বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব : ১-২

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৮-০৫ ০৩:৩৮:২০

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব  ( নির্ভারতা এবং ভার ) : ১-২

তেরেজা যখন একবার অপ্রত্যাশিতভাবে প্রাহাতে টমাসের সাথে দেখা করতে এসেছিল, তারা শারীরিকভাবে মিলিত হয়েছিল, প্রথম পর্বে বিষয়টি আমি উল্লেখ করেছিলাম, ঠিক সেই দিনে, বরং বলা উচিৎ ঠিক সেই ঘণ্টায় হঠাৎ করেই তেরেজা জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল। টমাসের বিছানায় সে শুয়েছিল আর টমাস সারারাত ধরেই নজর রেখেছিল তার উপর।টমাসের সেই নিয়ন্ত্রণহীন অনুভূতি হয়েছিল যে, তেরেজা হচ্ছে একটি শিশু, যাকে নলখাগড়ায় বোনা ঝুড়িতে শুইয়ে নদীতে উজান থেকে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে তার কাছে।

এর পরিণতিতে পরিত্যক্ত শিশুর চিত্রকল্পটির তার খুব প্রিয় একটি বিষয়ে রূপান্তরিত হয়েছিল।এবং সে প্রায়ই  ভেবেছে সেই সব প্রাচীন পুরাণের কথা, যেখানে আমরা এই রকম কিছু ঘটে।আপাতদৃষ্টিতে এমন একটি ভাবনা মনে নিয়ে সফোক্লিসের ইডিপাসের একটি অনুবাদ সে হাতে নিয়েছিল।

ইডিপাসের গল্প সুপরিচিত: শৈশবেই পরিত্যক্ত হবার পর, তার আশ্রয় মেলে রাজা পলিবাসের ঘরে, যিনি তাকে ছেলে হিসাবে প্রতিপালন করেন। একদিন, যখন সে তরুণ, কোনো এক রাজ কর্মকর্তার সাথে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল পাহাড়ি একটি পথে, তর্কাতর্কির একটি পর্যায়ে সেই রাজ কর্মকর্তাকে ইডিপাস হত্যা করে। পরে সে রাণী জোকাষ্টার স্বামী ও থিবিসের রাজা হয়। তার বিন্দুমাত্র জানা ছিল না যে পাহাড়ি পথে যাকে সে হত্যা করেছে সে ছিল তার জন্মদাতা পিতা, যে রমণীর সে শয্যাসঙ্গী হয়েছে, সে তারই মা। ইতিমধ্যে, নিয়তি আবির্ভূত হয় তার প্রজাদের উপর মহামারী নিয়ে, রোগের তীব্রতায় তাদের অত্যাচারিত করে। যখন ইডিপাস উপলব্ধি করে সে নিজেই এই দুর্ভোগের কারণ, সে তার নিজের চোখ উপড়ে ফেলে এবং অন্ধত্ব নিয়ে চিরকালের জন্য থিবিস পরিত্যাগ করে।


যারা মনে করেন যে মধ্য ইউরোপে কমিউনিস্ট স্বৈরতন্ত্রগুলো শুধুমাত্র অপরাধীদের কাজ তারা একটি মৌলিক সত্যকে উপেক্ষা করেন: এই সব স্বৈরশাসনগুলো শুধুমাত্র অপরাধীরাই তৈরি করেনি বরং এগুলো অতি উৎসাহীদের দ্বারাও তৈরি, যারা স্থিরপরিকল্প ছিলেন যে স্বর্গে যাবার একমাত্র পথটি তারা খুঁজে পেয়েছেন।তারা সেই পথটিকে এত বেশী সাহসিকতার সাথে প্রতিরক্ষা করেছেন যে তারা বাধ্য হয়েছিলেন বহু মানুষকে হত্যা করতে। পরে বিষয়টি সুস্পষ্ট হয় যে আসলেই এটি কোনো স্বর্গ নয়, এবং সেকারণে এই সব অত্যুৎসাহীরা খুনি।

এরপর সবাই কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে চিৎকার করে প্রতিবাদ করতে শুরু করে: আপনারাই দায়ী আমাদের দেশের দুর্ভাগ্যের জন্য ( কারণ এটি তখন দরিদ্র আর আশাহীন দেশে পরিণত হয়েছে), এর স্বাধীনতা হারানোর জন্য (এটি তখন ছিল রুশদের দখলে), বিচারিক প্রক্রিয়ায় সংঘটিত অগণিত হত্যাকাণ্ডের জন্যে!

এবং অভিযুক্তরাও উত্তর দিয়েছিলেন:  ‘আমরা কিছু জানতাম না, আমরা প্রতারিত হয়েছি, আমরা ছিলাম সত্যিকার বিশ্বাসী!  হৃদয়ের গভীরে আমরা ছিলাম নিষ্পাপ!

পরিশেষে, এই বিতর্ক সংকীর্ণ হয়ে স্থির হয় একটি প্রশ্নে:  তারা কি আসলেই জানতো না, নাকি তারা শুধুমাত্র ভান করছে যে তারা আসলেই জানতো না?

টমাস এই বিতর্কটা খুব নিবিড়ভাবে অনুসরণ করেছিল ( যেমন করেছিল তার স্বজাতি আরো দশ লক্ষ চেক নাগরিকও), এবং তার মতামত ছিল, অবশ্যই যদিও এমন কিছু কমিউনিস্ট ছিলেন, যারা পুরোপুরিভাবে এইসব হত্যা আর  নিপীড়নের কথা জানতেন না  (অবশ্য তারা অজ্ঞ থাকতে পারেন না বিপ্লব পরবর্তী রাশিয়ায় ঘটা সেই সব ভয়ঙ্কর নিপীড়নগুলো সম্বন্ধে, যা ঘটেছে এবং এখনও ঘটছে), তবে সম্ভাবনা আছে সংখ্যাগরিষ্ঠ কমিউনিস্টরা বাস্তবিকভাবেই জানতো কি ঘটছে তাদের দেশে।

কিন্তু টমাস মনে করতো, বিষয়টি সম্বন্ধে তারা জানতেন কিংবা জানতেন না, সেটি মূল বিষয় না। মূল বিষয়টি হচ্ছে কোনো একটি মানুষ কি নির্দোষ হতে পারে কারণ তার জানা ছিল না বলে। সিংহাসনে বসে থাকা কোনো নির্বোধকে কি সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া যায় শুধুমাত্র সে নির্বোধ বলে?

আসুন মেনে নেই পঞ্চাশের দশকের শুরুর বছরগুলো কোনো চেক সরকারী উকিল যে কিনা বহু নিরপরাধ মানুষের জন্য মৃত্যুদণ্ড দাবী করেছিল, সে না হয় প্রতারিত হয়েছে রুশ গোপন পুলিশ ও তার নিজের দেশের সরকারের দ্বারা, কিন্তু এখন, যখন আমরা জানি এই সব অভিযোগই মিথ্যা, যারা মৃত্যুদণ্ড পেয়েছে তারা নির্দোষ ছিল, তখন কিভাবে সেই একই সরকারী উকিল বুক চাপড়িয়ে তার হৃদয়ের বিশুদ্ধতা দাবী করে বলতে পারেন, ‘আমার বিবেক পরিষ্কার! আমি জানতাম না। আমি বিশ্বাসী ছিলাম’!  যখন কিনা এই ‘আমি জানতাম না, আমি বিশ্বাসী ছিলাম’! এমন স্বীকারোক্তিগুলো তার অসমাধানযোগ্য অপরাধের ঠিক মূলে অবস্থান করছে ?

এই সংযোগটাই টমাসকে মনে করিয়ে দেয় ইডিপাসের সেই কাহিনীটিকে।ইডিপাস জানতো না সে তার মায়ের শয্যাসঙ্গিনী, কিন্তু যখনই সে অনুভব করেছে কি ঘটেছে তার সাথে, সে আর নিজেকে নিষ্পাপ মনে করেনি। তার দুর্ভাগ্যের দৃশ্যপট, যা কিনা সে নিজেই সৃষ্টি করেছিল তার অজান্তে, সে আর সহ্য করতে না পেরে নিজেকে অন্ধ করে ফেলে, অন্ধ হয়েই সে থিবিস থেকে বের হয়ে যায় চিরকালের জন্য।

যখন টমাস শুনেছিল কমিউনিস্টরা তাদের অন্তরের বিশুদ্ধতার সমর্থনে চিৎকার করছে, সে নিজেকে বলেছিল, আপনাদের এই না জানার কারণে, এই দেশ তার স্বাধীনতা হারিয়েছে, বহু শতাব্দীর জন্য সেটি হারিয়েছে হয়তো, আর আপনারা চিৎকার করে দাবী করছেন যে, আপনারা কোনো অপরাধবোধ ভুগছেন না? কিভাবে আপনারা আপনাদের কৃতকর্মের সামনে নির্বিকার দাড়িয়ে থাকতে পারছেন? কিভাবে আপনারা তা দেখে আতঙ্কিত না হয়ে থাকতে পারছেন? আপনাদের কি দেখার মত কোনো চোখ নেই? আপনাদের যদি চোখ থাকতো তাহলে আপনারা সেটি সেটি উপড়ে তুলে ফেলতেন আর থিবিস থেকে বের হয়ে যেতেন!

এই তুলনাটি তার এত পছন্দ হয়েছিল যে প্রায়ই সে এটি প্রায়শই ব্যবহার করেছে তার বন্ধুদের সাথে তার কথোপকথনে, এবং ধারণাটির সূত্রবদ্ধকরণ ক্রমশই আরো সুনির্দিষ্ট আর সূক্ষ্ম হয়ে উঠেছিল।

সেই সময়ের সব বুদ্ধিজীবীদের মতই. টমাস একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা পড়তো, যে পত্রিকাটির মোট তিন লক্ষ কপি প্রকাশ করতো চেক লেখক সমিতি । এটি এমন একটি সংবাদপত্র ছিল যা কিনা যথেষ্ট পরিমাণ স্বায়ত্তশাসন অর্জন করেছিল কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থার মধ্যে এবং অন্যদের জন্য নিষিদ্ধ বেশ কিছু বিষয় নিয়ে তারা আলোচনা করতে সাহস দেখাতে পারতো। পরিণতিতে এই লেখকদের পত্রিকাটাই প্রথম সেই বিষয়টি তুলে ধরে, কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের শুরুর দিকে রাজনৈতিক মামলাগুলোর মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়ায় যে সব হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছিল, কে সেই অপরাধের দায় গ্রহণ করবে?

এমনকি লেখকদের সেই পত্রিকাও শুধুমাত্র সেই একই প্রশ্ন পুনরাবৃত্তি করেছিল:  তারা কি জানতো, নাকি জানতো না? যেহেতু টমাস এই প্রশ্নটিকে যথাযথ মনে করেনি, একদিন সে বসে ইডিপাস নিয়ে তার নিজের ভাবনাগুলো লিখে ফেলে এবং পত্রিকাটিতে পাঠায় সেটি প্রকাশ করার জন্য। একমাস পরে সে উত্তরও পায়: সম্পাদনা অফিসে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যে সম্পাদক তাকে স্বাগত জানালেন তিনি খর্বকায় তবে স্কেলের মতই ঋজু। তিনি টমাসকে একটি বাক্যে শব্দগুলোর অবস্থান পরিবর্তন করতে বলেন। লেখাটা তারপর খুব শীঘ্রই প্রকাশিত হয়, শেষ পৃষ্ঠার ঠিক আগে, সম্পাদকের প্রতি চিঠিপত্রের সেকশনে।

টমাস অবশ্যই খুশী হতে পারেনি। তারা টমাসকে তাদের অফিসে ডেকে আনাটা জরুরী মনে করেছে শব্দের অবস্থান রদবদল করার জন্য অনুমতি চাইতে, কিন্তু তারপর, তাকে জিজ্ঞাসা না করেই তার লেখাটিকে এতটাই সংক্ষিপ্ত করেছে যে এটিতে মূল বিষয়টি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলনা (এটি রূপান্তরিত হয়েছে খুব বেশী রূপরেখা নির্ভর আর আক্রমণাত্মক একটি লেখায়)।লেখাটিকে তার আর ভালো লাগেনি।

এই সব কিছু ঘটেছে ১৯৬৮ র বসন্তে, আলেক্সণ্ডার দুবচেক যখন ক্ষমতায়, সেই সব কমিউনিস্টদের সাথে যারা অপরাধবোধে ভুগছিল এবং অপরাধবোধের জন্য তারা কিছু একটা করতে আগ্রহীও ছিল। কিন্তু অন্য কমিউনিস্টরা যারা  চিৎকার করেছিল, নিজেদের নির্দোষ দাবী করে, তারা ভয় পেয়েছিল ভেবে যে,  ক্রুদ্ধ জাতি হয়তো তাদের এবার বিচারের কাঠগড়ায় দাড় করাবে। তারা প্রতিদিনই রুশ রাষ্ট্রদূতের কাছে অভিযোগ করা অব্যাহত রেখেছিল, তাদের পক্ষে সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যে। যখন টমাসের চিঠি প্রকাশিত হয়, তারা চিৎকার করে বলে: দেখেছো, পরিস্থিতির কি অবস্থা, এখন তারা আমাদের প্রকাশ্যেই বলছে আমাদের চোখ উপড়ে ফেলে দিতে।

দুই বা তিন মাস পরে রুশরা সিদ্ধান্ত নিলো যে সব ধরনের বাকস্বাধীনতার কোনো প্রবেশাধিকার নেই তাদের ‘গুবেরনিয়ায়’ (রুশ নিয়ন্ত্রণাধীন প্রদেশ), এবং এক রাতেই তারা টমাসের দেশে দখল করে নেয় তাদের সেনাবাহিনী দিয়ে।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য