বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব : ১০

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৯-০৫ ০১:৫৫:৩৪

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব (নির্ভারতা এবং ভার)
১০
পুরুষরা, যারা বহু রমণীকে জয় করার চেষ্টা করেন, তারা সুস্পষ্টভাবে দুটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত। কেউ কেউ তাদের নিজস্ব আত্মগত এবং অপরিবর্তনীয় কোনো স্বপ্নের রমণীর অনুসন্ধান করে সব রমণীর মধ্যে, আর অন্যরা প্ররোচিত হন অসীম বৈচিত্রময় নৈর্ব্যক্তিক রমণীয় পৃথিবী জয় করার কামনায়।

আগের পাগলামিটি কাব্যিক : রমণীদের মধ্যে আসলে তারা নিজেদেরকেই খোঁজেন, তাদের আদর্শকে খোঁজেন, আর যেহেতু আদর্শ সংজ্ঞানুযায়ীই এমন কিছু, যাকে কখনোই পাওয়া যায়না, বার বার তারা হতাশ হন।এই হতাশা এক রমণী থেকে অন্য রমণীর দিকে পরিচালিত করে তাদের অস্থিরচিত্ততার একটি রোমান্টিক অজুহাত দেয়, আর সেকারণে বহু আবেগপ্রবণ রমণী তাদের লাগামহীন বহুগামী প্রেমাভিনয়ে আকৃষ্ট হন।

পরের পাগলামিটি মহাকাব্যিক, রমণীরা এই পুরুষদের মধ্যে আকর্ষণীয় কিছুই খুঁজে পাননা, পুরুষরা তাদের আত্মগত আদর্শ রমণীদের উপর আরোপ করেন, আর যেহেতু সবকিছুই তাদের আগ্রহী করে তোলে, কোনো কিছুই তাদের হতাশ করতে পারে না। হতাশ না হবার ক্ষমতায় খানিকটা কলঙ্কজনক কিছু আছে ।এই মহাকাব্যিক ধরনের রমণী পটানোয় ব্যস্ত পুরুষদের সবাই দেখলে মনে করেন, এরা পরিত্রাণের অতীত (হতাশার মাধ্যমে পরিত্রাণ)।

আর কাব্যিক রমণী পটানো পুরুষরা যেহেতু সবসময়ই একই ধরনের রমণীকে জয় করার চেষ্টা করে, আমরা এমনকি লক্ষ্য করতে ব্যর্থ হই যখন সে এক প্রেমিকাকে প্রতিস্থাপিত করে আরেক প্রেমিকা দিয়ে।তার বন্ধুরা সবসময়ই তাদের প্রেমিকাদের একজনকে অন্য জনের সাথে গুলিয়ে ফেলেন, তাদের একই নামে ডেকে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টিও করেন।

জ্ঞানের অনুসন্ধানে, রমণী পটানোয় মহাকাব্যিক দক্ষরা (অবশ্যই টমাস তাদেরই একজন সদস্য) প্রথাগত রমণীয় সৌন্দর্য থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখেন, কারণ খুব দ্রুত তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েন এই সৌন্দর্যে। এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে তারা ফিরে যান তাদের সেই কৌতূহল সংগ্রাহকের ভূমিকায়।অবশ্যই তারা সচেতন এ বিষয়টি নিয়ে, আর খানিকটা লজ্জিতও, এবং বন্ধুদের কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য এরা প্রেমিকাকে নিয়ে জন সমক্ষে আসাও এড়িয়ে চলেন।

ততদিনে প্রায় দুই বছর ধরে টমাস জানালা পরিষ্কার করার কাজ করছে, যখন তাকে এক নতুন খদ্দেরের কাছে পাঠানো হয়েছিল, যার অদ্ভুত চেহারাটি খুব দ্রুত টমাসের নজরে পড়ে, যে মুহূর্তে সে তাকে দেখেছিল। যদিও অদ্ভুত, তবে সেটি গোপনও, অস্পষ্ট, গ্রহণযোগ্য সাধারণত্বের সীমানায় যার অবস্থান (ফেলিনির দানবের সংক্রান্ত কৌতূহলের সাথে  অবশ্য টমাসের এই ধরনের কৌতূহলের সংক্রান্ত মোহাবিষ্টতার কোনো মিল নেই): দীর্ঘদেহী একজন রমণী, টমাসের চেয়েও বেশ খানিকটা লম্বা, আর তার পাতলা চমৎকার খুব লম্বা একটি নাক আছে এমন একটি অদ্ভুত মুখের উপর যাকে আকর্ষণীয় বলা প্রায় অসম্ভব (কারণ সবাই তার প্রতিবাদ করবে!), টমাসের পক্ষে (অন্ততপক্ষে টমাসের চোখে) তাকে অনাকর্ষণীয় বলা সম্ভব নয়।ঢিলা পাজামা আর সাদা ব্লাউজ পরে ছিল সে, দেখতে জিরাফ, বক আর  বেশ লাজুক সংবেদনশীল তরুণ বালকের একটি অদ্ভুত মিশ্রণ।

টমাসের দিকে দীর্ঘ,সতর্ক আর অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে সে দেখছিল, যে দৃষ্টিতে কৌতুকময় শ্লেষের একটি বুদ্ধিদীপ্ত ঝলকও অনুপস্থিত ছিল না। ‘আসুন, ডাক্তার’, সে বলে। যদিও টমাস বুঝতে পেরেছিল, রমণীটি জানে সে আসলে কে, সে সেটি প্রকাশ করতে চায়নি, শুধু জিজ্ঞাসা করে, ‘কোথায় আমি জানালা পরিষ্কার করার পানি পেতে পারি’?

সে বাথরুমের দরজা খুঁজে দেয়। সেখানে মুখ ধোয়ার একটি বেসিন, বাথ টাব আর কমোড টমাসের নজরে পড়ে, প্রত্যেকটির সামনে বিছানো একটি করে ক্ষুদ্রাকৃতির গোলাপী কার্পেট।

যখন জিরাফ আর বকের মত দেখতে রমণীটি হাসছিল, তার চোখ খানিকটা বাঁকা হয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, সে যাই বলছিল তা শুনে মনে হবে যেন সবই গোপনীয় বার্তার ইঙ্গিতে পূর্ণ।

‘বাথরুম পুরোটা আপনার’; সে বলে, ‘আপনার মন যা যায়, সেখানে তাই করতে পারেন’।

টমাস জিজ্ঞাসা করে, ‘আমি কি গোছল করতে পারি?’।

রমণী তাকে পাল্টা জিজ্ঞাসা করে, ‘আপনার কি গোছল করতে ভালো লাগে?’।

তার জানালা ধোয়ার বালতিতে গরম পানি ভরে টমাস লিভিং রুমে ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করে, ‘কোথা থেকে আপনি চাইছেন যে, আমি শুরু করি’।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে সে বলে,‘সেটা আপনার উপরেই নির্ভর করবে’।

‘আমি কি অন্য ঘরের জানালাগুলো দেখতে পারি’?

‘তাহলে আপনি  চারিদিকে ঘুরে দেখতে চাইছেন’? তার হাসি মনে হচ্ছিল ইঙ্গিত দিচ্ছে জানালা পরিষ্কার করা শুধুমাত্র একটি খেয়াল, যা নিয়ে আদৌ কোনো আগ্রহ সে বোধ করছে না।

টমাস প্রথমে পাশের ঘরে ঢোকে, একটি বড় জানালাসহ সেটি একটি শোবার ঘর, দুটি বিছানা পাশাপাশি সেখানে লাগানো, দেয়ালে হেমন্তের একটি দৃশ্যচিত্র, সূর্যাস্তে বার্চের একটি দৃশ্য।

টমাস লিভিং রুমে ফিরে আসে যখন, সে একটি মদের খোলা বোতল আর দুটি গ্লাস দেখতে পায় টেবিলে উপর। ‘এই কঠিন কাজ শুরু করার আগে আপনার শক্তি ঠিক রাখার জন্য কিছু পান করলে কেমন হয়’?

‘আসলেই, একটু কিছু পান করতে পারি আমি’, টমাস বলে এবং টেবিলে বসে।

সে বলে ‘আপনার নিশ্চয়ই খুব মজা লাগে মানুষ কিভাবে বাস করে তা দেখতে’।

টমাস বলে, ‘আমি অভিযোগ করতে পারবো না’।

‘ঘরে একা থাকা সেই সব স্ত্রীরা, যারা আপনার জন্য সবাই অপেক্ষা করে।

‘আপনি বলতে চাইছেন, সেই সব দাদী আর শাশুড়িরা’।

‘আচ্ছা আমাকে বলুন তো, মূল পেশার জন্য কি কখনো মন খারাপ করে না আপনার?

‘তাহলে আগে আমাকে বলুন, কিভাবে আপনি জানলেন আমার আসল পেশা কি ছিল’?

 ‘আপনার বস আপনাকে নিয়ে বেশ গর্ব করতে ভালোবাসে’, বললো সেই বক রমণী।

‘এতদিন পরেও’!, টমাস বিস্ময়ের সাথে বলে।

‘জানালাগুলো পরিষ্কার করা নিয়ে যখন আমি তার সাথে ফোনে কথা বলেছিলাম, তিনি জিজ্ঞাসা করেছিল, আমি আপনাকে চাই কিনা। তিনি বলেছিলেন যে আপনি বিখ্যাত সার্জন ছিলেন একসময়ে, পরে হাসপাতাল থেকে আপনাকে বেরে করে দেয়া হয়েছে।
বেশ, স্বাভাবিকভাবেই আপনার ব্যাপারে তিনি আমার কৌতূহলকে জাগিয়ে তুলেছিলেন’।

‘আপনার বেশ ভালোই কৌতূহল জ্ঞান আছে’,  টমাস বলে।

‘কিন্তু সেটা কি খুবই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে’?

‘হ্যাঁ, যেভাবে আপনি আপনার চোখ ব্যবহার করছেন’।

‘তাই, কিভাবে আমি আমার চোখ ব্যবহার করছি’।

‘আপনি চোখ সরু করে তাকাচ্ছেন প্রথমে, আর তারপর আপনার প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করছেন’।

‘এর মানে, আপনি চাইছেন না উত্তর দিতে’।

রমণীটির কল্যাণে, এই কথোপকথন পর্বটি প্রথম থেকেই চমৎকার প্রণয়কৌতুকে পূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সে যা বলছে বাইরের পৃথিবীতে তার কোন প্রভাব নেই। এর সব কিছু ভিতরের দিকে নির্দেশিত, তাদের নিজেদের প্রতি এবং যেহেতু সুস্পষ্টভাবে তা টমাস আর এই রমণীর সাথে সংশ্লিষ্ট, আর কোনো কিছুই আসলে সহজতর ছিল না তাদের কথোপকথনের সাথে শব্দগুলোর সাথে স্পর্শ যোগ করা ছাড়া।

এভাবেই যখন টমাস তার চোখ সরু করে কথা বলার বিষয়টি নিয়ে বলছিল, সে হাত বাড়িয়ে সেটি স্পর্শ করে। রমণীটিও টমাসের চোখে একইভাবে হাত দেয়।তবে এটি কোনো স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া ছিল না। সম্ভবত মনে হচ্ছিল সেও সচেতনভাবে একটি ‘আমি যা করবো তুমিও তাই করবে’ এমন একটি খেলার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, এবং এরপর মুখোমুখি বসে থাকা  তাদের দুজনের হাত ধাপে ধাপে তাদের পরস্পরের শরীরের নানা জায়গায় স্পর্শ করছিল।

রমণীর উরুর মাঝখানে টমাসে হাত যাবার পরেই সে বাধা দিতে শুরু করে। টমাস অনুমান করতে পারেনা ঠিক কতটা গুরুত্বের সাথে সে এটি বোঝাতে চাইছে। কারণ বহু সময় পার হয়েছে এবং আর দশ মিনিটের মধ্যে তার পরের কাষ্টোমারের বাসায় যাবার কথা, সে উঠে দাড়ায় এবং তাকে বলে তার যেতে হবে।

রমণীর মুখ লাল হয়ে যায়। ‘অর্ডার স্লিপে তো আমার সই করতে হবে’, সে বলে।

‘কিন্তু আমিতো কিছুই করিনি’, টমাস প্রতিবাদ করে ।

‘সেটা আমার দোষ’, এরপর মৃদু নরম নিষ্পাপ কণ্ঠে মিনতি করে সে বলে, ‘তাহলে আপনাকে আবার আমাকে ডেকে আনতে হবে অর্ডার দিয়ে এবং যা সরু করতে বাধা দিয়েছিলাম সেটি যেন আপনি শেষ করতে পারেন’।

যখন টমাস অস্বীকার করে রশিদটিতে তাকে সই করতে দেবার জন্য। সে আরো নরম সুরে বলে, যেন তার কাছে করুণা ভিক্ষা করেই কোনো কিছু চাইছে,‘ কাগজটা আমাকে দেন, দয়া করে? তারপর সে আবারো চোখ সরু করে, বলে, ‘আর  যাই হোক না কেন, আমি তো এর জন্য টাকা দিচ্ছি না, আমার স্বামী দেবে, আর আপনিও এর জন্য পয়সা পাবেন না, কারণ রাষ্ট্র পাবে।আমরা দুজনের সাথে এই অর্থ বিনিময়ের কোনো যোগসূত্রতা নেই’।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য