বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, চতুর্থ পর্ব: ৮-৯

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৬-১৬ ১৫:৩০:৩১

কাজী মাহবুব হাসান:


প্রেমের ভান করার মানে কি? কেউ হয়তো বলতে পারেন এটি এমন একটি আচরণ যা কারো মনে যৌন অন্তরঙ্গতা সম্ভব এমন একটি বিশ্বাসের জন্ম দিতে পারে, একই সাথে এটি সেই সম্ভাবনাকে অবশ্যম্ভাবী হওয়া থেকেও প্রতিরোধ করে। অন্যার্থে প্রেমের ভান হচ্ছে কোনো গ্যারান্টি ছাড়া যৌন মিলনের প্রতিশ্রুতি।

যখন তেরেজা বারের পেছনে দাড়িয়ে পরিবেশন করে, যাদের পানীয় সে ঢেলে দেয়, তারা তার সাথে প্রেম করার ভান করে। সে কি আসলে বিরক্ত হয় এই চাটুকারিতার অশেষ জোয়ার ভাটায়, দ্বৈত অর্থবোধক শব্দাবলী, নীরস কাহিনী, প্রস্তাব, হাসি এবং অর্থবহ চাহনিতে? মোটেও না, তার একটি অপ্রতিরোধ্য কামনা ছিল শরীরকে উন্মুক্ত করার ( সেই অচেনা শরীরটাকে যাকে সেই বিশাল এই পৃথিবীতে সে পরিত্যক্ত করতে চেয়েছিল তার আত্মা থেকে) স্রোতের এই ঢেউয়ের পশ্চাৎটানে।

টমাস তাকে বিশ্বাস করানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে যে তার ভালোবাসা আর সঙ্গম দুটি ভিন্ন জিনিস। সে বুঝতে অস্বীকার করে। এখন সে চারপাশেই পুরুষ দ্বারা পরিবেষ্টিত, যাদের প্রতি তার সামান্যতম আগ্রহ নেই। এদের সাথে সঙ্গম কেমন হতে পারে? পরীক্ষা করে দেখতে সে কামনা অনুভব করে, শুধুমাত্র সেই  নিশ্চয়তাহীন প্রতিশ্রুতি রূপে যাকে প্রেমের ভান করা বলে।

এমন কোনো কিছু ভেবে ভুল করা ঠিক হবে না : তেরেজা কিন্তু টমাসের উপর কোনো প্রতিশোধ নিতে চায়নি; শুধুমাত্র সে এই গোলকধাঁধা থেকে বের হবার একটি পথ খুঁজছিল। সে জানতো সে তার উপর একটি বোঝায় পরিণত হয়েছে, সবকিছুই খুব বেশী গভীরভাবে সে গ্রহণ করেছে, সবকিছুকেই রূপান্তর করেছে ট্রাজেডিতে এবং ব্যর্থ হয়েছে শারীরিক ভালোবাসার লঘুতা আর কৌতুকময় গুরুত্বহীনতাকে অনুভব করতে।কত মরিয়া হয়েই না সে কামনা করেছে সেই গুরুত্বহীন লঘুতাকে যদি সে শিখতে পারতো। সে কামনা করে কেউ তাকে সাহায্য করুক তার সময় অনুপযোগী খোলসটা থেকে বের করে আনতে।

যদিও কিছু রমণীর জন্য প্রেমের ভান করা তাদের দ্বিতীয় প্রকৃতি, গুরুত্বহীন প্রাত্যহিক কোনো কাজ হতে পারে, কিন্তু সেটি তেরেজার জন্য রূপান্তরিত হয়েছে গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসাবে, যার লক্ষ্য তাকে শেখানো, কে সে এবং কি করার ক্ষমতা আছে তার।কিন্তু এটিকে গুরুত্বপূর্ণ আর গম্ভীর করার মাধ্যমে, এর লঘুতাকে সে কেড়ে নিয়েছে, এটি আরোপিত, কষ্টসাধ্য, অতিরঞ্জন এমন কিছুতে রূপান্তরিত হয়েছে । প্রতিশ্রুতি আর নিশ্চয়তাহীনতার ভারসাম্যকে তেরেজা বিঘ্নিত করেছে।( ভারসাম্যটি যখন রক্ষা করা হয়, এটি প্রেমের ভান করার ক্ষেত্রে সিদ্ধিলাভের চিহ্ন)। খুব বেশী উৎসাহের সাথে তেরেজা প্রতিজ্ঞা করে সেই বিষয়টি স্পষ্ট না করেই যে, এই প্রতিজ্ঞা মানে তার পক্ষ থেকে কিছু পাবার নিশ্চয়তা নয়। এটি সেই বিষয়টিকে অন্যভাবে বলার মত, সে সবাইকে ধারণা দেয় যে তাকে যে কেউই নিতে পারে। কিন্তু যখনই পুরুষরা প্রতিক্রিয়া দেখায় সেই জিনিসটি চেয়ে যা তারা অনুভব করেছিলো তাদের দেয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, তারা শক্ত প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়, এবং তাদের কাছে এর একটিমাত্র ব্যাখ্যা হচ্ছে তেরেজা ছলনাপূর্ণ এবং বিদ্বেষপরায়ণ।

 ৯
একদিন, ষোল বছরের কাছাকাছি বয়সের এক কিশোর বারের টুলের উপর বসে বেশ কিছু উস্কানিমূলক বাক্য উচ্চারণ করে, সাধারণ কথোপকথনে যা প্রকটভাবে অনুভূত হয়, কোনো রেখাচিত্রের ভুল রেখার মত, যা যেমন মোছা যাবে না, তেমনি রেখাচিত্রের অংশ হিসাবে অব্যাহত রাখা যাবে না।

‘তোমার পা গুলো দারুণ!’

‘বাহ, তাহলে তুমি কাঠের ভিতর দিয়েও দেখতে পাও! তেরেজা পাল্টা জবাব দেয়।‘আমি তোমাকে রাস্তায় দেখেছি’, সে প্রত্যুত্তর করে, কিন্তু ততক্ষণে সেখান থেকে তেরেজা সরে যায় অন্য একজনকে পরিবেশন করার জন্য। যখন তার কাজ শেষ হয়, ছেলেটি একটি কনিয়াক অর্ডার করে। তেরেজা মাথা ঝাঁকায়। ‘কিন্তু আমার বয়স আঠারো’, সে প্রতিবাদ করে, ‘আমি তোমার পরিচয় পত্র দেখতে পারি’? তেরেজা বলে। ‘না,পারো না’, ছেলেটি উত্তর দেয়। ‘বেশ তাহলে একটা কোমল পানীয় দেবো?’, তেরেজা বলে। কোনো কিছু না বলে, ছেলেটি বারের টুল থেকে উঠে দাড়ায় এবং বের হয়ে যায়। আধা ঘণ্টা পর সে আবার ফিরে আসে। আরো বেশী প্রকটতর আচরণ সহ, বারের টুলে এসে বসে, তার নিঃশ্বাসে তখন যথেষ্ট পরিমাণ অ্যালকোহল, যা দশ ফুট ব্যাসের মধ্যে যে কেউই টের পাবে।‘ আমাকে সেই কোমল পানীয়টা এবার দাও’, সে নির্দেশ করে।

‘কেন? তুমি তো মাতাল!’ তেরেজা বলে। ছেলেটি পেছনের দেয়ালে ঝোলানো একটি নোটিশের দিকে ইঙ্গিত করে, অ্যালেকোহন মিশ্রিত পানীয় অপ্রাপ্তবয়স্কের পরিবেশন করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সেই নোটিশ থেকে হাত ঘুরিয়ে তেরেজাকে সে বলে, ‘আমাকে অ্যালকোহল পরিবেশন করা তোমার জন্য নিষিদ্ধ হতে পারে, কিন্তু মাতাল হওয়া আমার জন্য নিষিদ্ধ না’।

‘কোথায় তুমি এত মাতাল হলে’? তেরেজা তাকে জিজ্ঞাসা করে। ‘রাস্তার ওপারের একটা বারে’, সে বলে, হেসে, আবারো একটি কোমল পানীয় চায়।

‘বেশ, তাহলে সেখানেই বসে থাকলে না কেন তুমি’? ‘কারণ, আমি তোমাকে দেখতে চাই’, সে বলে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’,  তার মুখ অদ্ভুতভাবে বিকৃত হয়ে ওঠে এটি বলার সময়।তেরেজার বেশ সমস্যা হয় বুঝতে, সে কি তাকে পরিহাস করছে, কিংবা তার প্রতি ইঙ্গিত দিচ্ছে, নাকি ঠাট্টা করছে। অথবা সে এত বেশী মাতাল যে কোনো ধারণা নেই সে কি বলছে?

ছেলেটির সামনে কোমল পানীয়র বোতলটা রাখে, বারে বসে থাকা অন্যদের কাছে সে ফিরে যায়। মনে হয়, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ শব্দটা তার শক্তি নিঃশেষ করেছে, নীরবে সে পান করে, তারপর কাউন্টারের উপর টাকা রেখে বের হয়ে যায়, তেরেজার তার দিকে আবার তাকানোর সময় পাবার আগেই।

ছেলেটি চলে যাবার কয়েক মুহুর্ত পরে, একটি খাটো, টাকা মাথার মানুষ, যে তার তৃতীয় ভদকা পান করলে, তেরেজাকে বলে, ‘তোমার জানা উচিৎ অল্প বয়সী ছেলেদের মদ পরিবেশন করার বেআইনি’।

‘আমি তাকে অ্যালকোহল দেইনি, ওটা কোমল পানীয়।’

‘আমি দেখেছি তুমি ওটার মধ্যে মিশিয়ে দিয়েছো’।

‘কি বলছো তুমি’?

‘আমাকে আরেকটা ভদকা দাও’, টাক মাথা লোকটা বলে; এরপর সে যোগ করে, ‘তোমাকে আমি বেশ কিছু দিন ধরে লক্ষ্য করছি’।

‘তাহলে কেন কৃতজ্ঞ হচ্ছো না সুন্দরী মহিলার দৃশ্য দেখে এবং মুখ বন্ধ রাখতে’? বারে সব কিছু লক্ষ্য করার মত ঠিক সময়ে আসা একটা লম্বা লোক তাকে বলে।

‘তুমি এর মধ্যে নাক গলাতে এসো না’, চিৎকার করে টাক মাথার লোকটা, ‘তোমার কেন এত মাথা ব্যথা’?

লম্বা মানুষরা এবার তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আর তোমার কেন মাথা ব্যথা এই বিষয়ে যদি আমি জিজ্ঞাসা করি’?

তেরেজা টাক  মাথার লোকটাকে ভদকা দেয়, এক চুমুকে সে গিলে ফেলে, পয়সা দিয়ে সে চলে যায়।

‘ধন্যবাদ’, তেরেজা লম্বা লোকটাকে বলে। ‘তেমন কিছু না’, লম্বা মানুষটা বলে, সেও তার পথে চলে যায়।
[চলবে]

আপনার মন্তব্য