বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, চতুর্থ পর্ব : ২৬-২৭

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৭-৩০ ১১:৫৫:৫৪

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, চতুর্থ পর্ব ( আত্মা ও শরীর) : ২৬-২৭
২৬
নীরবে হেটে তারা তাদের গাড়ির দিকে ফিরে আসে। তেরেজা ভাবছিল কিভাবে সব কিছু আর মানুষগুলো তাদের   জীবন কাটাচ্ছে ছদ্মবেশে। প্রাচীন একটি চেক শহর এখন ছেয়ে গেছে রুশ নামে।যে চেকরা রুশ আগ্রাসনের ছবি তুলেছিল তারা নিজেদের অজান্তেই কাজটি করেছে গোপন রাষ্ট্রীয় পুলিশের পক্ষে।যে মানুষটা তাকে মরতে পাঠিয়েছিল, সে লোকটা টমাসের মুখের মুখোশ পরে আছে তার নিজের মুখের উপর।গুপ্তচর অভিনয় করেছে এক প্রকৌশলীর, আর প্রকৌশলী চেষ্টা করছে পেট্রিন হিলের সেই মানুষটির ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য।তার ফ্ল্যাটে রাখা বইয়ের প্রতীক প্রমাণিত হয়েছে তাকে ভুল পথে পরিচালিত করার জন্য প্রতারণার একটি কৌশল হিসাবে।

সেদিন সেখানে হাতে ধরা বইটার কথা মনে করে  হঠাৎ করে তেরেজা একটি উপলব্ধি অনুভব করে, যা তাকে অপ্রস্তুত করে ফেলে। সেই দিনটার ঘটনাগুলোর ধারাবাহিকতা কি ছিল? প্রকৌশলী তাকে বলেছিল, সে কফি আনতে যাচ্ছে।আর সে বইয়ের শেলফের দিকে এগিয়ে যায় এবং সফোক্লিসের ইডিপাস বইটি হাতে নেয়। তারপর প্রকৌশলী ফিরে এসেছিল, কিন্তু কোনো কফি ছাড়াই!

বার বার সেই পরিস্থিতিতে সে ফিরে যায় তার চিন্তায়। কতক্ষণ ছিলনা লোকটি, যখন সে কফি আনবে বলে ঘর থেকে বের হয়েছিল? নিশ্চয়ই কমপক্ষে এক মিনিট, হয়তো দুই অথবা এমনকি তিন মিনিট, সামনের সেই ছোট ঘরে এতক্ষণ তাহলে সে কি করছিল? অথবা, নাকি সে টয়লেটে গিয়েছিল? সে দরজা বন্ধ করার আর কমোডে পানি ঢালার আওয়াজ মনে করার চেষ্টা করে। না, সে সুনিশ্চিত কোনো পানি ঢালার শব্দ সে শোনেনি, যদি শুনতো বিষয়টি তার মনে থাকতো। এবং সে প্রায় নিশ্চিত দরজাও কেউ বন্ধ করেনি।তাহলে লোকটি ঐ সামনের ঘরটিতে কি করছিল?  

এখনই শুধুমাত্র  সব কিছুই তার খুব স্পষ্ট মনে হচ্ছে। তাদের  যদি উদ্দেশ্য থাকে তাকে ফাঁদে ফেলার, তাহলে প্রকৌশলীর সাক্ষ্য ছাড়াও তাদের আরো বেশী কিছু লাগবে। তাদের কিছু অনতিক্রম্য প্রমাণ লাগবে। তার সন্দেহজনকভাবে দীর্ঘ সময় অনুপস্থিত থাকাকালীন, প্রকৌশলীই শুধুমাত্র পারে সামনের ঘরে একটা মুভি ক্যামেরা স্থাপন করতে, অথবা সম্ভাবনা বেশী যে কাউকে একটি স্থির ক্যামেরা নিয়ে সে ঘরে ঢুকিয়েছিল, পর্দার পেছন থেকে যে তাদের ছবি তুলেছে।

মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই প্রোশাজকাকে ঠাট্টা করেছিল, সে যে একটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আছে সেটা দেখতে ব্যর্থ হবার জন্য, যেখানে ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় কোনো অস্তিত্ব নেই, কিন্তু সে নিজেই কি সেটি করেছে? মায়ের বাসার ছাদের নীচ থেকে বের হবার পর পূর্ণ নিষ্পাপতায় সে ভেবেছিল চিরকালের জন্যই সে তার নিজের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার নিয়ন্ত্রক হতে পেরেছে। কিন্তু না, তার মায়ের ছাদ সারা পৃথিবী জুড়েই বিস্তৃত এবং কখনোই তাকে তার মত থাকতে দেবে না।তেরেজা কখনো তার কাছ থেকে পরিত্রাণ পাবে না।

বাগান দিয়ে ঘেরা সিঁড়ি বেয়ে যখন তারা আবার মূল চত্বরে ফিরে আসছিল, টমাস তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘কি হয়েছে তোমার’?

উত্তর দেবার আগেই, দুর থেকে কেউ চিৎকার করে টমাসকে শুভেচ্ছা জানায়।
 
২৭
পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সের একজন ব্যক্তি, রোদে বৃষ্টিতে পোড়া মুখ, খামারের শ্রমিক একজন, যার উপর টমাস একবার অস্ত্রোপচার করেছিল যখন হাসপাতালে চাকরী করতো, এবং বছরে একবার করে এই স্পা’তে তাকে আসতে হয় চিকিৎসার জন্য।সে টমাস আর তেরেজাকে নিমন্ত্রণ করে এক গ্লাস মদ পান করার জন্য তার সাথে। যেহেতু কিছু কিছু জায়গায় কুকুরের প্রবেশ আইনত নিষিদ্ধ, তেরেজা কারেনিনকে তাদের গাড়ীর দিকে নিয়ে যায়,  টমাস ও সেই ব্যক্তিটি কাছের কোনো ক্যাফেতে বসার জায়গা খোজার চেষ্টা করে। তেরেজা যখন ফিরে আসে তাদের কাছে, তখন লোকটি বলছিল, ‘আমরা খুবই শান্ত জীবন কাটাই। দুই বছর আগে এমনকি আমাকে একটি সমবায় সমিতির চেয়ারম্যান হিসাবে নির্বাচিত করা হয়েছে’।‘ অভিনন্দন’, টমাস বলে।

‘আপনি তো জানেনই কি পরিস্থিতি, সবাই শহরে আসার জন্য মরতেও প্রস্তুত। বড় সব কর্তারা, তারা খুশী হয় যখন কেউ গ্রামেই থাকতে চায়। কাজ থেকে সেকারণেই তারা কখনোই আমাদের বরখাস্ত করতে পারবে না’। তেরেজা বলে, ‘আমাদের জন্যও ব্যাপারটা আদর্শ হবে’।‘অসম্ভব সাদামাটা কিন্তু জীবন, বিরক্তি আর হতাশায় কাঁদতে হতে পারে ম্যাডাম, সেখানে কিছুই করার নেই, একেবারে কিছুই না’।

খামার শ্রমিকের রোদে বৃষ্টিতে পোড়া মুখের দিকে তাকায় তেরেজা, তাকে তার খুব দয়ালু মনে হয় তার। বহু বছর পরে প্রথমবারের মত কাউকে সে খুঁজে পেয়েছে যে খুব দয়ালু! গ্রাম্য জীবনের একটি চিত্র ভেসে উঠলো তার মনে: ঘণ্টার ঘর সহ গির্জা ঘিরে একটি গ্রাম, ক্ষেত, বন, খাদের মধ্যে ইতস্তত দৌড়ে বেড়ানো খরগোশ, সবুজ টুপি পরা এক শিকারি। তেরেজা কোনোদিনও গ্রামে থাকে নি। গ্রামের সেই দৃশ্য চিত্র পুরোটাই এসেছে তার পড়া কোনো বই থেকে অথবা শোনা কোনো বর্ণনা থেকে, অথবা অবচেতন মনেই সে তা পেয়েছিল দূরবর্তী পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে।কিন্তু তারপরও এটি তার মনে টিকে ছিল, স্বচ্ছ আর সাধারণ, পারিবারিক অ্যালবামে তার প্র-মাতামহীর আলোকচিত্রের মত।

টমাস তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনার কি সে জায়গাটায় এখনো কোনো অসুবিধা হয়’? কৃষকটি তার ঘাড়ের পিছনের একটি জায়গায় আঙ্গুল দিয়ে দেখায়, যেখানে মস্তিষ্ক স্নায়ুরজ্জুর সাথে সংযুক্ত থাকে। ‘এখানে এখনও মাঝে মাঝে আমার খুব ব্যথা হয়’।

চেয়ার থেকে না উঠেই জায়গাটা হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করে টমাস, তার আগের রোগীর উপর একটি সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা করে।‘ঔষধ লেখার আমার আর কোনো অধিকার আমার এখন নেই।’, পরীক্ষা শেষ করার পর সে বলে, ‘কিন্তু যে ডাক্তার আপনার দেখাশুনা করছে তাকে বলবেন আপনি আমার সাথে বলেছেন, আর আমি এটা আপনাকে ব্যবহার করতে পরামর্শ দিয়েছি’। ওয়ালেটে রাখা প্যাডের একটি কাগজ ছিলে বড় বড় অক্ষরে সেখানে একটি ঔষধের নাম লিখে দেয় টমাস।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য