বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব : ৭-৮

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৮-২৪ ১৩:০৪:৫৪

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব (নির্ভারতা এবং ভার)

কয়েক বছর আগে জুরিখ ছেড়ে প্রাহায় আসার আগে, টমাস নীরবে স্বগতোক্তি করেছিল, ‘এস মুস সাইন’! (অর্থাৎ অবশ্যই এটি তাকে করতে হবে); তেরেজার প্রতি তার ভালোবাসার কথাই তখন সে ভেবেছিল। কিন্তু, যে মুহূর্তে  সীমানা অতিক্রম করেছিল, তখনই টমাস সন্দেহ করতে শুরু করেছিল, আসলেই কি কাজটি অবশ্যই তাকে করতে হবে । পরে, তেরেজার পাশে শুয়ে সে স্মরণ করেছিল হাস্যকর কিছু কাকতালীয় ঘটনার সেই ধারাবাহিক শৃঙ্খলের কথা, যা ঘটেছিল সাত বছর আগে,  যা তাকে তেরেজার কাছে নিয়ে এসেছিল ( যখন তার হাসপাতালের প্রধান সার্জন এর সায়াটিকা অসুখটির শুরুর পর্যায়) এবং সেটি তাকে এখন এমন একটি খাঁচায় ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে, যেখান থেকে সে আর কখনোই পালাতে পারবে না।

এর মানে কি তার জীবনে ‘এস মুস সাইন’! বা অবশ্য কর্তব্যের কোনো ঘাটতি আছে? কোনো অবশ্যপালনীয় প্রয়োজনীয়তার অভাব? আমার মতে, টমাসের জীবনে একটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য ছিল। কিন্তু সেটি ভালোবাসা ছিল না, সেটি ছিল তার পেশা। চিকিৎসাবিজ্ঞানকে পেশা হিসাবে সে নিয়েছিল, কাকতালীয় ঘটনার পরিণতি বা কোনো হিসাব নিকাশ করে নয় বরং তার মনের গভীরে থাকা একটি তীব্র আকাঙ্ক্ষা দ্বারা তাড়িত হয়ে। মানুষকে নানা শ্রেণীতে ভাগ করা যত দূর অবধি সম্ভব হতে পারে, তার সবচেয়ে নিশ্চিত মানদণ্ড হচ্ছে, মনের গভীরে প্রোথিত আকাঙ্ক্ষা, যা তাদের নির্দেশনা দেয় জীবনব্যাপী কোনো একটি কর্মকাণ্ডের প্রতি।প্রতিটি ফরাসী ভিন্ন, কিন্তু সারা পৃথিবীর সব অভিনেতারা একই- প্যারিসে, প্রাহায় অথবা  পৃথিবী অন্য কোনো জায়গায়।

কোনো অভিনেতা হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি তার প্রথম শৈশবে অপরিচিত জনগণের সামনে তার বাকীটা জীবন নিজেকে প্রদর্শন করার সম্মতি দিয়েছিলেন। সেই মূল সম্মতিটি ছাড়া, যার সাথে প্রতিভার কোনো যোগসূত্র নেই, কিন্তু প্রতিভার চেয়েও তার বিস্তার আরো গভীরে, কেউ পারবে না অভিনেতা হতে। একইভাবে একজন চিকিৎসক হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি সম্মতি দিয়েছেন যে তার সারা জীবন ব্যস্ত থাকবে মানুষ শরীর ও সেই সংশ্লিষ্ট সব বিষয়গুলো নিয়ে। সেই মূল সম্মতি ( এবং প্রতিভা কিংবা দক্ষতা নয়) তাকে শক্তি যোগায় মেডিকেল কলেজে প্রথম বছরে ব্যবচ্ছেদের কক্ষে প্রবেশ করার জন্য এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক বছর পরিশ্রম করার জন্য।

চিকিৎসা বিজ্ঞানের মূল কর্তব্যটিকে তার সবচেয়ে দূরবর্তী সীমানায় নিয়ে যায় শল্য চিকিৎসা, যেখানে মানুষ স্বর্গীয় শক্তির সাথে সংযোগ স্থাপন করে। কোনো ব্যক্তির মাথায় যখন জোরে লাঠি দিয়ে আঘাত করা হয়, সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়, এবং শ্বাস নেয়া বন্ধ করে দিতেও পারে। কোনো একদিন, সে তার শ্বাস নেয়া এমনিতেই বন্ধ করতো। হত্যাকাণ্ড তার মৃত্যুর প্রক্রিয়াটি খানিকটা এগিয়ে নিয়ে যায়, যা ঈশ্বর নিজেই তার কর্তব্য হিসাবে একসময় সেটি করার ব্যবস্থা নিতেন। ঈশ্বর, মনে করা যেতে পারে, হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু শল্য চিকিৎসা নিয়ে সেভাবে তিনি চিন্তিত  ছিলেন না। তিনি কখনোই সন্দেহ করেননি কারো সাহস হবে তার উদ্ভাবিত যন্ত্রের মধ্যে তার হাত ঢোকাতে।পুরো শরীরটাকে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, চামড়া দিয়ে সাবধানে মানুষের চোখের অন্তরালে ঢেকে রেখেছিলেন। যখন টমাস অ্যানাথেসিয়ায় ঘুমন্ত কোনো মানুষের চামড়ায় তার অস্ত্রোপচারের ছুরি রাখে, তারপর আত্মবিশ্বাসী হাতে চামড়া কেটে, তারপর অবশেষে সেটিকে উন্মুক্ত করে সুনির্দিষ্ট আর নিয়মমাফিক চাপে ( যেন এটি কোনো কাপড়ের টুকরো- একটি কোট, স্কার্ট, একটি পর্দা) সে খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ধর্মদ্রোহিতার তীব্রতম  সেই অনুভূতির অনুভব করে তার অভিজ্ঞতায়। আর আবারো বলা দরকার, তাকে এই পেশায় আকৃষ্ট করেছিল সেটাই। এটাই তার ‘এস মুস সাইন’! যার শিকড় বিস্তৃত তার মনের গভীরে।এবং সেটাকে কেউ দৈবক্রমে সেখানে রোপণ করেনি, প্রধান সার্জনের সায়াটিকা কিংবা বাইরের কোনোকিছুই না।

কিন্তু কিভাবে এমন কিছু, যা কিনা তার জীবনের বিশাল একটি অংশ, সেটি এত দ্রুত সে ছুড়ে ফেলতে পারলো, এত দৃঢ়তার সাথে এবং এত হালকাভাবে?

সে হয়তো উত্তর দেবে, সে এটি করেছিল, যেন পুলিশ তাকে অপব্যবহার করতে না পারে। কিন্তু সত্যি কথা বললে, এমনকি যদিও এটি তাত্ত্বিকভাবে সম্ভব ( এবং এমনকি আসলেই বেশ কিছু এমন ঘটনাও ঘটেছে), কিন্তু খুব বেশী সম্ভাবনা ছিল না এমন কিছু ঘটার, যেখানে তার স্বাক্ষরের উপর মিথ্যা কোনো বিবৃতি পুলিশ হয়তো জনসমক্ষে প্রকাশ করতে পারে।

মানছি, যে কোনো মানুষের অধিকার আছে বিপদকে ভয় করার, যা ঘটার সম্ভাবনা খানিকটা কম। মানছি যে, সে তার নিজের উপরেই ও তার আনাড়িপনায় বিরক্ত এবং কামনা করেছিল পুলিশের সাথে ভবিষ্যতে কোনো সংস্পর্শ যেন তাকে আসতে না হয় এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট অসহায়ত্বের অনুভূতিটাকে এড়াতে। এবং মানছি, সত্যি কথা বলতে সে তার পেশাকে তো হারিয়ে ফেলেছিলই, কারণ যান্ত্রিক অ্যাসপিরিন বিতরণের যে কাজটি সে ক্লিনিকে করছিল, তার সাথে চিকিৎসা বিজ্ঞান প্র্যাকটিস সম্বন্ধে তার যা ধারণা, তার সাথে কোনো মিলই নেই।এমনকি  তারপরও, যেভাবে দ্রুত সে তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটা আমার কাছেও খুব অদ্ভুত মনে হয়েছিল।হতে পারে কি এটি হয়তো আরো কোনো কিছুকে লুকাচ্ছে, কোনো কিছু গভীরতর যা তার যুক্তি প্রক্রিয়াকে এড়িয়ে গেছে?


এমনকি যদিও তেরেজার মাধ্যমেই বিটহোভেনকে সে ভালোবাসতে শুরু করেছিল, টমাস সঙ্গীত সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানতো না; আমার সন্দেহ আছে, সে কি বিটহোভেন বিখ্যাত ‘মুস এস সাইন? এস মুস সাইন?’ মোটিফটির নেপথ্যে সত্য কাহিনীটা আসলেই জানত কিনা।

ঘটনাটি ঘটেছিল এভাবে:  ডেমবশের নামের একজন ব্যক্তির কাছে বিটহোভেন পঞ্চাশ ফ্লোরিন পেতেন, যখন সুরকার, যিনি সবসময়ই আর্থিক টানাপড়েনের মধ্য থাকতেন, তাকে তার ঋণের কথা স্মরণ করিয়ে দেন একদিন,  ডেমবশের করুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘মুস এস সাইন’? যার উত্তরে বীটহোভেন প্রাণখোলা হাসি সহ বলেন, ‘এস মুস সাইন’!, এবং সাথে সাথেই তিনি তার সুরের মধ্যে এই শব্দগুলো যোগ করেছিলেন। এই বাস্তব সম্মত মোটিফে তিনি তারপর চারটি কণ্ঠের একটি ক্যানন সৃষ্টি করেছিলেন এস মুস সাইন, এস মুস সাইন, ইয়া,ইয়া,ইয়া, ইয়া ( অবশ্যই, অবশ্যই, হ্যাঁ, হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ) এবং চতুর্থ কণ্ঠ সেখানে যোগ দেয় Heraus mit dem Beutel! ( বা টাকার থলে বের করো!);

এক বছর পর সই একই মোটিফ আবার ফিরে তার তার শেষ কোয়ার্ট্রেট এর চতুর্থ মুভমেন্টের ভিত্তি হিসাবে, ওপাস ১৫৫; ততদিনে বিটহোভেন ডেমবশের সেই টাকার থলের কথা ভুলে গেছেন- আর ‘এস মুস সাইন’! বাক্যটা  আরো গুরুগম্ভীর তাৎপর্য নিয়ে উপস্থিত হয়। মনে হয় যেন তারা উচ্চারিত হচ্ছে সরাসরি নিয়তির ঠোট থেকে।কান্টের ভাষায়, এমনকি ‘শুভ সকাল’, সঠিকভাবে যদি উচ্চারিত হয়, সেটিও অধিবিদ্যার বিষয়ে রূপান্তরিত হয়। জার্মান ভাষা হচ্ছে ‘ভারী’ শব্দের একটি ভাষা। ‘এস মুস সাইন’! এখন আর কোনো কৌতুক নয়। এটি রূপান্তরিত হয়েছিল der schwer gefasste Entschluss ( খুব কঠিন অথবা ভারী প্রতিজ্ঞায়)।

সুতরাং বিটহোভেন একটি কৌতুকময় ঘটনার অনুপ্রেরণাকে রূপান্তর করেছিলেন গুরুগম্ভীর সঙ্গীত কোয়ার্ট্রেটে, আধ্যাত্মিক সত্যের প্রতি নির্দেশিত একটি ঠাট্টা হিসাবে।বেশ মজার কাহিনী এটি, কিভাবে হালকা কিছু রূপান্তরিত হয় ভারী কিছুতে অথবা, যেমন পারমেনিডেজ বলতেন, ইতিবাচকতা থেকে নেতিবাচকতায়। তারপরও খুব অদ্ভুতভাবে, এই রূপান্তর ব্যর্থ হয় আমাদের বিস্মিত করতে। আমরা হয়তো অবাক হতাম, যদি বরং বীটহোভন তার কোয়াট্রেট এর এই গুরুগম্ভীর ভাবকে রূপান্তর করতেন ডেমবশের এর টাকার থলে নিয়ে হালকা ঠাট্টার চার কণ্ঠের ক্যাননে।যদি তিনি তাই করতেন, তিনি তাহলে পারমেনিডেস এর সাথে একাত্ম হতে পারতেন- ভারকে রূপান্তর করতেন লঘুতায়, নেতিবাচককে ইতিবাচকতায়। প্রথম ( অসমাপ্ত একটি খসড়া হিসাবে) আসতো একটি বড় আধিবিদ্যক সত্য এবং শেষে ( সম্পাদিত মাস্টারপিস) - খুব তুচ্ছ কোনো ঠাট্টা। কিন্তু আমরা  আর সেভাবে চিন্তা করতে জানিনা, যেমন করে পারমেনিডেস চিন্তা করতেন।

আমার মনে হয়েছিল যে টমাস বহু দিন ধরে গোপনে বিরক্ত ছিল এই কঠোর, আগ্রাসী আর গুরুগম্ভীর ‘এস মুস সাইন’! এর সাথে, এবং সে তার মনে একটি গভীর বাসনা বহন করে এসেছে পারমেনিডস এর মূল সুরটিকে অনুসরণ করার জন্য, ভারকে হালকায় রূপান্তর করার জন্য। মনে করে দেখুন, তার জীবনে একটি পর্যায়ে, টমাস তার প্রথম স্ত্রী ও পুত্রের সাথে পুরো সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল, এবং সে আরো স্বস্তি পেয়েছিল যখন তার বাবা মাও তার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। এই দ্রুত, খামখেয়ালী, পুরোপুরি অযৌক্তিক কোনো সিদ্ধান্ত নেবার কারণ কি হতে পারে, যদি না সেটি প্রত্যাখ্যান করার যৌক্তিক সিদ্ধান্ত না হয়, যা নিজেকে সবচেয়ে ভারী কর্তব্য হিসাবে দাবী করছে, তার ‘এস মুস সাইন’!?  

সেটা, অবশ্যই একটা বাহ্যিক ‘এস মুস সাইন’, সামাজিক নানা নিয়মের মাধ্যমে তার জন্য সংরক্ষিত। কিন্তু অন্যদিকে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রতি তার ভালোবাসার ‘এস মসু সাইন’! ছিল আভ্যন্তরীণ। সেটাই ছিল তার জন্য সবচেয়ে কঠোর সমস্যা। আভ্যন্তরীণ বাধ্যবাধকতাগুলো সব কিছুর চেয়ে আরো বেশী শক্তিশালী এবং সেকারণে আরো বেশী এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য প্রণোদনাদায়ক।

সার্জন হওয়া মানে কোনো কিছুর পৃষ্ঠকে ব্যবচ্ছেদ করে উন্মুক্ত করা এবং দেখা এর নীচে কোথায় কি লুকিয়ে আছে। হয়তো টমাস সার্জারিকে পেশা হিসাবে নিয়েছিল সেই অদম্য জানার ইচ্ছা থেকে, এস মুস সাইনের অন্য পাশে কি লুকিয়ে আছে সেটি দেখার জন্য। অন্যার্থে, জীবনের কি বাকী থাকে যখন কোনো এক ব্যক্তি প্রত্যাখ্যান করে এমন কিছু যা অতীতে সে তার নিজের জীবনের উদ্দেশ্য হিসাবে ভেবেছে।

যেদিন সে প্রথম বারের মত প্রাহার সব দোকানগুলোর জানালা আর প্রদর্শনীর কেসের কাঁচ পরিষ্কার দায়িত্বে থাকা সেই সহৃদয় মহিলার কাছে হাজিরা দিয়েছিল এবং তার সিদ্ধান্তের পরিণতির মুখোমুখি হয়েছিল এর সব মূর্ত আর অনতিক্রম্য বাস্তবতা সহ. এক ধরনের ঘোরের মধ্যে সে প্রবেশ করে।সে মানসিক পরিস্থিতিটি তাকে তার নতুন কাজে প্রথম কয়েকদিন দাসত্বের বন্ধনে রেখেছিল। কিন্তু একবার যখন তার নতুন জীবনের এই হতভম্ব করে দেবার মত বিস্ময় সে কাটিয়ে উঠেছিল ( তার এক সপ্তাহ সময় লেগেছিল), সাথে সাথে সে অনুভব করেছিল, আসলে সে শুধুমাত্র একটা লম্বা ছুটি কাটাচ্ছে।

অবশেষে সে সেই জীবন পেয়েছে, যেখানে সে এমন কিছু কাজ করছে, যে কাজের ব্যাপারে তার কোনো বিশেষ আগ্রহ নেই অথচ উপভোগ করছে । এখন সে বুঝতে পেরেছে কোন জিনিসটি মানুষকে সুখি করে ( যে মানুষগুলোকে সে শুধু করুণাই করেছে) যখন তারা এমন কোনো কাজ বেছে নেয় আভ্যন্তরীণ কোনো ‘এস মুস সাইনের’ কোনো তাড়না অনুভব না করে, এবং যে মুহূর্তে তারা সন্ধ্যায় বাসা ফেরে, সেই মুহূর্তেই তারা ভুলে যায় সব কিছুই। প্রথমবারের সেও সেই আনন্দময় নির্বিকারতা অনুভব করেছিল। আগে যখনই অপারেশন টেবিলে কোনো কিছু ঠিক মত হতো না, সে বিষণ্ণ হয়ে থাকতো আর ঘুমাতে পারতো না। এমনকি নারীদের প্রতি তার আগ্রহও সে হারিয়ে ফেলতো। তার পেশার ‘এস মুস সাইন’ ছিল রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ারের মত।

এখন সে প্রাহায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় ব্রাশ আর মই নিয়ে, নিজের বয়স আরো দশ বছর কমে গেছে এমনটাই সে অনুভব করে। সব সেলস গার্লরা তাকে ডাক্তার নামেই ডাকে (প্রাহার  বুশ টেলিগ্রাফ বা গুজবের আদান প্রদান যে কোনো সময়ের চেয়েই ভালো কাজ করেছে) এবং তারা তাদের সর্দিজ্বর, পিঠের ব্যাখ্যা, অনিয়মিত মাসিক সম্বন্ধে তার কাছে পরামর্শ নিত। হয়তো মনে হয় তারা বেশ অপ্রস্তুতও হয়ে যেত, জানালায় সাবান পানি ঢেলে লম্বা লাঠির আগায় ব্রাশ লাগিয়ে, যখন সে কাঁচ পরিষ্কার করতে শুরু করতো। তারা যদি দোকানে তাদের কাস্টোমারকে একা ফেলে আসতে পারতো, নিশ্চয়ই তারা তার হাত থেকে ব্রাশ লাগানো লাঠিটা কেড়ে নিতে, ও তার হয়ে জানালা পরিষ্কার করে দিত।

টমাসের বেশীর ভাগ কাজের ফরমায়েশ আসতো বড় বড় দোকানগুলো থেকে, কিন্তু তার ম্যানেজার তাকে কিছু  ব্যক্তিগত খদ্দেরের বাসায়ও পাঠাতো। জনগণ তখনও চেক বুদ্ধিজীবীদের উপর রুশ নির্দেশিত কমিউনিস্ট সরকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে একধরনের সৌহার্দ জ্ঞাপন করার আনন্দে। এবং যখন তার প্রাক্তন রোগীরা জানতে পারে টমাস এখন জানালা পরিষ্কার করে তার জীবিকা নির্বাহ করছে, তারা ফোন করেই তার নাম ধরে তাকে কাজ দিতো, তাকে তারা স্বাগত জানাতে শ্যাম্পেইন অথবা স্নিভোভিচ এর বোতল খুলে, তেরোটা জানালা পরিষ্কার করেছে এমন মন্তব্য লিখে দিত অর্ডার স্লিপে, কিন্তু তারা কথা বলতো দুই ঘণ্টা ধরে সেই সময়। বেশ খোশমেজাজের সাথে টমাস তার পরের কাজে বের হোতো। যখন সারা দেশ জুড়েই রুশ অফিসারদের পরিবার তাদের বসতি স্থাপন করছিল এবং রেডিও পুলিশ কর্মকর্তাদের শঙ্কা জাগানো রিপোর্ট মন্ত্র জপের মত উগরে দিচ্ছিল করছিল যারা এখন প্রিয় সম্প্রচারকদের প্রতিস্থাপিত করেছে রেডিওতে, তখন টমাসকে দেখা যেত প্রাহার রাস্তা দিয়ে বেসামাল হেটে যাচ্ছে এক গ্লাস মদ থেকে পরের এক গ্লাস মদে, যেন কেউ এক পার্টি থেকে অন্য পার্টিতে যাচ্ছে। এটি তার জন্যে বিশাল একটি ছুটি।

সে তার প্রাক্তন অবিবাহিত জীবনেও প্রত্যাবর্তন করেছিল। হঠাৎ করেই তেরেজা তার জীবনের বাইরে। শুধুমাত্র  গভীর রাতে বারের কাজ থেকে ফেরার সময় আর  সকালে আধো ঘুমের ঘোরে তার সাথে তেরেজার দেখা হোতো। এবং সকালে তেরেজার কণ্ঠস্বর যখন থাকে সংশয়াচ্ছন্ন আর সে তখন কাজের জন্য দৌড়াচ্ছে। প্রতিটির কাজের দিন তার হাতে থাকে ষোলটা ঘণ্টা, অপ্রত্যাশিত স্বাধীনতার ক্ষেত্র।এবং টমাসের যৌবনের শুরু সেই দিনগুলো থেকে সেই স্বাধীনতার অর্থ মানে রমণীরা।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য