বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব : ৬

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৮-১৯ ২৩:০৪:৫২

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব (নির্ভারতা এবং ভার)

মন্ত্রণালয়ের সেই ব্যক্তিটির সাথে কথা বলার পর পরই গভীর হতাশায় আক্রান্ত হয়েছিল টমাস।কিভাবে সে তাদের কথোপকথনের খোশ মেজাজি ভাবটির কারণে অসতর্ক হয়ে পড়েছিল? এই মানুষটির সাথে কোনো কিছু করতে যদি সে অস্বীকারই না করতে পারে (সে প্রস্তুত ছিল না যা ঘটেছে তার জন্য এবং জানতো না কোনটি আইনের দৃষ্টিতে ক্ষমাযোগ্য অপরাধ আর কোনটি নয়), নিদেনপক্ষে সে তো তার সাথে বহুদিনের পুরনো বন্ধুর মত মদ্যপানে অস্বীকৃতি জানাতে পারতো। ধরা যাক, কেউ তাকে এই লোকটির সাথে দেখে ফেললো, তার পক্ষে তখন কেবলই ভাবা সম্ভব হতে পারে যে টমাস পুলিশের পক্ষে কাজ করছে! এবং কেনই বা সে বলতে গেল তার লেখা মূল প্রবন্ধটিকে কেটে ছোট করা হয়েছে? কেন সে এই তথ্যটি উপস্থাপন করেছিল তাদের কথোপকথনে?  নিজের উপর সে খুবই অসন্তুষ্ট হয়।

দুই সপ্তাহ পর, মন্ত্রণালয়ের লোকটি আবার তার সাথে দেখা করতে আসে। আরো একবার সে তাকে পান করতে আমন্ত্রণ জানায়, কিন্তু এবার টমাস তাদের অফিসেই তার কাজটি শেষ করার জন্য অনুরোধ জানায়।

‘আমি খুব ভালো ভাবে বিষয়টি বুঝতে পেরেছি, ডাক্তার’, একটু হেসে সে বলে।

টমাস তার উচ্চারিত শব্দে খানিকটা কৌতূহলী হয়ে ওঠে। দাবার খেলোয়াড়ের মতই সে শব্দগুলো উচ্চারণ করেছিল, যেন সে তার প্রতিপক্ষকে জানিয়ে দিচ্ছে, এর আগের দানে সে একটা ভুল করে ফেলেছে।

পরস্পরের মুখোমুখি তারা বসে, টমাসের টেবিলে। সেই সময়ে চলমান ফ্লু মহামারি নিয়ে দশ মিনিট কথা বলার পর, লোকটি বলে, ‘আমরা আপনার কেসটাকে বিশেষভাবে ভাবনা চিন্তা করছি। যদি ব্যাপারটায় শুধুমাত্র আমরা জড়িত থাকতাম, তাহলে আর কিছুই করার দরকার ছিলনা, কিন্তু আমাদের জনগণের মতামতের কথা ভাবতে হবে। আপনি আসলেই কি বোঝাতে চেয়েছেন বা চাননি সেটি যাই হোক না কেন, আপনি আপনার প্রবন্ধটির মাধ্যমে মানুষের কমিউনিস্ট বিরোধী মনোভাবকে আরো উস্কে দিয়েছিলেন।আমাকে অবশ্যই বলতে হবে যে, সেই লেখাটির জন্য এমনকি আপনাকে আদালতে নেবার কথাও ভাবা হয়েছে। জনগণকে সহিংসতায় প্ররোচনা দেবার বিরুদ্ধে একটি আইন আছে’।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লোকটি খানিকটা বিরতি নেয় টমাসের চোখের দিকে সরাসরি তাকানোর জন্য। টমাস তার কাঁধ ঝাঁকায়। আবারো লোকটি তার স্বস্তিদায়ক কণ্ঠস্বরে ফিরে আসে, ‘আমরা সেই প্রস্তাবটিকে ভোট দিয়ে বাতিল করেছি।পুরো ব্যাপারটাতে আপনার যা দায় থাকুক না কেন, সমাজের স্বার্থ আছে আপনি যেন আপনার দক্ষতা পুরোপুরিভাবে কাজে লাগাতে পারেন সেটি নিশ্চিত করতে। আপনার হাসপাতালের প্রধান সার্জন আপনার দক্ষতার উচ্চ প্রশংসা করেছেন। আপনার রোগীদের কাছ থেকেও আমরা তথ্য সংগ্রহ করেছি। আপনি আসলেই দক্ষ একজন বিশেষজ্ঞ।ডাক্তারদের রাজনীতি বুঝতে হবে এমন প্রয়োজনীয়তা কেউ দাবী করতে পারবে না। আপনি নিজেকে খানিকটা বেসামাল করে ফেলেছিলেন। সুতরাং এখনই উপযুক্ত সময় বিষয়টির একটি স্থায়ী সমাধান করা। সে কারণে আমরা আপনার জন্য একটি খসড়া বিবৃতি প্রস্তুত করেছি। সংবাদপত্রের লোকজন যেন এটি প্রকাশ করার জন্য তাদের হাতে পায় আপনাকে শুধু তার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আমরাই নিশ্চিত করব এটা যেন সঠিক সময়ে প্রকাশিত হয়’। তিনি টমাসের দিকে একটি কাগজটা এগিয়ে দেন।

টমাস কাগজটিতে কি লেখা আছে সেটি পড়ে এবং এর বিষয়বস্তু তাকে আতঙ্কিত করে। দুই বছর আগে প্রধান সার্জন তাকে যেটি সই করতে বলেছিলেন এটি তার চেয়েও নিকৃষ্ট। শুধুমাত্র ইডিপাস আর্টিকেলটি প্রত্যাহারেই এটি সীমাবদ্ধ থাকেনি, এখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্বন্ধে তার ভালোবাসার ঘোষণা আছে, কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি বিশ্বস্ততার শপথ আছে, বুদ্ধিজীবীদের প্রতি নিন্দা আছে, যারা কিনা দেশটিকে গৃহযুদ্ধে মুখোমুখি ঠেলে দিচ্ছেন এবং সর্বোপরি লেখকদের সাপ্তাহিকীটির সম্পাদকদের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন আছে (বিশেষ করে লম্বা খানিকটা কুঁজো হয়ে থাকা সম্পাদকের প্রতি, টমাসের সাথে যার দেখা হয়নি, তবে তাকে সে চেনে, এবং তার ছবি দেখেছে) যারা সচেতনভাবে তার লেখাটিকে বিকৃত করেছেন এবং তাদের নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ব্যবহার করেছেন প্রতিবিপ্লবের একটি আহবান হিসাবে, কারণ তারা নিজেরা যথেষ্ট কাপুরুষ এমন কোনো প্রবন্ধ লেখার জন্য, সুতরাং তারা একজন সরল অনভিজ্ঞ ডাক্তারের পেছনে আশ্রয় নিয়েছেন নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে।  

মন্ত্রণালয়ের লোকটি টমাসের চোখে তার শঙ্কাটি লক্ষ্য করে, খানিকটা ঝুঁকে পড়ে, টমাসের হাঁটুতে বন্ধুসুলভ মৃদু চাপড় দেয়, ‘ডাক্তার মনে রাখবেন এটা শুধু একটি নমুনা, ভেবে দেখুন, আপনি যদি কিছু বদলাতে চান এখানে, আমি নিশ্চিত আমরা একমতে পৌছাতে পারবো, আর যাই হোক না কেন এটা তো আপনার নিজেরই বিবৃতি’।

টমাস কাগজটি গোপন পুলিশের লোকটির দিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দেয়, যেন সে ভয় পাচ্ছে আর এক সেকেন্ড সেটি হাতে রাখার জন্য, যেন সে চিন্তিত কেউ সেখানে তার আঙ্গুলের ছাপ খুঁজে পাবে।

কিন্তু কাগজটি হাতে নেবার বদলে, মন্ত্রণালয়ের লোকটি কপট বিস্ময়ে তার দুই হাত মেলে ধরে (সেই একই অঙ্গ ভঙ্গি যখন পোপ তার ব্যালকনিতে দাড়িয়ে উপস্থিত জনগণকে আশীর্বাদ দেয়)। ‘কি করছেন ডাক্তার, কেন এমন একটি কাজ করছেন? ওটা রাখুন। বাসায় গিয়ে ভালো করে ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন’।

টমাস মাথা ঝাঁকায় এবং ধৈর্যের সাথে তার বাড়ানো হাতে কাগজটা ধরে রাখে।পরিশেষে মন্ত্রণালয়ের লোকটি বাধ্য হয় তার পোপসূলভ ভঙ্গিমা পরিত্যাগ করে কাগজটি হাতে নেবার জন্য।

টমাস বেশ জোরালোভাবে তাকে বলার প্রায় উপক্রম হয়েছিল যে, সে কখনোই এমন কিছু লিখবেও না কিংবা সই করবে না। কিন্তু শেষ মূহুর্তে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে গলার সূর বদলে শান্তভাবে বলে, ‘আমি তো আর অশিক্ষিত নই, তাই না? কেন আমি এমন কিছুতে স্বাক্ষর করবো যা আমি নিজে লিখিনি’?

‘বেশ, ডাক্তার, তাহলে আপনি যা বলছেন সেভাবেই করা যাক। আপনি নিজে লিখে ফেলুন, আমরা একসাথে সেটি আলোচনা করবো, আপনি এই মাত্র যা পড়লেন সেটাকে মডেল হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন’।

কেন তাহলে টমাস গোপন পুলিশের লোকটিকে তাৎক্ষনিক আর নিঃশর্তভাবে না বলে দেয়নি?

সম্ভবত  এমন কিছু তখন সে ভাবছিল মনে মনে: এছাড়া  এই ধরনের বিবৃতি - যা সাধারণভাবেই কোনো জাতিকে হেয় করে তাদের প্রাণশক্তিকে হরণ করে (সুস্পষ্টভাবেই যা রুশ কৌশল) - নিয়ে পুলিশের হয়তো কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা থাকতে পারে তার ব্যাপারে। তারা হয়তো প্রমাণ সংগ্রহ করছে টমাসের লেখা ছাপানো সাপ্তাহিকটির সম্পাদকদের বিরুদ্ধে কোনো মামলার সাক্ষ্য হিসাবে। যদি তাই হয়, তা হলে তার বিবৃতির প্রয়োজন হবে শুনানির সময় ও তাদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করার প্রচারাভিযানের জন্য।নীতিগত কারণে যদি সে সরাসরি অস্বীকার করে, তাহলে সেই বিপদটি কিন্তু  রয়ে যাবে, পুলিশ তাদের তৈরি করা বিবৃতি উপর তার স্বাক্ষর বসিয়ে ছাপিয়ে দিতে পারে, সে সম্মতি দিক বা না দিক। কোনো পত্রিকারই সাহস হবে না এমন কিছু ঘটার পর তার প্রতিবাদ লিপি ছাপাতে। পৃথিবীর কেউই বিশ্বাস করনে না যে, সে এটা লেখেনি এবং সইও করেনি।অন্য  কারো নৈতিক অপমান দেখে মানুষ এত তীব্র আনন্দ পায় যে তারা কোনো ব্যাখ্যা শুনে সেই আনন্দ নষ্ট করতে চায়না।

নিজেই নিজের বিবৃতি লিখবে পুলিশকে এমন একটি আশা দেবার পর, সে কিছুটা সময় অর্জন করলো। পরের দিনই ক্লিনিক থেকে সে পদত্যাগ করে। টমাস মনে করেছিল (এবং সঠিকভাবেই) স্বেচ্ছায় যখন সামাজিক পদমর্যাদার সবচেয়ে নীচের ধাপে সে নেমে যাবে (যে নেমে যাওয়ার কাজটি অন্য বহু ক্ষেত্রে বহু বুদ্ধিজীবীকে সেই সময় করতে হয়েছিল) তার উপর পুলিশের কর্তৃত্বও কমে যাবে, তার ব্যাপারে আরো কোনো আগ্রহ তাদের থাকবে না। যখন সে মইয়ের সবচেয়ে নিচের ধাপে পৌছাবে, তারা তার নামে আর সেই বিবৃতিটি ছাপাতে পারবেনা, শুধুমাত্র সহজ একটি কারণে যে কেউই এটাকে সত্য বলে গ্রহণ করবে না।অপমানজনক প্রকাশ্য বিবৃতি শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট থাকতে পারে এর স্বাক্ষরকারীদের উত্থানের সাথে, পতনের সাথে নয়।

কিন্তু টমাসের দেশে ডাক্তাররা হচ্ছেন সরকারী চাকুরে, এবং রাষ্ট্র তাদের চাকরী থেকে অব্যাহতি নাও দিতে পারে। যে কর্মকর্তার সাথে টমাস তার পদত্যাগের ব্যাপারটি আলোচনা করেছিল, সে তাকে তার নাম ও খ্যাতি দুভাবেই চেনে, তিনি যথাসম্ভব চেষ্টা করেছিলেন চাকরী না ছাড়ার জন্য টমাসকে রাজী করাতে। হঠাৎ করে টমাসের উপলব্ধি হয়েছিল, সে আদৌ নিশ্চিত না সে সঠিক কাজটি করছে কিনা, কিন্তু বিশ্বস্ত অনুচ্চারিত প্রতিশ্রুতি দিয়ে সিদ্ধান্তটির সাথে নিজের বন্ধনকে সে অনুভব করেছিল, সুতরাং মত পরিবর্তন করার কোনো প্রশ্নই ছিল না এবং এভাবেই টমাস দক্ষ শল্যচিকিৎসক থেকে পরিণত হয় প্রাহার নানা ভবনের কাচের জানালা পরিষ্কার করার একজন সাধারণ পরিচ্ছন্ন কর্মীতে।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য