বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব : ৫

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৮-১৭ ০০:২০:৫৪

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব (নির্ভারতা এবং ভার)

হাসপাতাল থেকে টমাসের চাকরী চলে যাবার পর প্রথমে প্রাহা থেকে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দুরে একটি গ্রামের ক্লিনিকে সে কাজ পেয়েছিল। প্রতিদিন ট্রেনে তাকে যাতায়াত করতে হতো, আর বাসায় ফিরত হতো চূড়ান্ত ক্লান্ত হয়ে। এর এক বছর পর, টমাস প্রাহার শহরতলীর একটি ছোট ক্লিনিকে খানিকটা সুবিধাজনক তবে আরো নিম্ন পদে একটি কাজ যোগাড় করতে সক্ষম হয়। সেখানে অবশ্য সে শল্য চিকিৎসক হিসাবে কাজ করতে পারেনা, সাধারণ চিকিৎসকে রূপান্তরিত হয়। রোগীর চাপ ছিল সেখানে তীব্র, ওয়েটিং রুমে সবসময়ই উপচে পড়া ভিড়, কোনো রোগীকে পাঁচ মিনিটের বেশী সময় দেয়া ছিল অসম্ভব। টমাস শুধু তাদের বলতো কতটুকু অ্যাসপিরিন খেতে হবে, এছাড়া অসুস্থতার কারণে প্রার্থিত ছুটির কাগজপত্রে সই করা, রোগীদের বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো ইত্যাদি কাজ করতে হতো - ডাক্তারের চেয়ে বরং তার নিজেকে বেশী সরকারী কেরানীর মত মনে হতো।

একদিন, তার অফিসের সময় প্রায় শেষ হবার আগে, তার সাথে দেখা করতে এসেছিল  পঞ্চাশ বছরের এক মানুষ, যার স্থূলতা স্পষ্টতই যেন তার গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি নিজেকে পরিচয় দেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি হিসাবে এবং  রাস্তার ওপারে একটি পানশালায় তাকে কিছুক্ষণ সঙ্গ দেবার জন্য তিনি টমাসকে নিমন্ত্রণ জানান।

এক বোতল পানীয় দিতে নির্দেশ দেয় লোকটি। ‘আমাকে গাড়ী চালিয়ে ফিরতে হবে’, টমাস প্রত্যাখ্যানের সূরেই কথাটি বলে।আমি আমার লাইসেন্স হারাবো যদি তারা জানতে পারে আমি পান করেছি’।স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লোকটি টমাসে কথা শুনে হেসে বলেন, ‘যদি কিছু ঘটে এটা দেখাবেন।’, লোকটি টমাসকে একটি কার্ড দেয়, যেখানে তার নাম লেখা আছে (স্পষ্টতই তার সত্যিকারের নাম নয়), মন্ত্রণালয়ের টেলিফোন নম্বরও আছে।

এরপর তিনি একটি দীর্ঘ বক্তৃতা দেন এই বলে যে তিনি টমাসের কত গুণমুগ্ধ এবং কিভাবে পুরো মন্ত্রণালয় মর্মাহত হয়েছে জেনে যে তার মত এত দক্ষ একজন শ্রদ্ধেয় সার্জন কিনা এখন অখ্যাত কোনো ক্লিনিকে অ্যাসপিরিন বিতরণ করছে। তিনি টমাসকে বুঝতে দেন, যদিও তিনি সেটি প্রকাশ্যে বলতে পারবেন না, পুলিশ আদৌ একমত নয় এই ধরনের বাড়াবাড়ি মাত্রার পদক্ষেপগুলোর জন্য যেমন, বিশেষজ্ঞদের তাদের পদ থেকে অপসারণ করা।

যেহেতু বেশ অনেক দিন টমাসকে কেউ প্রশংসা করার জন্যে ভাবেনি, সে সেই স্কুল কর্মকর্তার সব কথাই খুব সতর্কতা সাথে শুনেছিল এবং তার পেশাগত জীবন সম্বন্ধে লোকটি এত নির্ভুল তথ্য জানে দেখে অবাকও হয়েছিল।চাটুকারিতার মুখে আমরা কতটা নিরস্ত্র, প্রতিরোধহীন!  মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা যা বলছিল সেগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভাবা থেকে সে নিজেকে প্রতিরোধ করতে পারেনি।

কিন্তু এটি শুধুমাত্র দম্ভ থেকে না, আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ এখানে, টমাসের অভিজ্ঞতার অভাব।যখন আপনি এমন কারো মুখোমুখি বসবেন যা আচরণ প্রীতিকর, শ্রদ্ধাশীল এবং বিনম্র, আপনার জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়ে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেয়া যে, সে যা বলছে তার কোনোটাই আসলে সত্য নয়, কোনো কিছুই আন্তরিক নয়।অবিশ্বাসকে প্রতিপালন করার (সারাক্ষণই, পদ্ধতিগতভাবে, কোনো ধরনের বিচ্যুতি ছাড়া) জন্যে প্রয়োজন প্রচুর পরিশ্রম এবং প্রকৃত প্রশিক্ষণ - অন্যার্থে ঘন ঘন পুলিশি জেরার মুখোমুখি হওয়া। আর টমাসের সেই প্রশিক্ষণ ছিল না।

মন্ত্রণালয়ের ব্যক্তিটি আরো বলেন, ‘আমরা জানি জুরিখে আপনি খুব ভালো একটি চাকরী পেয়েছিলেন, এবং আমরা অবশ্যই সেটার জন্য কৃতজ্ঞ যে আপনি দেশে ফিরে এসেছেন, সত্যি একটি মহৎ কাজ। আপনি অনুধাবন করেছিলেন আপনার জন্য জায়গা আসলে এখানেই’। এরপর তিনি আরো যোগ করেন, কিছুটা যেন কোনো কিছুর জন্য টমাসের প্রতি অনুযোগের সুরে, ‘কিন্তু ,আপনার জায়গা অপারেশন টেবিলেও’!

 টমাস বলে, ‘আমিও পুরোপুরি একমত’।

সংক্ষিপ্ত একটি বিরতির পর, মন্ত্রণালয়ের লোকটি বিষণ্ণ কণ্ঠে বলেন, ‘তাহলে আমাকে বলুন ডাক্তার, আপনি কি সত্যি মনে করেন কমিউনিস্টদের উচিৎ তাদের চোখ উপড়ে ফেলা? যখন, আপনি কিনা বহু মানুষকে স্বাস্থ্য উপহার দিয়েছেন’?

‘কিন্তু সেটা অবাস্তব আর অদ্ভুত একটি প্রস্তাব’! টমাস আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলে,‘আমি কি লিখেছি সেটা আপনি কেন পড়েননি’?

‘আমি পড়েছি লেখাটি’, মন্ত্রণালয়ের লোকটি এমন কণ্ঠে সেটি বলে যেন শুনলে কারো মনে হতে পারে সে খুবই বিষণ্ণ।

‘বেশ, আমি কি বলেছি যে কমিউনিস্টদের উচিৎ তাদের চোখ উপড়ে ফেলা’?

‘সেভাবেই সেটা সবাই বুঝেছিল কিন্তু’, মন্ত্রণালয়ের লোকটি বলে, তার কণ্ঠ বিষণ্ণ থেকে আরো বিষণ্ণতর হয়।

‘আপনি যদি পুরো সংস্করণটি পড়তেন, যেভাবে আমি মূল লেখাটি লিখেছিলাম, তাহলে সেটি পড়ে আপনার এমন কিছু মনে হতো না। প্রকাশিত সংস্করণটি খানিকটা সম্পাদনা করা হয়েছে’।

‘তার মানে’? বেশ সতর্ক হয়ে মন্ত্রণালয়ের লোকটি জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনি যেভাবে লেখাটি লিখেছিলেন সেটি তারা সেভাবে প্রকাশ করেনি?

‘না, তারা সংক্ষিপ্ত করেছিল।’

‘অনেকটা’?

‘প্রায় এক তৃতীয়াংশ’।

মন্ত্রণালয়ের লোকটিকে দেখে মনে হলো সত্যিকারভাবেই বিস্মিত হয়েছেন, ‘কাজটা তাহলে তারা ঠিক করেনি মোটেও’।

টমাস কাঁধ ঝাঁকায়।

‘আপনার প্রতিবাদ করা উচিৎ ছিল। দাবী করা উচিৎ ছিল যেন তারা বিষয়টি ঠিক করে দেয় তাৎক্ষনিকভাবে’।

‘কিন্তু সে বিষয়ে আমি কিছু ভাবার আগেই তো রুশরা এসে গেল, আমাদের সবারই তখন আরো বহু কিছু ভাবতে হয়েছিল’।

‘কিন্তু একজন ডাক্তার হিসাবে আপনি নিশ্চয়ই চাননি সবাই যেন এমন কিছু না ভাবে যে আপনি মানুষের দেখার অধিকার কেড়ে নিতে বলছেন’!

‘আপনি কি বিষয়টি একটু বোঝার চেষ্টা করবেন? সম্পাদকের প্রতি লেখা একটি চিঠি ছিল সেটি, পেছনের পাতার এক কোনায় লুকানো। কেউ এমনকি নজরও দেয়নি। কেউ না মানে রুশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা ছাড়া, কারণ তারা সেটাই খুঁজছিল’।

‘না সেটা বলবেন না, এভাবে চিন্তা করবেন না! আমি নিজেই বহু মানুষের সাথে কথা বলেছি যারা আপনার লেখাটি পড়েছে এবং বিস্মিত হয়েছেন যে আপনি এমন কিছু লিখতে পারেন।কিন্তু এখন আপনি আমাকে বলছেন, আপনি যেভাবে লিখেছিলেন সেটি সেভাবে প্রকাশিত হয়নি, বিষয়টি বহু প্রশ্নের সমাধান করছে। তারা কি কাজটি আপনাকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছিল’?

‘লেখার জন্য? না আমি নিজেই লেখাটা জমা দিয়েছিলাম’।

‘সেখানকার কাউকে কি আপনি চেনেন’?

‘কাদের’?

‘যারা আপনার লেখাটি ছাপিয়েছিল’।

‘না’।

‘মানে আপনি তাদের সাথে কোনোদিনও কথা বলেননি’।

‘আমাকে তারা সশরীরে অফিসে আমন্ত্রণ করেছিল একবার’।

‘এবং কার সাথে আপনি কথা বলছিলেন’?

‘কোনো একজন সম্পাদকের সাথে’।

‘তার নামটা কি ছিল’?

এতক্ষণ পর্যন্ত টমাস বুঝতে করতে পারেনি যে তাকে আসলে জেরা করা হচ্ছে। সাথে সাথে সেই বুঝতে পেরেছিল তার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ অন্য কাউকে ভয়ঙ্কর বিপদে ফেলে দিতে পারে। যদিও অবশ্যই সে জানে সম্পাদকের নাম, সে অস্বীকার করে: ‘তার নাম কি ছিল আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবো না’।

টমাসের আন্তরিকতাহীন উত্তরের প্রতিক্রিয়ায় তার কণ্ঠে নিন্দা নিয়ে লোকটি বলে, ‘না না, আপনি নিশ্চয়ই আমাকে বলবেন না যে সে আপনাকে তার নিজের পরিচয় দেয়নি’।

একটি ট্রাজিকমিক বাস্তবতা হচ্ছে শৈশব থেকে সুষ্ঠুভাবে প্রতিপালনই আমাদেরকে গোপন রাষ্ট্রীয় পুলিশের মিত্রে পরিণত হয়েছে। আমরা জানি না কিভাবে মিথ্যা কথা বলতে হয়। সত্যি কথা বলো, যে বাধ্যবাধকতাটি আমাদের ভিতরে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের পিতামাতারা সেটি এতই স্বয়ংক্রিয়ভাবে কাজ যে এমনকি জেরা করার সময় কোনো রাষ্ট্রীয় পুলিশের কাছে মিথ্যা কথা বলতেও আমাদের লজ্জা লাগে। আমাদের জন্য তার মুখের উপর সরাসরি মিথ্যা বলার চেয়ে ( যেটা আসলেই একমাত্র করার মত কাজ এ পরিস্থিতিতে) বরং সহজতর তার সাথে তর্ক করা কিংবা তাকে অপমান করা ( যার আসলেই কোনো অর্থ  হয়না)।

যখন মন্ত্রণালয়ের ব্যক্তিটি তাকে তার অসততার জন্য অভিযুক্ত করেছিল, টমাস প্রায় একটি অপরাধবোধ অনুভব করেছিল; কিন্তু তাকে আসলেই একটি নৈতিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে হয়েছিল তার মিথ্যায় নিজেকে ধরে রাখার জন্য: ‘আমার মনে হয়, সে তার নিজের পরিচয় দিয়েছিল’, সে বলে, ‘কিন্তু যেহেতু তার নাম মনে রাখার মত কিছু নয়, আমি সাথে সাথেই ভুলে গেছি’।

বেশ কেমন দেখতে ছিলেন তিনি তাহলে?

যে সম্পাদক তার সাথে কথা বলেছিল, সে খর্বকায়, সৈন্যদের মত কাটা ছোট হালকা বাদামী চুল। টমাস  সচেতনভাবে এর একেবারে বিপরীত বৈশিষ্ট্যগুলো বাছাই করে বলার জন্য: ‘তিনি বেশ লম্বা, কালো লম্বা চুল ছিল তার’।

‘আহা..’ মন্ত্রণালয়ের লোকটি বলে ‘আর তার বড় একটা থুতনি’ ?

‘হ্যাঁ, ঠিক’, টমাস বলে।

‘খানিকটা কুঁজো’।

‘হ্যাঁ ঠিক’, আবার টমাস বলে, উপলব্ধি করে করে মন্ত্রণালয়ের ব্যক্তিটি হয়তো কাউকে শনাক্ত করতে পেরেছে। শুধুমাত্র টমাস কোনো একটি দুর্ভাগা সম্পাদক সম্বন্ধে তথ্য দিলো না, আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ যে সে যে তথ্যটি দিয়েছে সেটি পুরোপুরিভাবে মিথ্যা।

‘এবং কি জন্য তিনি আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন’? কি নিয়ে আপনারা কথা বলেছিলেন’?

‘লেখাটি সম্পাদনা প্রসঙ্গে, কোন অংশটি আগে পরে হবে সেই বিষয়ে’।

কথা এড়িয়ে যাবার একটি হাস্যকর প্রচেষ্টার মত শোনায় তার উত্তরটি। এবং টমাসের সত্যি কথা বলার অস্বীকৃতিতে আবারো মন্ত্রণালয়ের ব্যক্তিটি কিছুটা বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলো, ‘প্রথমে আপনি বললেন, তারা আপনার লেখা এক তৃতীয়াংশ সম্পাদনা করেছে, এখন বলছেন তারা আপনার লেখাটা সাজানো নিয়ে কথা বলতে চেয়েছে, এটা কি যৌক্তিক’?

এবারের টমাসের কোনো সমস্যা হলো না উত্তর দিতে কারণে সে চূড়ান্তভাবেই সত্যি কথা বলছে।‘ না এটা যৌক্তিক না, কিন্তু ঠিক সেটাই ঘটেছে’। সে হাসলো, ‘তারা জিজ্ঞাসা করেছিল আমি যেন তাদের একটি বাক্যের শব্দের  ক্রম অবস্থান রদবদল করার অনুমতি দেই, আর তারপর তারা আমি যা লিখেছি তার এক তৃতীয়াংশ কেটে বাদ দিয়ে দেয়’।

মন্ত্রণালয়ের ব্যক্তিটি মাথা নাড়ালো এমন ভাবে যেন খুব বেশী অনৈতিক কোনো কাজ বুঝতে সে ব্যর্থ হচ্ছে। ‘খুবই অনিয়মের কাজ করেছে তারা তাহলে’।

সে তার মদ পান শেষ করে এবং উপসংহার টানে: ‘আপনাকে কৌশলে ব্যবহার করা হয়েছে, ডাক্তার, তাদের স্বার্থে আপনাকে ব্যবহার করা হয়েছে। দুঃখজনক, এর পরিণতিতে আপনি এবং আপনার রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।আমরা আপনার ইতিবাচক গুণাবলী সম্বন্ধে খুব ভালোভাবে জানি।দেখি আমরা কি করতে পারি আপনার জন্য’।

টমাসের সাথে আন্তরিকভাবেই করমর্দন করে। তারপর দুজনেই তাদের নিজেদের গাড়ির দিকে প্রস্থান করে।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য