বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, চতুর্থ পর্ব : ২৮-২৯

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৮-০৩ ০১:৫৭:০৩

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, চতুর্থ পর্ব ( আত্মা ও শরীর) : ২৮ ও ২৯
২৮
এরপর তারা প্রাহার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে।

সারাটা পথ ধরেই তেরেজা সেই প্রকৌশলীকে আলিঙ্গন করা তার নগ্ন শরীর প্রদর্শন করা আলোকচিত্রগুলোর কথা ভাবছিল। এই আলোক চিত্রের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই এমন ভাবনা  দিয়েই নিজেকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে এবং এমনকি যদি এধরনের কোনো ছবি থেকেও থাকে, টমাস সেটা কখনোই দেখবে না।শুধুমাত্রে  জোর করে কিছু কাজ আদায় করে নেয়া ছাড়া সেই ছবিগুলোর কোনো মূল্য নেই।যেই মুহূর্তে ছবিগুলো তারা টমাসকে পাঠাবে, সেগুলো তাদের মূল্যও হারাবে।

কিন্তু  কি হতে পারে যদি কোনো এক পর্যায়ে গোপন রাষ্ট্রীয় পুলিশ সিদ্ধান্ত নেয় তারা তাকে আর ব্যবহার করতে পারবে না? তাহলে ছবিটা তাদের হাতে একটা শুধুমাত্র খেলনার উপকরণ হিসাবেই রয়ে যাবে, কোনো কিছুই তখন তাদের বাধা দেবে না খামে ভরে সেটি টমাসের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে। শুধুমাত্র মজা করার জন্যে হলেও।

কি হতে পারে যদি টমাস এরকম কোনো একটি ছবি হাতে পায়? সে কি তাকে বাসা থেকে বের করে দেবে? হয়তো না। সম্ভবত না। কিন্তু তাদের ভালোবাসা ভঙ্গুর ভবনটি নিশ্চয়ই ভেঙ্গে পড়বে।কারণ সেই ভবনটি একটি মাত্র স্তম্ভের উপর ভর করে দাড়িয়ে, সেটি হচ্ছে তেরেজার বিশ্বস্ততা, এবং ভালোবাসা হচ্ছে সাম্রাজ্যের মত: যে ধারণার উপর ভিত্তি করে তারা গড়ে উঠেছিল, যখন সেটি ভেঙ্গে পরে, তারাও হারিয়ে যায়।

এবং এখন তার চোখের সামনে সে আরেকটি ছবি দেখতে পাচ্ছে: মাঠের খাঁজ বেয়ে দৌড়ানে খরগোশ, সবুজ টুপি পরা এক শিকারি, গ্রামে গির্জার ঘণ্টার ঘর একটি ছোট জঙ্গলের উপর মাথা তুলে দাড়িয়ে আছে।

সে টমাসকে বলতে চেষ্টা করে তাদের প্রাহা ছেড়ে চলে যাওয়া উচিৎ। মাটিতে জীবন্ত কাকদের কবর দেয়া সেই শিশুদের ফেলে, পুলিশের গুপ্তচরদের ছেড়ে, ছাতা হাতে সশস্ত্র তরুণীদের পেছনে ফেলে। তাকে সে বলতে চাইছিল ভিন্ন কোনো দেশে তাদের চলে যাওয়া উচিৎ। তার মুক্তির সেটাই একমাত্র পথ।

তেরেজা টমাসের দিকে তাকায়, কিন্তু টমাস কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না।সামনে রাস্তার উপর তার চোখ। তাদের মধ্য জমে থাকা নীরবতার দেয়ালটি এভাবে অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয়ে, একসময় সে কথা বলার সাহসই হারিয়ে ফেলে।পেট্রিন হিল থেকে হেটে নীচে নেমে আসার সময় তার যেমন লাগছিল, সেই একই রকম একটি অনুভূতি সে অনুভব করে।তার পেট গুলিয়ে ওঠে, মনে করে এখুনি সে হয়তো বমি করে ফেলবে।টমাসকে সে ভয় পায়। তার জন্য টমাস অনেক বেশী শক্তিশালী, সে ঠিক ততটাই দুর্বল, সে তাকে যা নির্দেশ দেয় সে বুঝতে পারেনা। সে সেগুলো পালন করার চেষ্টা করে, কিন্তু জানে না কিভাবে।

পেট্রিন হিলে সে ফিরে যেতে চায় এবং রাইফেল সহ মানুষটাকে সে বলতে চায় তার চোখে কাপড় পেঁচিয়ে বাধতে, এরপর তাকে চেস্টনাট গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ দেবার জন্য। সে মরতে চাইছে।

২৯
ঘুম ভাঙার পর সে বুঝতে পারে, বাসায় সে একা ।

বাইরে বের হয় তেরেজা, নদীর পাড়ে বাধ বরাবর  হাটতে শুরু করে। সে ভলটাভা নদীকে দেখতে চাইছিল। সে এর তীরে দাড়িয়ে পানির দিকে দীর্ঘক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকতে চেয়েছিল।কারণ এই প্রবাহের দৃশ্য প্রশান্তিদায়ক আর নিরাময়কারী।শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে নদীটি প্রবহমান, মানুষে কর্মকাণ্ড অতিবাহিত হয়েছে এর দুই তীরে, কিন্তু পরের দিন বিস্মৃত হয়েছে সেই সবই, কিন্তু নদী এখনও বহমান।

প্রান্তের বন্ধনীর উপর ঝুঁকে, সে নদীর পানির দিকে গভীরভাবে তাকে থাকে। সে প্রাহার উপকণ্ঠে দাড়িয়ে আছে।ভলটাভা ইতিমধ্যে শহরের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এসেছে, দুর্গ আর চার্চের শহরের মহিমাকে পেছনে ফেলে, নাটকের অনুষ্ঠান শেষে  কোনো অভিনেত্রীর মত, এখন সে ক্লান্ত, চিন্তামগ্ন। নোংরা পাড়ের মধ্য দিয়ে এটি প্রবাহিত হয়েছে, যার সীমানা তৈরি করেছে দেয়াল আর বন্ধনী  যারা নিজেরাই সীমানা তৈরি করেছে কারখানা আর পরিত্যক্ত খেলার মাঠের।

পানির দিকেই তাকিয়ে ছিল সে - এখানে যেন মনে হয় এটি আরো বিষণ্ণ আর অন্ধকার - হঠাৎ করেই সে একটি অদ্ভুত জিনিস দেখতে পারে নদীর ঠিক মাঝখানে, লাল কোনোকিছু - হ্যাঁ, একটা বেঞ্চ। লোহার পা সহ কাঠের বেঞ্চ, প্রাহার পার্কে যাদের প্রচুর দেখা যায়। এটি ভলটাভা দিয়েই ভেসে আসছে। তারপর আরো একটা,  এরপর আরো কয়েকটি, তখনই তেরেজা বুঝতে পারে প্রাহার পার্কের বেঞ্চগুলো উজান থেকে ভেসে আসছে, শহর থেকে বাইরে। অনেক অনেক বেঞ্চ, আরো বেশী, বনের শরতের পাতার মতই ভেসে আছে পানিকে - লাল, হলুদ, নীল।

 সে পেছন ফিরে তাকায় কোনো পথিককে জিজ্ঞাসা করার জন্য, এর মানে কি হতে পারে।কেন প্রাহার পার্কের বেঞ্চগুলো এভাবে উজান থেকে ভেসে আসবে? কিন্তু সবাই তাকে এড়িয়ে যায়। নির্বিকার, তাদের এই ক্ষণস্থায়ী শহরের মধ্যে দিয়ে যে শতাব্দীর পর শতাব্দী একটি নদী বয়ে যাচ্ছে সেই বিষয়ে আদৌ তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।

আবারো সে নদীর দিকে তাকায়। খু্বই কষ্ট হয় তার। বুঝতে পারে তেরেজা, সে যা দেখেছে সেটি আসলে একটি বিদায় সম্ভাষণ।

যখন বেশীর ভাগ বেঞ্চই দৃষ্টিসীমার বাইরে চয়ে যায়, কিছু বিলম্বে আসা বেঞ্চও দেখা যায়। আরো একটি হলুদ, এবং তারপর আরেকটা, শেষেরটা নীল।

(চতুর্থ পর্ব সমাপ্ত)
(চলবে)

আপনার মন্তব্য