বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, চতুর্থ পর্ব: ১৮-২০

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৭-১৯ ০২:১৮:৫৮

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, চতুর্থ পর্ব
১৮
সাদা পদ্মফুলের মত মাটি থেকে যেন উঠে আসে আধুনিক টয়লেটের কমোডগুলো। স্থপতি তার পক্ষে করা সম্ভব এমন সব প্রচেষ্টাই করেন শরীরকে ভুলিয়ে দিতে যে কত তুচ্ছ সেটি, আর মানুষকে উপেক্ষা করাতে, কি হয় তার পেটের বর্জ্যগুলোর, যখন কমোডোর ট্যাঙ্কের জমানো পানি ড্রেইন অভিমুখে যা ভাসিয়ে নিয়ে যায়।এমনকি যদিও পয়োনিষ্কাষণের নল আমাদের ঘরগুলো থেকে বহু দুরে পাড়ি দেয় তাদের অসংখ্য শাখা প্রশাখা সহ, খুব সতর্কতার সাথে সেগুলো আমাদের দৃষ্টির আড়ালে লুকোনো থাকে। আমরা খুব আনন্দের সাথে অদৃশ্য মলের সেই ভেনিস সম্বন্ধে অজ্ঞ থাকি, যার অবস্থান আমাদের বাথরুম, শোবার ঘর, নাচার ঘর আর সংসদ ভবনের নীচে থাকে।  

প্রাহার শহরতলীতে শ্রমিক শ্রেণীর জন্য বানানো এই পুরোনো ফ্লাটের বাথরুমগুলো অপেক্ষাকৃত কম ভণ্ডামির সাক্ষ্য বহন করে:  ধুসর টাইল দিয়ে ঢাকা মেঝে. এবং এর থেকে যে কমোডটি বের হয়ে এসেছে সেটি চওড়া, অনুচ্চ আর কদর্য, এটি সাদা পদ্ম ফুলের মত দেখতে নয়। এটি আসলেই যা, ঠিক তার মতই দেখতে, পয়োনালির নলের প্রশস্ত শেষ প্রান্ত। এবং যেহেতু কোনো কাঠের আবরণী নেই, তেরেজাকে শীতল এনামেল প্রান্তেই  পা তুলে বসতে হলো।

তেরেজা তখন টয়লেটে বসে আছে এবং মল ত্যাগ করার তার হঠাৎ বাসনাই আসলে অপমানের চূড়ান্ত প্রান্ত অবধি যাবার একটি কামনা, পুরোপুরিভাবে শুধুমাত্র একটি শরীরে রূপান্তরিত হবার আকাঙ্ক্ষা। সেই শরীর যাকে তার মা বলতো, খাওয়া আর মল ত্যাগ করা ছাড়া আর কোনো কাজের না, এবং যখন সে মল ত্যাগ করছিল, তেরেজাকে তখন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল অনন্ত দুঃখ আর একাকীত্বের একটি অনুভূতি। পয়োনালির শেষ প্রান্তের উপর বসে থাকা তার নগ্ন শরীরের চেয়ে আর কোনো কিছু এত দুর্বিষহ হতে পারেনা।

তার আত্মা আগ্রহী দর্শকের সেই কৌতুহলটি হারিয়ে ফেলে, এর গর্ব আর ঘৃণাকে হারিয়ে ফেলে। আরো একবার সেই আত্মা তার শরীরের অভ্যন্তরে হারিয়ে যায়, তার অন্ত্রের গভীরতায়, উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করে  তার প্রতি কারো আহবানের জন্য।

১৯
সে কমোড থেকে উঠে দাড়ায়, ফ্লাশ করে, বের হয়ে সামনের ঘরটিতে মাঝখানে এসে দাড়ায়। তার শরীরের মধ্যে তখন তার আত্মাটি কাঁপছে, তার নগ্ন ,পরিত্যক্ত শরীরে। তখনও সে তার মলদ্বারের উপর টয়লেট পেপারের স্পর্শ অনুভব করে, যা সে ব্যবহার করেছিল নিজেকে মোছার জন্য।

এবং তারপর আকস্মিকভাবেই সেই অবিস্মরণীয় ঘটনাটি ঘটেছিল, হঠাৎ করেই সে আকাঙ্ক্ষা অনুভব করেছিল ঘরের ভিতরে গিয়ে লোকটির কণ্ঠস্বর, তার শব্দ শোনার জন্য। যদি সে তার সাথে নরম, গভীর স্বরে কথা বলে, তাহলে তার আত্মা সাহসী হবে, তার শরীরের উপরে আবারো বের হয়ে আসবে এবং সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে পারবে। সে তাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরবে, যেমন করে সে চেস্টনাট গাছটির কাণ্ডটি জড়িয়ে ধরেছিল তার সেই স্বপ্নে।

বাইরের ঘরটির মধ্যখানে দাড়িয়ে, তেরেজা লোকটির উপস্থিতিতে সশব্দে কেঁদে ওঠার শক্তিশালী ইচ্ছাটাকে দমন করার চেষ্টা করে। সে জানতো, এটি প্রতিরোধ করতে তার ব্যর্থতার পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর। সে এই লোকটির প্রেমে সে পড়ে যাবে।

ঠিক সেই সময়, লোকটির কণ্ঠস্বর ভিতরের ঘর থেকে তার নাম ধরে ডাকে;  আর এখন যেহেতু সে কণ্ঠস্বরটি শুনেছে শুধুমাত্র কণ্ঠস্বর হিসাবে ( প্রকৌশলীর দীর্ঘ শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন) এটি তাকে অবাক করে। খুব উচ্চ স্বরের এবং পাতলা সেই কণ্ঠস্বর। এই পুরোটা সময় জুড়ে বিষয়টি কেন একবারও তার নজরে আসেনি?

হয়তো শ্রুতিকটু সেই শব্দ শোনার বিস্ময়টি তাকে আরো প্রলোভন থেকে রক্ষা করেছিল। সে ভিতরে যায়, মাটি থেকে তার কাপড়গুলো তুলে নেয়, সেগুলো পরে ঘর থেকে বের হয়ে আসে।

২০
তার বাজার করার কাজ শেষ, তেরেজা এখন ফিরে যাচ্ছে বাসায়, কারেনিনের মুখে তার সেই চিরাচরিত রোল। খুব ঠাণ্ডা সকাল ছিল সেটি, খানিকটা তুষারও অনুভব করা যায়। একটি আবাসিক এলাকার পাশ দিয়ে তারা ফিরছিল, যেখানে দালানগুলোর মধ্যে অধিবাসীরা ছোট সবজী আর ফুলের বাগান করার চেষ্টা করেছে। হঠাৎ করেই কারেনিন চমকে দাড়িয়ে পড়ে এবং এক দৃষ্টিতে কোনো কিছু দেখতে থাকে।তেরেজা তাকায়,কোনো কিছুই তার অস্বাভাবিক মনে হয়না। কারেনিন তাকে টেনে ধরে রাখে, শুধুমাত্র তখনই তার চোখে পড়ে একটি কাকের মাথা বের হয়ে আছে খালি নরম মাটিতে, শরীরহীন মাথাটা উপর নীচে দুলছে, এর ঠোট থেকে মাঝে মাঝে বের হয়ে আসছে কর্কশ আর শোকার্ত গোঙ্গানি।

কারেনিন এত বেশী উত্তেজিত যে মুখ থেকে রোলটি ফেলে দেয়, একটা গাছের সাথে তেরেজা তাকে বেধে রাখে, যেমন সে কাকটার কাছে না যেতে পারে। এরপর সে হাটুগেড়ে বেসে মাটিতে চারপাশে মাটি তুলে গর্ত করার চেষ্টা করে কাকটিকে বের করে আনার জন্য, আশের পাশের মাটিগুলো খুব শক্ত করে চাপা হয়েছে পাখিটিকে জীবন্ত কবর দেবার জন্য। কাজটি খুব সহজ ছিল না। তেরেজা তার একটি নখ ভেঙে ফেলে, রক্ত বের হতে থাকে সেখান থেকে।

প্রায় একই সাথে পাশে একটি পাথর এসে পড়ে তার কাছে,  সেদিকে তাকালে তেরেজার চোখে পড়ে দুটি নয় বা দশ বছরের ছেলে, একটা দেয়ালের পেছন থেকে যারা উকি দিচ্ছে।তেরেজা উঠে দাড়ায়, তারা তাকে নড়তে দেখে, গাছের সাথে বাধা কুকুরটাকে দেখে তারাও দৌড়ে পালায়।

আরো একবার সে হাঁটু গেড়ে বসে মাটি খোঁড়ার চেষ্টা করে। অবশেষে সে সফল হয় কাকটিকে তার কবর থেকে বের করে আনার জন্য। কিন্তু কাকটি ছিল খোঁড়া, না পারে হাটতে বা উড়তে। তেরেজা তার গলা পরে থাকা লাল স্কার্ফটি দিয়ে সে এটিকে পেঁচিয়ে নেয়, শরীরের সাথে চেপে ধরে রাখে তার বা হাত দিয়ে, ডান হাত দিয়ে কারেনিনকে বাধন মুক্ত করে। তাকে বহু পরিশ্রম করতে হয় কারেনিনকে শান্ত করার জন্য, কথা শোনানোর জন্য।

চাবি ধরার মত কোনো হাত খোলা না থাকায় দরজায় ঘণ্টি বাজায় তেরেজা, টমাস দরজা খুলে দেয়। কারেনিনের বন্ধনীটি সে টমাসের হাতে ধরিয়ে দিয়ে, ‘ওকে ধরো’ শব্দটি উচ্চারণ করে।কাকটিকে নিয়ে সে বাথরুমে যায়। বেসিনের নীচের মেঝেতে সে তাকে রাখে, সামান্য একটু ডানা ঝাপটায়, কিন্তু এর বেশী সে নড়াচড়া করতে পারেনা। ডানার পাশ থেকে ঘন হলুদ একটা তরল থেকে বের হয়ে আসছে, ঠাণ্ডা মেঝের উপর পুরোনো কাপড় দিয়ে তেরেজা একটি বিছানা বানায়, মাঝে মাঝে পাখিটি তার পঙ্গু ডানাটি ঝাপটায় নিরাশভাবে এবং ঠোট উপরে তোলে যেন কাউকে সে নিন্দা জানাচ্ছে।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য