বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, চতুর্থ পর্ব: ১৬-১৭

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৭-১৫ ১৩:৪৭:৫৭

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, চতুর্থ পর্ব
১৬
প্রাহার শ্রমিকদের এলাকায় এই ভবনগুলো বানানো হয়েছিল এই শতাব্দীর শুরুতে। সাদা চুনকাম করা ময়লা দেয়াল দিয়ে ঘেরা বড় একটি হলরুমে প্রবেশ করে তেরেজা; ক্ষয়ে যাওয়া লোহার হাতলসহ পাথরের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠে সে, এরপর বা দিকে ঘোরে, দ্বিতীয় দরজা তার গন্তব্য, কোনো নাম নেই, কোনো কলিং বেলও নেই। সে টোকা দেয়।

লোকটি দরজা খোলে।

পুরো ফ্ল্যাটে শুধুমাত্র একটি ঘর, পাঁচ কিংবা ছয় ফুট মত একটি জায়গাকে ঘরের বাকী অংশ থেকে আলাদা করে রেখেছে একটি পর্দা, এবং সেভাবেই এটি তৈরি করেছে এক ধরনের অস্থায়ী অভ্যর্থনা কক্ষ। সেখানে আছে একটি টেবিল, খাবার গরম করার একটি চুলা আর একটি ফ্রিজ ।পর্দার দেয়ালটি পার হলে লম্বা সংকীর্ণ একটি ঘরে শেষ মাথায় আয়তাকার একটি জানালার দিকে দৃষ্টি যায় তেরেজার, ঘরটির এক পাশের দেয়ালে বই দিয়ে সাজানো একটি শেলফ আর অন্য দিকে একটি ছোট বিছানা আর বসার জন্য একটি চেয়ার।

‘খুব সাদামাটা আমার ঘর’, প্রকৌশলীটি বলে, ‘আশা করি তুমি হতাশাবোধ করবে না’।

‘না, একদমই না’, দেয়ালের শেলফ ভরা বইগুলো দেখতে দেখতে তেরেজা বলে।লোকটির ঘরে কোনো পড়ার টেবিল নেই ঠিক, তবে শত শত বই। তেরেজার বইগুলো দেখে ভালো লাগে; যে চিন্তাগুলো তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছিল, তা কিছুটা কমে যায়। শৈশব থেকেই, সে বইকেই কল্পনা করে এসেছে গোপন ভ্রাতৃত্বের একটি প্রতীক হিসাবে - এই ধরনের লাইব্রেরী যে মানুষের আছে, সে সম্ভবত তার কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা।

লোকটি তাকে জিজ্ঞাসা করে সে কিছু পান করবে কিনা, ‘কোনো কিছু কি পান করবে, ওয়াইন’?

‘না, না, ওয়াইন না, কফি, যদি কিছু থাকে’।

পর্দার পেছনে লোকটা অদৃশ্য হয়ে যায়, তেরেজা তার বইয়ের শেলফের কাছে যায়, সাথেই সাথেই একটি বইয়ের উপর তার চোখে পড়ে, সফোক্লিসের ইডিপাস নাটকটি একটি অনুবাদ।বইটা এখানে খুঁজে পাবার ব্যাপারটা কত অদ্ভুত, বহু দিন আগে , টমাস বইটি তাকে দিয়েছিল,আর তেরেজা বইটা পড়ার পর, বইটা নিয়ে কথা বলা থামাতে পারেনি টমাস।এরপর পত্রিকায় টমাস তার ভাবনাগুলো লিখে পাঠিয়েছিল এবং আর সেই প্রবন্ধটাই টমাসের জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছিল। কিন্তু এখন শুধুমাত্র বইটার স্পাইন এর তাকিয়ে সে খানিকটা স্বস্তি অনুভব করে। এটি তাকে অনুভব করিয়েছে, টমাস যেন ইচ্ছা করেই কোনো চিহ্ন রেখে গেছে, এখানে তার উপস্থিতি যে তারই কর্ম - সেই বার্তাটি এটি বহন করছে।বইটা সে শেলফ থেকে নামিয়ে হাতে নেয়, খোলে, যখন দীর্ঘ দেহী প্রকৌশলী রুমে ফিরে আসে, সে তাকে জিজ্ঞাসা করে, এই বইটা কেন তার কাছে, সে কি বইটা পড়েছে, আর তার ভাবনাটি কি বইটা নিয়ে। এটি ছিল তার কথোপকথনকে আগন্তুকের ফ্ল্যাটের বিপজ্জনক ক্ষেত্র থেকে দিক পরিবর্তন করে টমাসের চিন্তার অন্তরঙ্গ জগতের দিকে ফেরানোর একটি কৌশল।

এরপর তেরেজা কাঁধে তার হাত অনুভব করে। লোকটি তার হাত থেকে বইটি নিয়ে কোনো কথা না বলে আবার শেলফে তুলে রাখে এবং তাকে বিছানার দিকে নিয়ে যায়।

আবারো তেরেজার সেই শব্দগুলোর কথা মনে পড়ে, পেট্রিন হিলের হত্যাকারীর কাছে সে যে শব্দগুলো ব্যবহার করেছিল, জোরে বলে উঠেছিল: কিন্তু কাজটি আমি স্বেচ্ছায় করছি না!

সে বিশ্বাস করেছিল যে এটি একটি জাদুকরী ফরমুলা তাৎক্ষনিকভাবে কোনো পরিস্থিতি বদলে দেবার মত যার শক্তি আছে, কিন্তু সেই ঘরে শব্দগুলো তাদের জাদুকরী শক্তি হারিয়ে ফেলে। আমার এমন কি মনে হয় তার এই শব্দগুলো লোকটিকে তার সংকল্পে আরো শক্তিশালী করে তুলেছিল: তেরেজাকে সে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে এবং তার স্তনের উপর হাত রাখে।

অদ্ভুত ভাবে, তার হাতের স্পর্শ সাথে সাথেই তেরেজার মনের সব দুশ্চিন্তাকে দুর করে।কারণ প্রকৌশলীর হাত তার শরীরকে ছুঁয়েছে এবং তেরেজা বুঝতে পারে যে সে ( তার আত্মা) এখানে আদৌ উপস্থিত নয়, শুধু তার শরীর, এখানে এই অভিজ্ঞতায় শুধুমাত্র যুক্ত হয়েছে তার শরীর ।যে শরীর তাকে প্রতারণা করেছে এবং যা সে পৃথিবীর আরো অনেক শরীরের মধ্যে পরিত্যাগ করেছে।

১৭
তেরেজার জামার প্রথম বোতামটা সে খোলে, এবং তেরেজাকে ইঙ্গিত দেয় বাকীটা খোলার জন্য। তেরেজা তার নির্দেশ মানে না। সে তার শরীরকে পৃথিবীতে ছুড়ে ফেলেছে, কোনো দায়িত্ব নিতে সে অস্বীকার করে। সে তাকে সহায়তাও করে না বাধাও দেয় না, এভাবেই তেরেজার আত্মা ঘোষণা করে যে যা ঘটছে সেটি সে মেনে নিচ্ছে না তবে সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে নিরপেক্ষ থাকার ।

যখন সে তার কাপড় খুলছিল তেরেজা প্রায় স্থির মূর্তির মত অনঢ়।যখন সে তাকে চুমু খায়, তার ঠোঁট কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে না। কিন্তু হঠাৎ করে তার যোনীর সিক্ততা সে অনুভব করে;তেরেজা ভয় পায়।

যে উত্তেজনা সে অনুভব করেছিল সেটি অনেক তীব্র, কারণ সে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তখন উত্তেজিত। ।অন্যভাবে বললে তার আত্মা প্রক্রিয়াটিকে উপেক্ষা করছে, যদিও গোপনে। কিন্তু সে আরো জানতো যদি তার উত্তেজিত হবার এই অনুভূতিটাকে অব্যাহত রাখতে হয়, তার আত্মার সম্মতিটাকে নিঃশব্দ করে রাখতে হবে। যে মুহূর্তে সে তার হ্যাঁ বেশ উচ্চস্বরেই বলবে, সেই মুহূর্তেই সে চেষ্টা করবে ভালোবাসার সেই দৃশ্যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করার জন্য, তখনই উত্তেজনা কমে যাবে। কারণ যা আত্মাকে এত উত্তেজিত করে তাহলো শরীর এর ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করছে, শরীর একে বিশ্বাসঘাতকতা করছে, এবং আত্মা যা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।

এরপর লোকটি তেরেজার শেষ অন্তর্বাসটিও টেনে খুলে ফেলে, তেরেজা তখন পুরোপুরি নগ্ন। যখন তার আত্মা তার উলঙ্গ শরীরটিকে দেখে এক আগন্তুকের বাহুবন্ধনে, বিষয়টি তার আত্মার জন্য এতই অবিশ্বাস্য ছিল যা অনেকটাই মঙ্গল গ্রহকে খুব কাছ থেকে দেখার মত। অবিশ্বাসের আলোয়, আত্মা প্রথমবারের মত শরীরকে সাধারণ কিছুর চেয়ে ভিন্ন কোনো কিছু হিসাবে দেখেছিল, প্রথমবারের মত সে শরীরের দিকে তাকিয়ে ছিল বিস্ময়ের সাথে: শরীরের সব অতুলনীয়, অননুকরণীয়, অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো হঠাৎ করে খুব দৃঢ়তার সাথে তাদের উপস্থিতি জানান দেয়। এটি খুব সাধারণ কোনো শরীরদের একটি নয় ( যেমন তার আত্মা সেই অবধি এটি মনে করে এসেছিল), আত্মা কিছুতেই তার চোখ সরাতে পারে শরীরের সেই জন্মদাগ থেকে, তার চুলে আবৃত ত্রিভুজের উপরে গোলাকার বাদামী সেই দাগ, সে জন্মদাগের প্রতি তাকায় যেন কোনো সিল মোহরের ছাপ, পবিত্র সীলমোহর যা শরীরের উপর চিহ্ন একে দিয়েছে এবং এখন একটি আগন্তুকের পুরুষাঙ্গ পবিত্রতা হরণকারী অশ্লীলতা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে।

প্রকৌশলীর মুখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে সে অনুধাবন করে, সে কখনোই তার শরীরকে অনুমতি দেবে না, যার উপর তার আত্মা সীলমোহরের চিহ্ন একে দিয়েছে, এমন কারো আলিঙ্গনে আনন্দ নেবার জন্য যাকে সে চেনে না এবং চিনতেও চায় না।উন্মত্ত একটি ঘৃণা তাকে পূর্ণ করে।মুখের মধ্যে কিছুটা লালা জমিয়ে সে আগন্তুকের মুখে থুতু হিসাবে ছুড়ে মারে। তেরেজা যেমন আগ্রহ সহ তাকে দেখেছিল, সেও তেরেজাকে লক্ষ্য করছিল, তার ক্রোধ লক্ষ্য করে, তেরেজার শরীরের উপর তার গতি সে আরো দ্রুত করে, বহু দুর থেকে তেরেজা অনুভব করে চরম উত্তেজনার মূহুর্তটি দ্রুত এগিয়ে আসছে, এবং সে চিৎকার করে, না,না, না, এটি প্রতিরোধ করার জন্য, কিন্তু বাধা পেয়ে, আটক, বের হবার কোন পথ বঞ্চিত হয়ে তীব্র সেই উত্তেজনাটি তার সারা শরীরে রয়ে যায়, মরফিনের ইনজেকশনের মতই তার শিরায় প্রবাহিত হয়। সে আগন্তুকের বাহুতে জোরো আঘাত করে, বাতাসে তার মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচু করে আঘাত করার চেষ্টা করে, তার মুখে আবার থুতু ছুড়ে মারে।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য