আবুল হাসান : যিনি শুধুই কবিতা লিখতে পারতেন

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৮-০৪ ২০:০৫:১৫

 আপডেট: ২০১৬-০৮-০৪ ২১:০৯:৫৩

মাসুদ পারভেজ:

৪ আগস্ট ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি আবুল হাসানের জন্মদিন।

জীবনের নানান ঘাত-প্রতিঘাত স্বত্বেও আবুল হাসান শুধুই কবিতা লিখে গেছেন। ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও পড়ালেখা শেষ করার তাগিদ অনুভব করেন নি। কারণ তিনি মনে করতেন- কবিতা লেখার জন্য যতটুকু পড়ালেখা করা দরকার তা তিনি করেছেন। খেয়ে না খেয়ে কিংবা আধপেট খেয়েছেন কিন্তু কবিতা লেখা ছাড়েননি।

৬৯তম জন্মদিনে এ আপাদমস্তক কবিকে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই।  

আবুল হাসান যে শুধু কবিতা লিখতে পারতেন। তিনি ছিলেন শুধুই কবি। মানুষের দুঃখকে ধারণ করতে পেরেছেন আর মায়ামমতায় আচ্ছন্ন হয়েছেন। তাঁর কবিতায় আবেগ ছাড়িয়ে ফুটে উঠেছে সমকালীন প্রসঙ্গ স্লোগানধর্মী ভাষা এড়িয়ে তিনি লিখেছেন বাস্তবতার নিরিখে হেঁটেছেন। মধ্যষাটের দিকে আধুনিক বাংলা কবিতার যুবরাজ কবি আবুল হাসানের আগমন ঘটে। নান্দনিকতায় ভরপুর অনেক কবিতা লিখেছেন অবলীলায়। বাংলা কবিতার দুঃসময়ে তিনি এসেছিলেন ধ্রুবতারা হয়ে।

এক ধরনের প্রতিবাদ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন -

তোমাদের অনশন! তোমাদের অনশন! তোমাদের অনশন!
আর আমার ভাল্লাগেনা! আর আমার ভাল্লাগেনা! ভাল্লাগেনা!
এর ভেতরে আমি কে? আমি একজন নিঃসঙ্গ কবি, নিঃসঙ্গ...

সমাজের নানান স্তরে ছড়িয়ে থাকা ভণ্ডামি তিনি ধরিয়ে দিয়েছেন কবিতার মাধ্যমে। নগর সভ্যতার অবয়ব ফুটে উঠেছে তাঁর কবিতায় তাঁর সাথে গ্রাম বাংলার পটভূমির অনিন্দ্য সুন্দরের কথাও লিখেছেন কবিতায়। প্রতিবাদী ডঙে তিনি ভাঙতে চেয়েছেন সামাজিক প্রাচীর। প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়ার মধ্যেও তিনি তাঁর সমকালীন সমাজ, রাজনীতি, পারস্পরিক সমাজবাস্তবতা থেকে বিচ্যুত হননি।

ধরিত্রী কবিতায় তিনি লিখছেন –

পাতা কুড়োনির মেয়ে তুমি কী কুড়োচ্ছো?
ছায়া, আমি ছায়া কুড়োই!
পাখির ডানাসিক্ত সবুজ গাছের ছায়া, গভীর ছায়া একলা মেঘে কুড়োই, হাঁটি মেঘের পাশে মেঘের ছায়া ‘ছায়া কুড়োই!’-
পাতা কুড়োনির মেয়ে তুমি কী কুড়োচ্ছো?
মানুষ, আমি মানুষ কুড়োই।

আহত সব নিহত সব মানুষ কারা বাকস খুলে ঝরায় তাদের রাস্তাঘাটে, পুষ্প - তবু পুষ্পেভরা পুষ্প : তাদের কুড়োই আমি - দুঃখ কুড়োই!

কবি আবুল হাসানের অপর নাম দুঃখের কবি। নিদারুণ কষ্টে কেটেছে জীবন। সমালোচক আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, ‘চূড়ান্ত ব্যবচ্ছেদ করলে তার ভেতর মায়ামমতা, মানুষের জন্য দুঃখবোধ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যাবে না।’ তিনি ছিলেন শামসুর রাহমানের ভাষায় - ‘মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত কবি।’  তাঁর “মাতৃভাষা” কবিতায় ফুটে উঠেছে তাঁর অবয়ব, আশা হতাশার এক অবিচল সমীকরণ।

আমি জানি না দুঃখের কী মাতৃভাষা
ভালোবাসার কী মাতৃভাষা
বেদনার কী মাতৃভাষা
যুদ্ধের কী মাতৃভাষা
শুধু আমি জানি আমি একটি মানুষ
আর পৃথিবীতে এখনও আমার মাতৃভাষা, ক্ষুধা।

আবুল হাসান পরিব্রাজক ছিলেন ! তিনি খুঁজে ফিরেছেন নিজের সত্ত্বাকে। জীবন জিজ্ঞাসার পর্যায়ে তিনি লালনের কাছে শরণাপন্ন হয়েছেন।

“লোকটা যখোন নিঃসঙ্গ’”  কবিতায় তিনি উল্লেখ করেছেন –

ওহে দূর লালন ফকির। তুমি শোনো
আমার আরশীনগরে আজ আর নেই পড়শী কোনো – একা
বড় একা,
আমার বয়স স্বপ্ন, স্মৃতি দিয়ে লেখা এ্যালবাম সেও বড়
বদন প্রয়াসী।

নিজের অসহায়ত্ব তিনি প্রকাশ করেছেন নিঃসঙ্কোচে তাঁর সাথে যেন মিলে যায় অগণিত প্রাণ। দৃশ্যের বহিরঙ্গ ও তার অন্তর্গত প্রকৃতি, রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কৃতির অন্তর্গত মূল্যবোধ, দর্শন, সংকট, সেখানে ব্যক্তির অবস্থানের বিশ্লেষণ কবিতায় যথাযথভাবে করতে পেরেছে।

“পাখি হয়ে যায় প্রাণ” কবিতায় তিনি লিখেছেন –

দূরে বসে প্রবাহের অন্তর্গত আমি, তাই নিজেরই অচেনা নিজে
কেবল দিব্যতা দুষ্ট শোণিতের ভারা ভারা স্বপ্ন বোঝাই মাঠে দেখি
সেখানেও বসে আছে বৃক্ষের মতোন একা একজন লোক
যাকে ঘিরে বিশজন দেবদূত গাইছে কেবলি
শত জীবনের শত কুহেলী ও কুয়াশার গান!

এই কবিতার শুরুতেই তিনি বলেছেন - অবশেষে জেনেছি মানুষ একা, জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা


রাজনীতির করাল গ্রাস নিয়ে তিনি উদ্রেক প্রকাশ করেছেন কবিতায়। জীবনের ঘাত প্রতিঘাতে তিনি সহ্য করেছেন অজস্র বেদনা। তাই তাঁর কবিতায় দেখতে পাই হতাশা আর আক্ষেপ।

“অসভ্য দর্শন”  কবিতায় –

আমি পকেটে দুর্ভিক্ষ নিয়ে একা একা অভাবের রক্তের রাস্তায় ঘুরছি
জীবনের অস্তিত্বে মরছি রাজনীতি, তাও রাজনীতি আর
বেদনার বিষবাষ্পে জর্জরিত এখন সবার চতুর্দিকে খাঁ খাঁ খল

তীব্র এক বেদেনীর রূপে খেলা দেখছি আমি, রাজনীতি তাও কি রাজনীতি?

তার বিপরীতে তিনি যে আশার কথা বলেননি তাও কিন্তু নয় - “আলেখ্য” কবিতায় –

চে গুয়েভারার মতো দাড়িপূর্ণ ছবি
ঠোঁট তাম্রবর্ণ আদিবাসীদের মোটা সিগারেট!
অসম্পূর্ণ যুবক এক অনস্থির
তার বন্দুকের নলে ধ্রুব আত্মশক্তি
এত তীব্র ছিল!
বাহুতে ছিল পেশীকণা ছন্দে
বেজে ওঠে রাজদ্রোহী গর্জনের কাঠ! 

তিনি নানান অলিগলি পেরিয়ে সন্ধান করেছেন মানুষের নানান চিত্র। কবিতায় বারবার ফুটে উঠেছে সংশয়, আশা আর বাস্তবতার কথা। তিনি অরাজনৈতিক ডঙে রাজনৈতিক চেতনাবোধকে কবিতার বিষয়বস্তু করেছেন। রাজনৈতিক আবরণের কবিতাগুলোয় তিনি শব্দের পসরা সাজিয়েছেন আপন খেয়ালে। রাজনীতির সাথে তিনি একাত্ম হয়েছেন কবিতায়।

আবুল হাসানের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হলো, মানবমনের বিচিত্র গতিপ্রকৃতির রহস্য ভেদ করা; সেটা তিনি পেরেছেন নিঃসন্দেহে।

আপনার মন্তব্য