বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব : ৯

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৮-৩০ ০১:০৭:৪৮

 আপডেট: ২০১৬-০৮-৩০ ০২:১৫:১৪

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা পঞ্চম পর্ব ( নির্ভারতা এবং ভার ) : ৯
টমাসের বন্ধুরা যখনই তাকে জিজ্ঞাসা করেছে, কত সংখ্যক রমণীর সাথে সে তার জীবনে মিলিত হয়েছে, সে প্রশ্নটা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু যখন তারা উত্তরের জন্য জোরাজুরি করেছে, সে হয়তো বলেছে, ‘বেশ, দুইশ, এর কম বেশী হবে’। বন্ধুদের মধ্যে ঈর্ষান্বিত কেউ  টমাস প্রকৃত সংখ্যাটি বাড়িয়ে বলছে বলেও অভিযোগ করেছে। আত্মপক্ষ সমর্থন করে সে বলেছে, ‘খুব বেশী তো না, পঁচিশ বছর ধরে নারী সংস্পর্শে আছি, দুইশকে পঁচিশ দিয়ে ভাগ করে দেখো, দেখবে বছরে মোটামুটি আটজনের মত নতুন নারীর চেয়ে বেশী কারো সাথে আমার সংস্পর্শ ছিল না। সংখ্যাটা খুব বেশী না, তাই না’?

কিন্তু তেরেজার সাথে সংসার পাতার পর তার জীবন যাপনের শৈলীটি বেশ খানিকটা সীমিত হয়েছিল, কারণ, এমন একটি শৈলী অব্যাহত রাখার সাথে সংশ্লিষ্ট সাংগঠনিক জটিলতা,  সে বাধ্য হয়েছে তার যৌন কর্মকাণ্ড খুব সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য ( বাসা আর হাসপাতালের অপারেশন রুমের মধ্যে), অবশ্য যদিও সে সেই সময়টুকু ব্যাপকভাবেই সদ্ব্যবহার করেছিল  যেমন করে কোনো পাহাড়ী কৃষক তার ভাগ্যে জোটা সংকীর্ণ এক টুকরো জমিতে সবটুকু নিংড়ে নেয়ার চেষ্টা করে চাষ করে), কিন্তু সেই পরিস্থিতির সাথে বর্তমানে তার হঠাৎ করে পাওয়া ষোলো ঘণ্টার কোনো তুলনাই হয়না (আমি ষোলো ঘণ্টা বললাম কারণ, যে আট ঘণ্টা সে জানালা সে পরিষ্কার করে সেটিও পূর্ণ অসংখ্য নতুন সেলসগার্ল, গৃহবধূ এবং নারী কর্মকর্তাদের দিয়ে, যাদের প্রত্যেকেই সম্ভাব্য যৌন অভিজ্ঞতার প্রতিশ্রুতি বহন করে)।

কিন্তু টমাস তাদের মধ্যে আসলেই কি অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছে? টমাসকে আসলেই কোন বিষয়টি আকৃষ্ট করেছে তাদের প্রতি? যৌন সঙ্গম কি শুধুমাত্র সেই একই কাজের চিরন্তন পুনরাবৃত্তি নয়?

মোটেও না। কারণ সবসময়ই সেখানে ছোট কিছু অংশ থাকে যা কল্পনাতীত। যখন টমাস কোনো রমণী তার কাপড়ে আবৃত অবস্থায় দেখে, স্বাভাবিকভাবেই কম বেশী সে কল্পনা করতে পারে, নগ্ন অবস্থায় সেই রমণী কেমন দেখতে হতে পারে ( ডাক্তার হিসাবে তার অভিজ্ঞতাগুলো এখানে প্রেমিক হিসাবে তার অভিজ্ঞতার সাথে বাড়তি সংযোজন ), কিন্তু ধারণা নির্ভর অনুমান এবং বাস্তবতার সঠিক রূপটির মধ্যে সবসময়ই ছোট একটি শূন্যস্থান থাকে, আর এই শূন্যস্থানটিই তাকে বিশ্রাম নিতে দেয়না। এছাড়াও, কল্পনাতীত কোনো কিছু অর্জন করার প্রচেষ্টা নগ্নতায় প্রকৃত রূপটি আবিষ্কার করার পরও কিন্তু শেষ হয়ে যায় না। এটি আরো অনেক দূর যায়: কেমন করে সেই রমণীটি আচরণ করবে তার কাপড় খোলার সময়?  কি বলবে সে, যখন টমাস তার সাথে সঙ্গম করবে? তার দীর্ঘশ্বাসগুলো শুনতেই বা কেমন লাগতে পারে? চরম মুহূর্তে পৌঁছানোর সময় কেমন করে পরিবর্তিত হতে পারে সে রমণীর মুখটি?

আমিত্বের যা কিছু অনন্য স্বকীয়তা, সেটাই মূলত কোনো ব্যক্তির কল্পনাতীত অংশগুলো গড়ে তোলে। আমরা শুধুমাত্র কল্পনা করতে পারি, কোন বিষয়গুলো আমাদের সবাইকে অন্য সবার মতই একই রকম করেছে, মানুষদের মধ্যে সাধারণ কোন বিষয়গুলো আছে। স্বতন্ত্র আমি,  হচ্ছে সেটাই যা সবার থেকে আমাকে ভিন্ন করে, মানে যেটি অনুমান করা যাবে না বা পরিমাপ করা যাবে না, তাকে অবশ্যই উন্মোচন করতে হবে, অনাবৃত করতে হবে আর জয় করতে হবে।

টমাস, তার গত দশ বছরের চিকিৎসা পেশায় পুরোপুরিভাবে কাটিয়েছে শুধুমাত্র মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে কাজ করে, সে জানতো মানব আমিত্বকে ব্যাখ্যা করার মত আর কোনো কিছুই এত জটিল নয়। হিটলার এবং আইনস্টাইন অথবা ব্রেজনেভ আর সোলঝেনেৎসিন এর মধ্যে যত পার্থক্য আছে তার চেয়ে অনেক বেশী পরিমাণে আছে সদৃশতা। সংখ্যা ব্যবহার করে, আমরা হয়তো বলতে পারি যে এক মিলিয়ন অংশের নয়শো নিরানব্বই হাজার নয়শ নিরানব্বই ভাগই সেখানে সদৃশ আর অমিল মাত্র এক ভাগ।

টমাস মোহাবিষ্ট ছিল সেই এক মিলিয়ন ভাগের একটি ভাগ আবিষ্কার ও দখল করার জন্য। সেটি সে তার তীব্রতম মোহাচ্ছন্নতার  মূল বাসনার কেন্দ্র হিসাবে বিবেচনা করতো। রমণীদের নিয়ে তার মোহ ছিল না, তার মোহ ছিল  নারীদের মধ্যে যে বিষয়টি কল্পনাতীত, সে মোহাচ্ছন্ন ছিল, অন্যার্থে, তাদের একই লিঙ্গের অন্য সদস্যের সাথে পার্থক্য করে সেই এক মিলিয়নতম ভগ্নাংশটির বৈসাদৃশ্যটি নিয়ে।

(এখানেও  হয়তো তার অস্ত্রোপচারের প্রতি  তীব্র আগ্রহের সাথে তার রমণীদের প্রতি তীব্র আগ্রহের সম্মিলন ঘটেছে। এমনকি তার প্রেমিকাদের সাথে, সে তার কাল্পনিক অস্ত্রোপচারের ছুরি কিছুতেই হাত থেকে নামিয়ে রাখতে পারেনি, কারণ সে তাদের গভীরে থাকা কোনো কিছু দখল করার তীব্র একটি ইচ্ছা পোষণ করতো। তার প্রয়োজন তাদের কেটে উন্মুক্ত করা)।

আমরা হয়তো জিজ্ঞাসা করতে পারি, অবশ্যই, কেন টমাস সেই মিলিয়ন ভাগের এক ভাগ বৈসাদৃশ্য অনুসন্ধান করেছে যৌনতায়, কেন অন্য কিছুতে না।কেন সেটি সে খুঁজে পায় না যেমন ধরুন, রমণীদের হাটায় অথবা রান্নার কৌশলে অথবা তাদের শিল্পবোধের রুচিতে?

নিশ্চিতভাবে এই মিলিয়ন ভাগের এক ভাগ বৈসাদৃশ্য মানব অস্তিত্বে অন্য সব অংশেই আছে, কিন্তু যৌনতা ছাড়া অন্য সব ক্ষেত্রে  এটি উন্মুক্ত এবং সেটি আবিষ্কার করার জন্য কারো দরকার হয়না, কোনো অস্ত্রোপচারের ছুরির প্রয়োজন নেই। কোনো একজন রমণী হয়তো খাবার শেষে পনির পছন্দ করে, কেউ ফুলকপি ঘৃণা করে এবং যদিও প্রত্যেকেই তাদের মৌলিকত্ব প্রকাশ করে সেভাবে, এটি সেই মৌলিকত্ব, যা তার অপ্রাসঙ্গিকতা প্রদর্শন করে আমাদের সতর্ক করে দেয় গুরুত্ব না দেবার জন্য, সেখানে কোনো মূল্যবান কিছু খুঁজে পাবার প্রত্যাশা না করতে।

শুধুমাত্র যৌনতায় বৈসাদৃশ্যের সেই এক মিলিয়ন ভাগের একটি ভাগ মূল্যবান হয়ে ওঠে, কারণ, প্রকাশ্যে উন্মুক্ত না হবার কারণে, অবশ্যই জয় করতে হবে এটিকে। এমনকি পঞ্চাশ সাল আগের সেই সাম্প্রতিক সময়েও এই ধরনের বিজয় অর্জন করতে যথেষ্ট পরিমাণ সময় ব্যয় করতে হতো ( সপ্তাহ, এমনকি মাস!)  এবং জয় করা বস্তুটির মূল্য, জয় করার জন্য খরচ হওয়া সময়েরই সমানুপাতিক। এমনকি আজও, যখন জয় করার সময় অনেক কমে গেছে, যৌনতা আপাতদৃষ্টিতে এখনও সেই গোপন সিন্দুকের মত, যা কোনো রমণীর আমিত্বের রহস্য লুকিয়ে রাখে।

সুতরাং এটি ছিল টমাসের কামনা, তবে সুখের জন্য না ( সুখ আসে  অতিরিক্ত বোনাস হিসাবে) বরং  একটি জগতকে অধিকার করার  (তার হাতের অস্ত্রোপচারের ছুরি দিয়ে ছড়িয়ে থাকা শরীরের জগতকে ব্যবচ্ছেদ করে) তীব্র বাসনা তাকে প্ররোচিত করছিল বহু রমণীর সান্নিধ্য পেতে।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য