করা হচ্ছে। প্রোচাজকা তারা বন্ধুদের আনন্দ দিতে ভালোবাসতেন অতিরঞ্জন আর অতিশয়োক্তির মাধ্যমে। এখন তার সেই সব বাড়াবাড়ি সাপ্তাহিক রেডিও সম্প্রচারের বিষয়।রাষ্ট্রীয় গোপন পুলিশ, যারা এই অনুষ্ঠানটি প্রযোজনা আর পরিচালনা করেছেন, তারা বেশ পরিশ্রম করেছেন সেই ধারাবাহিকতার উপর বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করার জন্য, যে ধারাবাহিকতায় প্রোচাজকা তার বন্ধুদের নিয়ে ঠাট্টা করেছিলেন - দুবচেক, যেমন। মানুষ তাদের বন্ধুদের নিয়ে কোনো কিছু না ভেবেই কুৎসা করে, কিন্তু তারা ভীষণ আহত হয়েছিল তাদের প্রিয় প্রোচাজকার আচরণে এমনকি আরো ঘৃণ্য গোপন পুলিশের আচরণের চেয়ে।

টমাস রেডিওটা বন্ধ করে দেয় ও বলে, প্রতিটি দেশেরই নিজস্ব গোপন রাষ্ট্রীয় পুলিশ আছে, কিন্তু যে গোপন পুলিশের দল যারা এর রেকর্ডগুলো রেডিওতে সম্প্রচার করে - এমন কিছু শুধুমাত্র প্রাহাতেই হতে পারে, এমন কিছু যার কোনো পূর্বনিদর্শন নেই!

আমি অবশ্য একটি পূর্বনিদর্শন জানি’, তেরেজা বলে। ‘যখন আমার বয়স চৌদ্দ, আমি গোপনে ডায়রি লিখতাম, খুবই শঙ্কিত থাকতাম, কেউ যেন সেটা আবার পড়ে না ফেলে, সুতরাং ছাদের ঘরে সেটাকে লুকিয়ে রেখেছিলাম, কিন্তু আমার মা ঠিকই খুঁজে বের করেছিল সেটি । এবং একদিন রাতের খাবারের সময়, যখন আমরা সবাই সুপের বাটির উপর ঝুঁকে পড়ে স্যূপ খাচ্ছিলাম, আমার মা সেটি তার পকেট থেকে বের করে এবং বলে, ‘এখন খুব মনোযোগ দিয়ে সবাই শোনো!’, এবং প্রতিটি বাক্যের পর সে উচ্চস্বরে হেসে উঠছিল, সবাই এতো হাসাহাসি করছিল যে, কেউ খেতে পারছিল না’।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য