বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব: ১২

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৯-১৯ ০১:১৫:৪০

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব (নির্ভারতা এবং ভার) : ১২
প্রায় একই সময়ে, টমাসের আরেকটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল : একজন তরুণীর সাথে সে একটি ঘরে দেখা করতো, যে ঘরটি তার পুরনো এক বন্ধু তাকে প্রতিদিন মধ্যরাত্রি অবধি ব্যবহার করতে দিয়েছিল। এক কিংবা দুই মাস পর, তরুণীটি তাকে তাদের শুরুর দিকের কোনো একটি সাক্ষাতের কথা মনে করিয়ে দেয়। জানালার নীচে একটা কার্পেটে তারা সঙ্গম করেছিল, বাইরে তখন ঝড় আর বজ্রপাত হচ্ছিল; পুরো ঝড়ের সময়টি তারা সঙ্গম করে, অবিস্মরণীয় সুন্দর ছিল সেই সময়টি।

টমাস হতভম্ব হয়েছিল। হ্যাঁ, কার্পেটের উপর তরুণীটির সাথে সঙ্গম করার কথা সে মনে করতে পেরেছিল (কারণ বন্ধুর সংকীর্ণ বিছানা টমাসের জন্য অস্বস্তিকর মনে হয়েছিল এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ডের জন্য), কিন্তু সে পুরোপুরিভাবে সেদিনের ঝড়ের কথা ভুলে গিয়েছিল!বিষয়টি খুবই অদ্ভুত ছিল টমাসের জন্য। সে তাদের প্রতিটি সঙ্গমের কথাই মনে করতে পারে, তার খুব ভালোই মনে আছে কিভাবে তারা সঙ্গম করেছিল। (যেমন সে পিছন থেকে করতে ভালোবাসতো না।

সে মনে করতে পারে বেশ কিছু কথা যা তরুণীটি তাদের সঙ্গমের সময়ে তাকে বলেছিল (যেমন সে তাকে বলতো তার কোমরে জোরে চাপ দিতে এবং সারাক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে না থাকতে। এমনকি একবার তার অন্তর্বাসের একটি ছেড়া অংশর কথাও তার মনে আছে, কিন্তু ঝড় কোনো ছাপ ফেলে যায়নি তার মনে।

প্রতিটি যৌন অভিজ্ঞতায় তার স্মৃতি শুধুমাত্র সংরক্ষিত করেছে তার যৌন সফলতার কঠিন পথটিকে: মৌখিক আগ্রাসনের প্রথম শব্দ, প্রথম স্পর্শ, প্রথম অশ্লীল কথা যা সে তাকে বলেছে বা সে বলেছিল তাকে, সেই সামান্য বিকৃতি যা সে তাকে মানতে রাজি করাতো, কিংবা যা সে করতে রাজি হতো না। বাকী সব কিছু সে তার স্মৃতি থেকে বাদ দিয়েছে (খুবই মনোযোগের সাথে, প্রায় আনুষ্ঠানিকভাবে।

সে এমনকি ভুলে যেত কোথায় সে কোনো একটি রমণীকে প্রথম দেখেছিল, যদি সেটি ঘটে তার যৌন আক্রমণ শুরু হবার আগে।

তরুণী স্বপ্নাবিষ্টতার সাথে হেসেছিল, যখন যে ঝড়ের কাহিনীটি তাকে মনে করিয়ে দিয়েছিল এবং টমাস তার দিকে বিস্ময় আর এমন কোনো কিছুর সাথে তার দিকে তাকিয়েছিল, যা লজ্জার মত। তরুণীটি এমন একটি অভিজ্ঞতা পেয়েছিল যা খুবই সুন্দর ছিল, এবং সেই একই অভিজ্ঞতা টমাস তার সাথে পেতে সাথে ব্যর্থ হয়েছিল। দুটি উপায়ে, যেভাবে তাদের স্মৃতি সেদিন সন্ধ্যার ঝড়ের প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল, সেটি খুব সুস্পষ্টভাবে ভালোবাসা আর ভালোবাসাহীনতার সীমানা নির্মাণ করেছিল।

ভালাবাসাহীনতা শব্দটি ব্যবহার করে আমি এমন কিছু ইঙ্গিত করার ইচ্ছা পোষণ করছিনা যে, টমাস এই তরুণীর প্রতি কোনো নৈরাশ্যবাদী ধারণা পোষণ করতো, বর্তমান-সময়ের ভাষাভঙ্গিতে যা বলা হয়, সে তাকে দেখেছিল যৌনতা মেটানোর একটি উপায় হিসাবে।

বরং ঠিক এর ব্যতিক্রম টমাস তাকে খুবই পছন্দ করতো, তার চরিত্রে আর বুদ্ধিমত্তাকে গুরুত্ব দিয়েছিল, এবং সে প্রস্তুতও ছিল, প্রয়োজনে, যদি তরুণীটি চায়, তার সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য। তরুণীটির প্রতি সে নিজে লজ্জাজনক কোনো আচরণ কখনোই করেনি; সেই কাজটি করেছে তার স্মৃতি, কারণ তার জানা ছিল না যে, তার স্মৃতি এই তরুণীটিকে তার ভালোবাসার বলয় থেকে বাদ দিয়েছে।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় আমাদের মস্তিষ্কের বিশেষ একটি জায়গা আছে, যাকে আমরা বলতে পারি কাব্যিক স্মৃতি, এবং আমাদের যা কিছু মুগ্ধ করে বা স্পর্শ করে, যা আমাদের জীবনকে সুন্দর করে, এটি সেই সবকিছু সংরক্ষণ করে। তেরেজার সাথে তার পরিচয় হবার পর থেকে, তার মস্তিষ্কের এই অংশে সামান্যতম কোনো ছাপ রাখার জন্য কোনো রমণীরই অধিকার ছিল না।

কোনো স্বৈরাচারী শাসকের মত তেরেজা তার কাব্যিক স্মৃতিকে দখল করে রেখেছিল, এবং অন্য সব রমণীদের চিহ্ন সেখান থেকে সে মুছে দিয়েছিল। বিষয়টি ছিল অবিচারের, কারণ তরুণীটি, যার সাথে সে কার্পেটের উপর মিলিত হয়েছিল ঝড়ের সময়, কবিতার বিষয় হবার জন্য সে তেরেজার চেয়ে কোনো অংশেই কম ছিল না।

সে চিৎকার করেছিল, ‘চোখ বন্ধ করো তোমার, আমার কোমরে চাপ দাও, শক্ত করে আমাকে ধরো’। সে কিছুতেই সহ্য করতে পারতো না, যখন টমাস তার সাথে সঙ্গমের সময় খোলা রাখতো তার চোখগুলো, মনোযোগী আর পর্যবেক্ষণশীল; তরুণীটির শরীরের উপর সবসময়ই সামান্য বাঁকা হয়ে থাকা টমাসের শরীরটি, কখনো তার চামড়ায় স্পর্শ করতো না।

তরুণীটি চাইতো না টমাস তাকে পর্যবেক্ষণ করুক, সে তাকে শুধু টেনে নিয়ে যেতে চাইতো জাদুর স্রোতধারায়,যেখানে প্রবেশ করা যেতে পারে শুধু চোখ বন্ধ করে। সে কারণে পেছন থেকে সঙ্গম করতে সে পছন্দ করতো না, কারণ সেই পরিস্থিতিতে তাদের শরীর পরস্পরকে স্পর্শ করতো না আদৌ, বেশ কয়েকফুট দুর থেকে টমাস তাকে পর্যবেক্ষণ করতে পারতো।

এই দূরত্বটাকে ঘৃণা করতো তরুণীটি, সে তার সাথে মিশে যেতে চাইতো, সেকারণেই টমাসের চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে সে দাবী করতো, তার এখনও চূড়ান্ত তৃপ্তি হয়নি, এমনকি যদিও কার্পেট বেশ ভেজা সে কারণেই। ‘

শারীরিক আনন্দ আমি খুঁজছি না’, সে বলতো, ‘আমি সুখ চাইছি। সুখ ছাড়া আনন্দ কোনো আনন্দ নয়’। অন্যার্থে,তরুণীটি টমাসের কাব্যিক স্মৃতির দরজায় সজোরে ধাক্কা দিচ্ছিল, কিন্তু সেই দরজা ছিল বন্ধ। টমাসের কাব্যিক স্মৃতিতে তরুণীটির জন্য কোনো জায়গা নেই। শুধুমাত্র কার্পেটের উপরই তার জন্য জায়গা আছে।

তেরেজা সাথে অভিযান শুরু হয়েছিল ঠিক সেই মুহূর্তে, যেখানে অন্য রমণীদের সাথে তার অভিযান শেষ হয়েছিল। এটি ঘটেছিল সেই বাধ্যবাধকতার অন্যদিকে, যা তাকে ঠেলে দিয়েছিল একের পর এক রমণীকে জয় করার জন্য। তেরেজার কোনো কিছু উন্মোচন করার জন্য তার কোনো ইচ্ছা নেই।

সে তার কাছে কোনো আবরণ ছাড়াই এসেছিল। তার সাথে সে সঙ্গম করেছিল তার কাল্পনিক সেই ছুরি হাতে নেবার আগেই, যা দিয়ে সে পৃথিবীর শুয়ে থাকা শরীর সে উন্মোচন করতো। তাদের সঙ্গমের সময় সে কেমন আচরণ করতে পারে, এমন কিছু ভাবার আগেই, টমাস তাকে ভালোবেসেছিল।

তাদের ভালোবাসা শুরু হয়নি সবকিছু ঘটার পর: তেরেজা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, আর অন্য সবার ক্ষেত্রে সে যা করতো, টমাস তাকে তার বাড়িতে তাকে ফেরত পাঠাতে পারেনি। তার বিছানার পাশে নতজানু হয়ে, যখন সে ঘুমাচ্ছিল, সে অনুধাবন করেছিল যে, কেউ তাকে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে নলখাগড়ায় বোনা একটা ঝুড়িতে শুইয়ে রেখে। আমি আগে বলেছিলাম রূপকগুলো খুবই বিপদজনক হতে পারে। ভালোবাসা কোনো একটি রূপকের মাধ্যমেই শুরু হয়।

তার মানে এমন কিছু বলা, ভালোবাসা এমন একটি মুহূর্ত থেকে শুরু হয়, যখন কোনো রমণী আমাদের কাব্যিক স্মৃতিতে তার প্রথম শব্দ বপন করে।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য