বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, চতুর্থ পর্ব: ১৩-১৫

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৭-০৯ ১২:৪২:০৫

কাজী মাহবুব হাসান:

১৩
সহকারীদের একজন তেরেজার দিকে এগিয়ে আসে। তার হাতে গাঢ় নীল রঙের একটি ফিতা।

তেরেজা বুঝতে পারে লোকটি তার চোখে ফিতাটি বাঁধতে এসেছে । ‘না’, তেরেজা বলে, তার মাথা ঝাঁকিয়ে, ‘আমি দেখতে চাই’।

কিন্তু চোখে ফিতা বাঁধতে তার অস্বীকৃতি জানানোর সত্যিকার কারণ সেটি ছিল না। সে বিরোচিত সেই সব কোনো চরিত্রদের মত নয়, যারা ফায়ারিং স্কোয়াডের দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ । সে শুধুমাত্র মৃত্যুকে প্রলম্বিত করতে চেয়েছিল। একবার যখন তার চোখ ঢাকা হয়ে যাবে, সে মৃত্যুর পাশের ঘরেই পৌঁছে যাবে, যেখান থেকে তার ফিরে আসার কোনো উপায় নেই।

মানুষটি কোনো জোর করেনা তার উপর, শুধুমাত্র এগিয়ে এসে তার হাত ধরে। কিন্তু যখন তারা খোলা মাঠটি হেটে অতিক্রম করছিল, তেরেজা তার জন্য কোনো গাছ নির্বাচন করতে ব্যর্থ হয়। কেউ তার উপর জোর করেনি তাড়াহুড়ো করার জন্য, কিন্তু সে জানতো, তার আর পালাবার কোনো উপায় নেই। ফুলে ঢাকা একটি চেস্টনাট গাছ দেখে তার সামনে গিয়ে থামে তেরেজা।গাছের উপর হেলান দিয়ে দাড়িয়ে উপরের দিকে তাকায় সে।সূর্যের আলোয় ঝলমল করা পাতাগুলো দেখে, শহরের শব্দ শুনতে পায় সে, অস্পষ্ট এবং মধুর, বহু দূরে বাজা সহস্র বেহালার মূর্ছনার মত।

লোকটি তার রাইফেল উঁচু করে।

তেরেজা বুঝতে পারে তার সাহস সব হারিয়ে গেছে, তার দুর্বলতা তাকে হতাশাগ্রস্ত করে, কিন্তু সে কিছুই করতে পারে না তা প্রতিহত করতে। সে বলে, ‘কিন্তু এটা আমার নিজের ইচ্ছা না’।

সাথে সাথেই লোকটি রাইফেলের নল নামায়, এবং শান্ত স্বরে বলে, ‘যদি এটা তোমার ইচ্ছা না হয়, আমরা কাজটি করতে পারবো না, আমাদের সেই অধিকার নেই’।

দয়ালু কণ্ঠে সে বলে, যেন সে ক্ষমা চাইছে, যদি তার নিজের ইচ্ছা না হয় তাহলে তাকে গুলি করতে না পারার ক্ষমাহীনতার জন্য।তার কণ্ঠস্বর তেরেজার গভীরে কোনো কিছু স্পর্শ করে , গাছের কাণ্ডের দিকে মুখ ফিরিয়ে সে কেঁদে ফেলে।

১৪
সারা শরীর কান্নায় কাঁপতে থাকে তার, গাছটাকে সে জড়িয়ে ধরে যেন সেটি কোনো গাছ না, বরং বহু দিন আগে হারিয়ে ফেলা তার বাবা, কিংবা তার দাদা, যাকে সে কোনোদিনও দেখেনি, প্রপিতামহ, প্রপ্রপিতামহ, ধবল অতি বৃদ্ধ কোনো মানুষ সময়ের গভীর থেকে তার কাছে উঠে আসে, অসমৃণ গাছের বাকলে তার মুখের অবয়ব নিবেদন করে।

এরপর সে তার মাথা একপাশে ফেরায়, ততক্ষণে তিনজন বহু দুরে চলে গেছে।

গলফ খেলোয়াড়দের মত সবুজ গলফের মাঠে হাটতে হাটতে। যার হাতে রাইফেল ছিল, সে রাইফেলটা ধরে আছে যেন গলফ ক্লাব।

পেট্রিন হিল থেকে নেমে আসার পথে, সে কিছুতেই তার চিন্তা থকে সেই মানুষটাকে সরাতে পারছিল না, যার তাকে গুলি করার কথা ছিল, কিন্তু সে করেনি। ওহ.. তেরেজা কত তীব্রভাবে কামনা করছিল যেন কেউ তাকে সাহায্য করে, কারণ অবশেষে, টমাস করবে না। টমাস তাকে তার মৃত্যুর জন্য পাঠিয়েছে, কিন্তু অন্য কেউ তো তাকে সাহায্য করবে।

যতটাই সে শহরের কাছা কাছি হয়, ততটাই সেই রাইফেল হাতের মানুষটাকে কামনা করে, আরো বেশী সে টমাসকে ভয় পেতে শুরু করে। তার কথা না রাখার জন্য সে কখনোই তাকে ক্ষমা করবে না। কখনোই তার এই ভীরুতাকে সে ক্ষমা করবে না, তার বিশ্বাসঘাতকতাকে। যেখানে তারা বাস করে সে সেই রাস্তায় আসে।এবং বুঝতে পারে যে আর দুই এক মিনিটের মতে টমাসের সাথে তার দেখা হবে, তার সাথে দেখা হবার শঙ্কা আকে আক্রমণ করে, পেটের মধ্যে তীব্র যন্ত্রণাময় চাপ সে অনুভব করে, তার মনে হয় সে বমি করে ফেলবে।

১৫
ইঞ্জিনিয়ার তাকে তার ফ্ল্যাটে নিয়ে যাবার জন্য প্ররোচনা দেয়, প্রথম দুটি আমন্ত্রণ সে প্রত্যাখ্যান করলেও তৃতীয়টি গ্রহণ করে।

রান্নাঘরে দাড়িয়ে দাড়িয়ে তার স্বাভাবিক দুপুরের খাবার শেষে সে বের হয়, তখন প্রায় দুটো বাজে।

তেরেজা তার বাসার দিকে এগিয়ে যায়, বুঝতে পারে তা পা দুটো ক্রমশ ধীরে চলছে তাদের মর্জিমাফিক।

কিন্তু তারপর হঠাৎ করেই তার মনে হয় টমাসই তাকে এই লোকটার কাছে পাঠিয়েছে। সেকি তাকে বারবার বলেনি যে ভালোবাসা আর যৌনতার মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই? বেশ, সে শুধু তারা কথাগুলো পরীক্ষা করে দেখেছে, প্রমাণ করে দেখছে।সে প্রায় তাকে বলতেই শোনে,‘ আমি তোমাকে বুঝতে পারছি, আমি জামি তুমি কি চাও। আমি সব কিছুর ব্যবস্থা করে রেখেছি, উপরে ওখানে গেলেই তুমি দেখতে পাবে’।

হ্যাঁ, সে টমাসের নির্দেশই অনুসরণ করছিল।

বেশীক্ষণ সেখানে সে থাকবে না, এক কাপ কফির জন্য প্রয়োজনীয় সময়, যথেষ্ট দীর্ঘ সময় অ-বিশ্বস্ততার একেবারে সীমানায় পৌঁছালে কেমন লাগে।সে অনুভব করার জন্য, তার শরীরটাকে সীমানার বাইরে কিছুটা ঠেলে দেয়, সেখানে তা স্থির থাকে কিছু মুহূর্তের জন্য এবং তারপর যখন ইঞ্জিনিয়ার তাকে জড়িয়ে ধরতে চাইবে, তাকে সে বলবে, যেমন করে পেট্রিন হিলে রাইফেল হাতে মানুষটাকে সে বলেছিল, ‘এটি আমার নিজের ইচ্ছা নয়’। যা শুনে মানুষটি তার রাইফেলের নীচে নামিয়েছিল এবং শান্ত স্বরে বলেছিল, ‘যদি তোমার ইচ্ছা না থাকে, তাহলেও আমিও করতে পারবো না। আমার কোনো অধিকার নেই’। আর সে তার মুখ গাছের দিকে ফিরিয়ে কেঁদে ফেলেছিল।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য