বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, চতুর্থ পর্ব: ১০-১২

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৬-২৬ ১১:৪৫:৪৭

কাজী মাহবুব হাসান:

১০
কিছুদিন পর, সেই লোকটি আবার বারে ফিরে আসে, তার দিকে তাকিয়ে তেরেজা হাসে, বন্ধুর মত, ‘আবারো তোমাকে ধন্যবাদ, টাক মাথার লোকটা প্রতিদিনই আসে আর খুব জ্বালাতন করে’।
‘তাকে পাত্তা দিও না’।
‘আমার ক্ষতি করার জন্য তার কেন এত ইচ্ছা হয়’।
‘সে তো বেশ মাতাল, কিছু মনে করোনা’।
‘বেশ যদি তুমি বলো’।
তেরেজার চোখের দিকে তাকায় লম্বা মানুষটি, ‘সত্যিতো, প্রতিজ্ঞা করলে?
‘করলাম’।
‘আমার ভালো লাগে শুনতে যে, তুমি আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করছো’, তেরেজার চোখে দিকে তাকিয়ে সে বলে।
প্রণয়কৌতুক অব্যাহত তখন: এই আচরণ অন্যকে উস্কানি দেয় বিশ্বাস করতে যে যৌন অন্তরঙ্গতা সম্ভাব্য, এমনকি যখন সম্ভাবনাটি নিজেই অবস্থান করছে তত্ত্বের জগতে, এখনও অপেক্ষার অনিশ্চয়তায়।
‘প্রাহার এই কুৎসিত অংশে তোমার মত সুন্দরী মেয়ে কি করছে’?
‘আর তুমি? প্রাহার এই কুৎসিত অংশে তুমি কি করছো’?
লোকটি তেরেজাকে জানায় কাছাকাছি কোথাও সে থাকে আর পেশায় একজন প্রকৌশলী, সেদিন কাজের পর  বাড়ী ফেরার পথে হঠাৎ করেই প্রথম বারের মত এই বারে ঢুকেছিল।

১১
যখন তেরেজা টমাসের দিকে তাকায়, তার চোখ টমাসের চোখের দিকে থাকে না, বরং তার দৃষ্টি আরো তিন বা চার ইঞ্চি উপরে কোনো একটি বিন্দুতে, তার চুলের মধ্যে,  যেখান থেকে সে অপরিচিত নারীদের যোনীর গন্ধ পেত।

‘আমি আর পারছি না, টমাস। আমি জানি আমার কোন অভিযোগ করা উচিৎ না। আমার জন্য তুমি প্রাহায় ফিরে আসার পর থেকেই, আমি নিজেকে কোনো কারণে ঈর্ষান্বিত হতে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছি। আমি ঈর্ষান্বিত হতেও চাইনা।মনে হয় আমি আসলে তেমন কিছু করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ শক্তিশালীও না। দয়া করে, আমাকে সাহায্য করো’!

টমাস তাকে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে এবং তাকে পার্কে নিয়ে যায়, বহু বছর আগে যে পার্কে তারা নিয়মিত হাটতে যেত। পার্কে লাল, নীল আর হলুদ রঙের বেঞ্চ আছে। তারা একটিতে বসে।

‘আমি তোমাকে বুঝতে পারছি, আমি জানি তুমি কি চাও, টমাস বলে, আমি সব কিছুর ব্যবস্থা করেছি, তোমার যা করতে হবে সেটি হচ্ছে পেট্রিন হিলে* উঠতে হবে’।

পেট্রিন হিল, তীব্র উৎকণ্ঠা অনুভব করে তেরেজা, কেন পেট্রিন হিল?

‘তুমি যখন উপরে উঠবে তখন দেখতে পাবে’।

পেট্রিন হিলে যাবার কথা শুনে সে খুবই উদ্বেগ বোধ করে। তার শরীর এত দুর্বল যে সে নিজেকে কোনোমতে বেঞ্চ থেকে ওঠাতে পারে। কিন্তু সে আসলেই টমাসের নির্দেশ অমান্য করতে অক্ষম।

নিজেকে সে জোর করে দাড় করায়। পেছন ফিরে তাকায়, তখনও টমাস বেঞ্চে বসে, তার দিকে তাকিয়ে আনন্দের সাথে হাসছে, হাত নাড়িয়ে তাকে সামনে এগোতে বলে সে।

১২
পেট্রিন হিলের নীচে আসে তেরেজা, প্রাহার ঠিক মাঝখানে সেই সবুজ স্তূপটি, জনমানবহীন দেখে সে খুব অবাক হয়। বিষয়টি বিস্ময়কর, কারণ অন্য সময়ে প্রাহার অর্ধেক মানুষ এখানে ভিড় করে। বিষয়টি তাকে উৎকণ্ঠিত করে, কিন্তু টিলাটি এত বেশী শান্ত আর এত বেশী স্বস্তিদায়ক যে পুরোপুরিভাবে এর আমন্ত্রণে সাড়া দেয় তেরেজা। উপরে ওঠার সময়, সে বেশ কয়েকবার থেমে পিছন ফিরে তাকায়, তার নীচে যে টাওয়ার আর ব্রিজগুলোকে দেখে, আকাশের দিকে পাথরে চোখ তুলে সেইন্টরা তাদের মুষ্টিবদ্ধ হাত ঝাঁকাচ্ছে; এটি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম শহর।

অবশেষে সে চুড়ায় পৌছায়, আইসক্রিম আর সুভেনির স্ট্যান্ড পেরিয়ে ( যাদের কোনোটাই ঘটনাক্রমে সেদিন খোলা ছিল না) ইতস্তত লাগানো কিছু গাছ সহ প্রশস্ত একটি ঘাসে ঢাকা মাঠ, মাঠে সে কিছু পুরুষকে দাড়িয়ে থাকতে লক্ষ্য করে, তাদের যত নিকটে আসে সে, ততই তার হাটার গতি মন্থর হয়। মোট ছয় জন সেখানে ছিল, সেখানে দাড়িয়ে অথবা এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করছিল গলফ খেলোয়াড়দের মত, যেমন অলসভাবে তারা পুরো কোর্সটিকে দেখে, নানা ধরণের ক্লাব নিয়ে ভাবে কোনটা ব্যবহার করবে, খেলার জন্য উপযুক্ত মানসিক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।

অবশেষে সে তাদের কাছাকাছি এসে পৌছায়। ছয় জনের মধ্যে, তিন জন তার মত একই কারণে সেখানে এসেছে, তারা সবাই অস্থির, মনে হচ্ছে সবাই আগ্রহী নানা ধরণের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার জন্য, কিন্তু নিজেদের বোকা হিসাবে উপস্থাপন করার ভয়ে চুপ করে আছে, শুধুমাত্র কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে এদিক সেদিক দেখছে।

অন্য তিনজনের শরীর থেকে যেন বিচ্ছুরিত হচ্ছিল নিজেদের অবনমিত করে সবাইকে অনুগ্রহ করার ইচ্ছা। তাদের একজন হাতে একটি রাইফেল, তেরেজাকে দেখে, সে ইঙ্গিত করে হাত নাড়ায়, হেসে বলে, ‘হ্যাঁ, এটাই সেই জায়গা’।

উত্তরে মাথা নাড়ায় তেরেজা, কিন্তু তারপরও চরমভাবে উদ্বিগ্নতা অনুভব করে।

মানুষটি আরো বলে, কোনো ধরনের ভুল এড়ানোর জন্য, ‘এটা তো তোমার নিজের ইচ্ছা, তাই না’?

না, বলাটা খুব সহজ হতো, না, এটা আমার কোনো ইচ্ছা না, কিন্তু সে টমাসকে হতাশ করার কথা ভাবতে পারেনা। অজুহাত বা ক্ষমা প্রার্থনার কি কারণই বা সে খুঁজে পেতে পারে বাড়ী ফিরে গিয়ে? ‘হ্যাঁ, অবশ্যই আমার নিজের ইচ্ছা’।

রাইফেল হাতে ধরা ব্যক্তিটি তার কথা অব্যাহত রাখে, ‘আমাকে ব্যাখ্যা করতে দাও কেন আমি এটা জানতে চাইছি। শুধুমাত্র সেই সময় আমরা এটা করি যখন আমরা নিশ্চিত হই, যে মানুষগুলো আমাদের কাছে আসে তারা তাদের নিজেদের ইচ্ছায় মরতে চাইছে। আমরা এটিকে একটা সেবা হিসাবে মনে করি’।

লোকটি তার দিকে এমন একটি প্রশ্নবোধক দৃষ্টি দিয়ে তাকায় যে তেরেজাকে তাকে আরো একবার আশ্বস্ত করতে হয়: ‘না, না, চিন্তার কিছু নেই, এটা আমার নিজস্ব ইচ্ছা’।

সে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি কি সবার আগে যেতে চাও’?

যেহেতু যতক্ষণ পারা যায় ততক্ষণ সে মৃত্যুটাকে ঠেকিয়ে রাখার ইচ্ছা পোষণ করছিল, সে বলে, ‘না, দয়া করে না, যদি সম্ভব হয়, আমি সবার শেষে যেতে চাই’।

‘তোমার যেমন ইচ্ছা’, এবং সে অন্যদের দিকে চলে যায়। তার কোনো সহকারীর হাতে অস্ত্র নেই; তাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে সেই সব মানুষগুলোর সেবা করা, যারা মরতে যাচ্ছে। তারা তাদের হাত ধরে মাঠের উপর দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যায়, প্রমাণিত হয় এই ঘাসের মাঠ আকারে আদৌ ছোট নয়, চোখে যতদূর দেখা যায় ততদুর অবধি বিস্তৃত। যে মানুষগুলোকে মারা হবে তাদের অনুমতি ছিল, মাঠে নিজস্ব যে কোনো একটি গাছ নির্বাচন করার জন্য। তারা প্রতিটি গাছের কাছে যায়, থেমে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখে, মনস্থির করতে পারেনা। দুজন একসময় খুব সাধারণ দুটি গাছ নির্বাচন করে। কিন্তু তৃতীয়জন কেবল হাটতেই থাকে, কোন গাছকেই তার কাছে তার মৃত্যুর জন্য উপযুক্ত ভাবতে পারেনা। সহকারীটি তাকে হাত ধরে পথ দেখাচ্ছিল ভদ্র আর সহনশীলতার সাথে, যতক্ষণ না অবধি শেষ মানুষটি একটি চমৎকার মেপল গাছ নির্বাচন করে।

 এরপর সহকারীরা তিনজনের চোখে কাপড় বেধে দেয়।

সুতরাং তিনটি মানুষ,  চোখ বাধা, মাথা আকাশের দিকে কাৎ করা, তিন গাছের সামনে তাদের পিঠ দিয়ে দাড়ায় সেই অসীম ঘাসের মাঠে।

রাইফেল সহ মানুষটি নিশানা ঠিক করে এবং গুলি চালায়। পাখিদের ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না, রাইফেলের সাথে শব্দ নীরব করার যন্ত্র যুক্ত। কোনো কিছু দেখার নেই, মেপলের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো মানুষটির মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া ছাড়া।

কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে রাইফেল সহ মানুষটা ভিন্ন দিকে নিশানা করে, অন্য আরেকজন নীরবে কুঁকড়ে যায়, কিছু মূ পরে (আবারো রাইফেল সহ মানুষটি একই জায়গায় দাড়িয়ে দিক বদলায়) তৃতীয় ব্যক্তিটিও মাঠের উপর পড়ে যায়।

টীকা:
* পেট্রিন হিল: চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাহার ঠিক কেন্দ্রে ভলটাভা নদীর তীরে একটি পাহাড় (উচ্চতায় ৩২৭ মিটার), পুরো পাহাড়টি একটি পার্ক। কাফকার গল্পেও এই পাহাড়ের বর্ণনা আছে।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য