বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, চতুর্থ পর্ব: ২৪-২৫

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৭-২৬ ১৩:৫২:২১

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, চতুর্থ পর্ব (আত্মা ও শরীর) : ২৪-২৫
২৪
তেরেজার সহকর্মী, চাকরীচ্যুত প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘লোকটা গোপন পুলিশের গুপ্তচর’।

‘তাহলে কেন সে বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলবে? যে গোপন পুলিশ তাদের নিজেদের গোপন রাখতে পারে না, তারা কি কোনো ভালো কাজ করতে পারে’?

রাষ্ট্রদূত তার বিছানায় আসন করে বসেন, যোগাসন করার ক্লাসে তিনি এভাবে বসতে শিখেছিলেন। মাথার উপরে দেখালে রাখা ফ্রেমে কেনেডি তার দিকে তাকিয়ে আছেন তার শব্দগুলোকে বিশেষভাবে আশীর্বাদপুষ্ট করার জন্য।

‘প্রিয় তেরেজা, গোপন পুলিশের বেশ কিছু কাজ আছে’, দয়ালু কণ্ঠেই তিনি শুরু করেন।‘ প্রথমটি ঐতিহ্যবাহী, মানুষ কি বলছে সেটা শোনার জন্য কান খোলা রাখা এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে সেটি রিপোর্ট করা’।

‘দ্বিতীয় কাজটি ভয় দেখানো সংক্রান্ত দমনমূলক। তারা চায় এমন একটি পরিস্থিতি যেন মনে হয় আমরা তাদের ক্ষমতার বলয়ে আছি, তারা চায় যেন আমরা ভয় পাই।এটাই তোমার টাক মাথার বন্ধুটি চায়’।

‘তৃতীয় কাজটি হচ্ছে এমন কিছু পরিস্থিতি পরিকল্পনা করে তৈরি করা যা আমাদের বিপদে ফেলে। সেই দিন শেষ, যখন তারা আমাদের অভিযুক্ত করার চেষ্টা করেছিল যে আমরা নাকি রাষ্ট্রের পতনের জন্য কাজ করছি। কারণ এমন কোনো অভিযোগ আমাদের জনপ্রিয়তাই কেবল বাড়াবে।এখন তারা আমাদের পকেটে হাসিস ঢুকিয়ে দেবে অগোচরে অথবা দাবী করবে বারো বছরের কোনো বালিকা ধর্ষণ করেছি। তাদের পক্ষে অবশ্যেই এমন কোনো মেয়ে খুঁজে বের করা সম্ভব যে কিনা তাদের এই মিথ্যা অভিযোগের পক্ষে সমর্থন দেবে’।

সাথে সাথেই প্রকৌশলীর বিষয়টি তেরেজার মনে প্রবেশ করে। কেন সে আর কখনোই ফিরে আসলো না?

‘তাদের প্রয়োজন মানুষকে ফাঁদে ফেলা’, রাষ্ট্রদূত বলতে লাগলেন, ‘সহযোগিতা করার জন্য তাদের বাধ্য করা আর অন্য মানুষদের জন্য ফাঁদ পাতা, যেন তারা ধীরে ধীরে সমস্ত জাতিকে গুপ্তচরদের একটি একক সংস্থায় পরিণত করতে পারে’।

প্রকৌশলীকে পুলিশই পাঠিয়েছে সেই সম্ভাবনা ছাড়া তেরেজা আর কিছুই ভাবতে পারেনা। আর অল্পবয়সী ছেলেটাই বা কে, যে মাতাল হয়ে পাগলের মত কথা বলছিল, তাকে বলেছিল সে তাকে ভালোবাসে? তার কারণেই টাক মাথার পুলিশটা তার বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করেছিল আর প্রকৌশলী তাকে পক্ষে দাঁড়িয়েছিল।তাহলে তারা তিনজনই কি আগে থেকেই পরিকল্পিত কোনো দৃশ্যে অংশ নিয়েছে, তাকে প্রতারিত হবার জন্য উপযোগি করে তুলতে!

কিভাবে বিষয়টি তার দৃষ্টি এড়িয়ে গেল? ফ্ল্যাটটি এত বেশী অদ্ভুত ছিল, দেখেই মনে হয় লোকটা এমন কোনো বাসায় থাকতে পারেনা কোনোভাবেই। কেনই বা চমৎকারভাবে কাপড় পড়া প্রকৌশলী এরকম বাজে একটা এলাকায় বসবাস করতে পারে? আসলেই কি সে প্রকৌশলী? এবং তাই যদি হয়, কিভাবে দুপুর দুটোয় সে কাজ বাদ দিয়ে সেখানে উপস্থিত ছিল। এছাড়া, কয়জন প্রকৌশলীই বা সফোক্লিস পড়েছে। না, ওটা কোনো প্রকৌশলীর লাইব্রেরী ছিল না।পুরো বাসাটারই এমন একটা রূপ, যেন এটি দখল করা হয়েছে দরিদ্র কোনো বন্দী বুদ্ধিজীবীর কাছ থেকে । তেরেজার বাবাকে জেলে বন্দী করা হয়েছিল যখন তার বয়স দশ, এবং রাষ্ট্র তাদের ফ্ল্যাট আর তার বাবার সব বই বাজেয়াপ্ত করেছিল।কে জানে সেই ফ্ল্যাটটিকে এখন কি কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে?

এখন সে স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারে, কেন সেই প্রকৌশলী আর কখনো বারে ফিরে আসেনি। সে তার মিশন সম্পন্ন করেছে। কোন মিশন? মাতাল ছদ্মবেশী গুপ্তচর নিজের অজান্তেই সেই তথ্যটি তাকে জানিয়ে দিয়েছে। এখন সেই স্বঘোষিত প্রকৌশলী সাক্ষ্য দিতে পারবে যে, তেরেজা তার সাথে মিলিত হয়েছিল এবং তার জন্য তেরেজা পারিশ্রমিকও চেয়েছে। তারা ভয় দেখাবে বিষয়টি প্রকাশ করে দেবার জন্য, যদি না সে রাজি হয় তার বারে আসা মাতাল মানুষগুলো কি বলছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সেটি তেরেজা যদি তাদের রিপোর্ট না করে।

‘চিন্তা করোনা’, রাষ্ট্রদূত তাকে সান্ত্বনা দেয়, ‘তোমার গল্পটা খুব বেশী বিপদজনক মনে হচ্ছে না’।

হালকা স্বরে তেরেজা বলে,‘ আমারও তাই মনে হয়।’

এরপর কারেনিনকে নিয়ে সে রাতের প্রাহার রাস্তায় বের হয়।

২৫
মানুষ সাধারণত তাদের সমস্যা থেকে পালাতে ভবিষ্যতে যায়, তারা সময়ের যাত্রাপথে কাল্পনিক রেখা আঁকে, যে রেখার ওপারে তাদের বর্তমান সমস্যাগুলোর আর অস্তিত্ব থাকেনা।কিন্তু তেরেজা, তার ভবিষ্যতে এমন কোনো রেখা দেখতে পায়না।শুধুমাত্র অতীতে দিকে তাকালেই সে সান্ত্বনা পায়। আবারো রোববার ছিল সেদিন, গাড়িতে উঠে প্রাহা থেকে বহু দুরে তারা অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য বের হয়।

টমাস গাড়ি চালায় আর তেরেজা তার পাশে, কারেনিন পেছনে, মাঝে মাঝে সে সে ঝুঁকে তাদের কান চেটে দিচ্ছে। দুই ঘণ্টা পর, তারা ছোট একটি শহরে এসে হাজির হয়, যা পরিচিত তার স্পা র জন্য যেখানে ছয় বছর আগে তারা একবার কিছুদিনের জন্য বেড়াতে এসেছিল। তারা সেখানে এক রাত থাকার কথা ভাবে।

শহরের মূল চত্বরের একপাশে গাড়ি রেখে তারা বের হয়। কোনোকিছুই বদলায়নি, তারা যে হোটেলে ছিল সেই হোটেলের সামনে দাড়িয়ে থাকে তারা। সেই একই পুরোনো লিনডেন গাছ এর সামনে দিয়ে উঠে গেছে, বা দিকে পুরোনো কাঠের খিলান যার শেষ মাথায় আছে একটা ঝর্ণাধারা, যে তার ঔষধি পানি পাথরের পাত্রে ছিটিয়ে দিচ্ছে। একই ভাবে উপুড় হওয়া মানুষের দল, হাতে একই গ্লাস।

কিন্তু যখন আবার টমাস হোটেলটির দিকে ফিরে তাকায়, সে লক্ষ্য করে আসলেই কিছু পরিবর্তন হয়েছে। যার আগে নাম ছিল গ্র্যান্ড, সেটি এখন নাম নিয়েছে: বৈকাল।বিল্ডিং এর কোনায় রাস্তার নামফলকের দিকে তাকায় সে: মস্কো স্কোয়ার এখন এটি। এর পর তারা হাটতে বের হয় ( কারেনিন তাদের পেছনে, কোনো বন্ধনী ছাড়াই), সেই সব রাস্তা দিয়ে যা তাদের পূর্বপরিচিত, তাদের নামগুলো পরীক্ষা করার জন্য, লেলিনগ্রাদ স্ট্রিট, রোস্তভ স্ট্রিট, নোভোসিবির্কস স্ট্রিট, কিয়েভ স্ট্রিট, ওডেসা স্ট্রিট, একটি চাইকোভস্কী স্যানিটোরিয়ামও আছে, একটি টলস্টয় সানিটোরিয়াম, একটি রিমস্কি-কোরসাকভ স্যানেটোরিয়ামও, একটি হোটেল সুভোরভ, একটি গোর্কি সিনেমা, আর একটি ক্যাফে পুশকিন আছে। সব নামই এসেছে রুশ ভূগোল আর ইতিহাস থেকে।

হঠাৎ করে তেরেজার আগ্রাসনের সেই প্রথম দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। মানুষ প্রতিটি শহরে রাস্তার সাইনগুলো নামিয়ে ফেলেছিল, হারিয়ে গিয়েছিল সাইন পোষ্টগুলো, এক রাতেই, পুরো দেশ হয়েছিল নামহীন।সাত দিন রুশ সেনা এদিক সেদিক ঘুরেছে, তারা জানতো না তারা কোথায়। অফিসাররা পত্রিকা অফিস খুঁজেছে, টেলিভিশন আর রেডিও স্টেশন খুঁজেছে দখল করার করার জন্য, কিন্তু তারা খুঁজে পায়নি।যখনই তারা স্থানীয়দের জিজ্ঞাসা করেছে, তারা হয় কাঁধ ঝাঁকানো দেখেছে, নয়তো ভুল নাম আর দিক নির্দেশনা পেয়েছে।

এখন বিষয়টি পশ্চাদদৃষ্টি দিয়ে ভাবলে মনে হয় এই নামহীনতাই খুব বিপদজনক ছিল দেশের জন্য। রাস্তা আর ভবনগুলো আর তাদের আগের নামে ফিরে যেতে পারেনি। ফলাফলে, চেক স্পা হঠাৎ করেই রূপান্তরিত হয়েছে ক্ষুদ্রাকারের কাল্পনিক রাশিয়ায় এবং যে অতীত খুঁজতে তেরেজা সেখানে গিয়েছিল, দেখা যায় সেটি এখন বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে।সেখানে রাত কাটানো তাদের জন্য এখন অসম্ভব।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য