বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, চতুর্থ পর্ব: ২১-২৩

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৭-২৩ ১২:৫২:৩৩

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, চতুর্থ পর্ব ( আত্মা ও শরীর) : ২১-২৩
২১
গোছল করার ট্যাবের প্রান্তে স্থির হয়ে বসে থাকে তেরেজা, মৃত্যুপথযাত্রী কাকটির দিক থেকে কিছুতেই সে চোখ সরাতে পারেনা। এর একাকীত্ব আর বিষণ্ণতায় সে তার নিজের নিয়তির একটি প্রতিফলন দেখতে পায়, এবং নিজের জন্যই তেরেজা বেশ কয়েকবার উচ্চারণ করে, ‘টমাস ছাড়া এই পৃথিবীতে আমার আর কেউ নেই’।  

প্রকৌশলীর সাথে তার অভিযানটি কি তাকে শিক্ষা দিতে পেরেছে যে হঠাৎ অচেনা কোনো মানুষের সাথে এই যৌনসঙ্গমের সাথে ভালোবাসার কোনো সম্পর্ক নেই? কিংবা, সেটি খুব হালকা, নির্ভার? এখন কি সে অপেক্ষাকৃত শান্ত?

মোটেও না।

বার বার একটি দৃশ্য তার মনে পড়ে:  টয়লেট থেকে সে বেরিয়ে এসেছে এবং তার নগ্ন প্রত্যাখ্যাত শরীর নিয়ে সে দাড়িয়ে আছে সামনের ঘরটিতে। তার আত্মা কাঁপছে, শঙ্কিত, তার অন্ত্রের গভীরে সমাহিত হয়ে। যদি সেই মুহূর্তে ভিতরের ঘর থেকে পুরুষটি তার আত্মার প্রতি কিছু কথা বলতো, সে হয়তো কান্নায় ভেঙ্গে পড়তো, তাৎক্ষণিকভাবেই  সে তার বন্ধনে বাধা পড়তো।

সে কল্পনা করার চেষ্টা করে কেমন লাগতে পারে, যদি সামনের ঘরে দাঁড়ানো নারীটি টমাসের অনেক প্রেমিকার একজন হতো আর ভিতরের ঘরে বসা পুরুষটি যদি টমাস হতো। টমাসের শুধুমাত্র একটি শব্দ উচ্চারণ করার দরকার ছিল, একটি মাত্র শব্দ, নারীটি যা শুনে তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতো।

তেরেজা জানতো কি ঘটে সেই মুহূর্তে যখন ভালোবাসার জন্ম হয়: সেই কণ্ঠস্বরকে নারী প্রতিরোধ করতে পারেনা, যা তার ভীত সন্ত্রস্ত আত্মাকে আহবান করে বের করে নিয়ে আসে।পুরুষ পারেনা প্রতিরোধ করতে সেই নারীকে যার আত্মা তার কণ্ঠস্বরে এভাবেই সাড়া দেয়।ভালোবাসার এই প্রলোভনের বিরুদ্ধে টমাসের কোনো প্রতিরক্ষা নেই এবং তেরেজা প্রতিটি ঘণ্টার প্রতিটি মিনিট তার জন্য শঙ্কিত।

কিন্তু তার নিজের কাছেই বা কি অস্ত্র আছে?  বিশ্বস্ততা ছাড়া আর কিছুই না। আর সেটাই তেরেজা শুরু থেকে টমাসের কাছে নিবেদন করেছে, যেন সে খুবই সচেতন এটি ছাড়া তার আর কিছুই দেবার নেই। তাদের ভালোবাসার কাঠামোটি খুব অদ্ভুত অপ্রতিসাম্যতার: এটিকে ঠেকিয়ে রেখেছিল তেরেজার চূড়ান্ত মাত্রায় বিশ্বস্ততার নিশ্চয়তা,ঠিক যেমন করে সুবিশাল কোনো দালানের ভার বহন করে থাকে কোনো একক স্তম্ভ ।

বেশী সময় পার হবার সুযোগ হয়না, তার আগেই কাকটি তারা ডানা ঝাপটানো বন্ধ করে, তারা ভাঙ্গা বিকৃত হয়ে থাকা পায়ের আর কোনো কাঁপুনি চোখে পড়ে না, তেরেজা কিছুতেই কাকটি থেকে নিজেকে আলাদা করতে চায়না, যেন সে তার মৃত্যুপথযাত্রী বোনের শিয়রে দাড়িয়ে আছে। অবশেষে যদিও তাকে রান্না ঘরে যেতে হয়েছিল কিছু একটা খাবার জন্য।

যখন সে ফিরে আসে, কাকটি আর বেঁচে নেই।
 
 ২২
ভালোবাসার প্রথম বছরে, তেরেজা তাদের সঙ্গমের সময় চিৎকার করতো, চিৎকার, যেমনটি আমি আগেই বলেছিলাম, যার উদ্দেশ্য ইন্দ্রিয়গুলোকে অন্ধ ও বধির করে দেবার জন্য। সময়ের সাথে সাথে তার সেই চিৎকারেরে তীব্রতা কমে যায়, কিন্তু তার আত্মা তখনও অন্ধ ভালোবাসায়, আর কিছুই তার চোখে পড়েনা। প্রকৌশলীর সাথে ভালোবাসার অনুপস্থিতিতে সঙ্গম  অবশেষে তার আত্মার দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেয়।

সনাতে পরবর্তীতে সময় কাটানোর সময় আবারো তেরেজা আয়নার সামনে দাড়ায়, আর তার শরীরের দিকে তাকায়, শারীরিক ভালোবাসার দৃশ্যগুলো সে পর্যালোচনা করে যা সেই প্রকৌশলীর ফ্ল্যাটে ঘটেছিল। সে যা মনে করতে পারে সেটি তার ভালোবাসা না, বাস্তবিকভাবে, পুরুষটির বিবরণ দেওয়া তার পক্ষে রীতিমত কষ্টকর মনে হয়। সে হয়তো লক্ষ্য করেনি নগ্ন অবস্থায় পুরুষটি দেখতে কেমন ছিল। সে যা মনে করতে পারে ( এবং যা সে এখন লক্ষ্য করছে, কামোত্তেজিত হয়ে, আয়নার সামনে) সেটি হলো তার নিজের শরীর:  তার তলপেটের ত্রিভুজ এবং তার ঠিক উপরে একটি গোলাকার দাগ। সেই দাগটি, এতদিন অবধি যেটিকে সে সাধারণ জন্মদাগ হিসাবে চিহ্নিত করে এসেছে সে, সেটি তার চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে।বার বার সেটি দেখার জন্যে সে তাড়না অনুভব করে অচেনা পুরুষাঙ্গের অসম্ভাব্য নিকটে।

এখানে আবার আমাকে গুরুত্ব দিতে হবে, অন্য কোনো পুরুষের পুরুষাঙ্গ দেখার কোনো বাসনা তার ছিল না।সে শুধু তার নিজের ব্যক্তিগত অংশগুলো একটি অপরিচিত পুরুষাঙ্গের নিকটবর্তী দেখতে বাসনা অনুভব করেছিল।সে তার প্রেমিকের শরীর কামনা করেনি।সে তার নিজের শরীরকে কামনা করেছিল, সদ্য আবিষ্কৃত, অন্তরঙ্গ এবং অচেনা যা সবকিছু থেকে, অতুলনীয়ভাবে উত্তেজক।

গোছলের শাওয়ারের পানির বিন্দুর ফোটা ফোটা দাগে ভরা তার নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে, সে সেই প্রকৌশলীকে তার বারে বেড়াতে আসার বিষয়টি কল্পনা করা। ওহ, কিভাবেই না সে কামনা করেছে সে যেন আবার আসে, তাকে আবার নিমন্ত্রণ জানায় তার বাসায়, কত তীব্রভাবে সে সেটি চেয়েছিল।

২৩
প্রতিদিনই সে ভয় পেয়েছে আজ হয়তো প্রকৌশলী আসবে, এবং সে না বলতে পারবে না কিছুতেই। কিন্তু বেশ কিছু দিন পার হয়ে গেলে, সেই আসার ভয়টাই ধীরে ধীরে মিশে যেত সে আসবে না এমন আশঙ্কার সাথে।

মাস খানেক অতিক্রমণ হবার পরও প্রকৌশলীকে সেই বারে দেখা যায় না। তেরেজা বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে পারেনা। তার হতাশ কামনা অপসৃত হয়ে রূপান্তরিত হয় একটি অস্বস্তিকর প্রশ্নে: কেন সে এখানে আসতে ব্যর্থ হলো?

একদিন এক কাস্টমারকে পরিবেশন করার সময়, আবারো সেই টাক মাথার মানুষটার সাথে দেখা হলো তার, যে তাকে তিরস্কার করেছিল অপ্রাপ্তবয়স্ককে মদ পরিবেশন করার বানোয়াট অভিযোগে।উচ্চস্বরে সে কুৎসিত ঠাট্টা করছিল। যে কৌতুক তেরেজা শুনেছে হাজার বার, সেই ছোট শহরে, যেখানে সে বিয়ার পরিবেশন করতে এক সময়।আবারো তার সেই অনুভূতি হয়েছিল যে তার মায়ের জগতটা তার মধ্যে প্রবেশ করছে। হঠাৎ করেই টাক মাথার মানুষটাকে সে থামিয়ে দেয়।

‘আমি তোমার কোনো নির্দেশ মানার জন্য বাধ্য নই’, প্রত্যুত্তরে লোকটি বেশ রাগেই চিৎকার করে উঠলো। ‘তোমার কপালকে ধন্যবাদ দাও যে তুমি এই বারে কাজ করতে পারছো, আমরা তোমাকে এই বারে কাজ করতে দিচ্ছি’।

‘আমরা? ‘আমরা’ বলতে তুমি কাদের কথা বলছো’?

‘আমরা’, লোকটি বলে, ভদকার জন্য তার গ্লাসটি উঁচুতে তুলে ধরে।‘তোমার কাছ থেকে কোনো অপমান আমি সহ্য করবো না, বুঝেছো’? ‘ওহ, আরেকটা কথা’, সে যোগ করে, তেরেজার গলার দিকে ইঙ্গিত করে, সস্তা একটি মুক্তোর মালা যা ঘিরে ছিল, ‘কোথা থেকে ওটা তুমি যোগাড় করেছো? তুমি নিশ্চয়ই বলতে পারবে না যে তোমার স্বামী ওটা তোমাকে দিয়েছে, গরীব জানালা পরিষ্কারকারী, তার কোনো ক্ষমতা নেই এই উপহার দেবার। তোমার কোনো খদ্দের, তাই না? ভাবছি বিনিময়ে তুমি তাদের  কি দিয়েছিলে’?

তেরেজা চিৎকার করে বলে, ‘তোমার মুখ এক্ষুনি বন্ধ করো’।

কিন্তু লোকটি বলে চলে,‘ মনে রেখো যে পতিতাবৃত্তি একটি অপরাধ।’, সে নেকলেসটা খামচে ধরার চেষ্টা করে।

হঠাৎ করেই কারেনিন ঝাঁপিয়ে পড়ে, বারের উপর সামনের পা দুটো রেখে ক্রুদ্ধ গর্জন করে ।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য