বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব: ১৩

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৯-২৩ ০২:১৪:০৭

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা পঞ্চম পর্ব (নির্ভারতা এবং ভার) : ১৩
সম্প্রতি তেরেজা টমাসের মনের সেই বিশেষ এলাকায় আরো একটি অন্তর্ভুক্তি করেছিল।প্রতিদিনের মত একদিন সকালে দুধ নিয়ে বাসায় ফেরার পর, তার লাল স্কার্ফে একটি কাককে পেঁচিয়ে বুকে চেপে ধরে দরজায় দাড়িয়ে ছিল তেরেজা; এভাবেই জিপসিরা তাদের বাচ্চাদের ধরে রাখে। টমাস কখনোই ভুলতে পারবে না দৃশ্যটা। কাকটি বিলাপ করা বড় ঠোটটি ছিল ঠিক তার মুখের পাশে।

মাটির নীচে অর্ধেক পোতা অবস্থায় এটিকে সে পেয়েছিল, ঠিক যেভাবে কসাকরা তাদের বন্দীদের মাটিতে পুতে রাখতো। কাজটি করেছিল শিশুরা, সে বলেছিল আর তার শব্দগুলো বাস্তব সেই সত্য ছাড়াও যেন আরো কিছু বলেছিল, সেগুলো উন্মুক্ত করেছিল মানুষের প্রতি তার সাধারণ একটি অপ্রত্যাশিত ঘৃণা। এটি টমাসকে মনে করিয়ে দিয়েছিল কিছু যা সে বলেছিল বহুদিন আগে: ‘আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ হতে শুরু করেছি কোনো সন্তান না চাইবার জন্য’।

এবং তারপর তার কাছে সে অভিযোগ করেছিল একজন মানুষকে নিয়ে, যে তাকে কাজে বিরক্ত করে আসছে বেশ কিছুদিন ধরেই।লোকটি তার গলার পরা নেকলেসটা টেনে ধরে দাবী করেছিল, শুধুমাত্র পাশাপাশি পতিতাবৃত্তি করে বাড়তি কিছু অর্থ উপার্জন করা ছাড়া নাকি সে কোনোভাবেই এই নেকলেস কিনতে পারে না। বিষয়টি তেরেজাকে খুবই বিষণ্ণ করেছিল, টমাসের মনে হয়েছিল, সে বিষণ্ণ ছিল প্রয়োজনের চেয়েও খানিকটা বেশী মাত্রায়। হঠাৎ করেই টমাস বেশ হতাশাও অনুভব করেছিল, গত দুই বছরে তেরেজাকে সে কত কম দেখেছে, সেটি ভেবে। তার খুব কমই সুযোগ হয়েছে তেরেজার হাত ধরে তার অস্থিরতায় সান্ত্বনা দেবার জন্য।

পরের দিন সকালে সে তেরেজার কথা ভাবতে ভাবতেই কাজে গিয়েছিল। যে মহিলা জানালা পরিষ্কারকদের দিনের জানালা ধোবার কাজ ভাগ করে দেয়, সে তাকে বলেছিল, একজন বেসরকারি খদ্দের ব্যক্তিগতভাবে ও বিশেষভাবে তাকেই শুধু কাজে চাইছে । টমাসের বিষয়টি ভালো লাগছিল না, ভয়ও পেয়েছিল সে, হয়তো অন্য কোনো এক রমণী। তেরেজাকে নিয়ে পুরোপুরি চিন্তায় ব্যস্ত টমাসের কোনো নতুন অভিজ্ঞতা খোঁজার ইচ্ছাও ছিল না।

যখন দরজা খোলে, সে স্বস্তির একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল। একজন লম্বা, খানিকটা সামনের দিকে ঝুঁকে থাকা একজন ব্যক্তিকে সে দেখেছিল তার সামনে। মানুষটি প্রশস্ত বড় চিবুক ছিল আর তাকে খানিকটা অস্পষ্টভাবে পরিচিতও মনে হয়েছিল টমাসের।

‘ভেতরে আসুন’, হাসি মুখে লোকটি বলে তাকে, এরপর ভিতরে নিয়ে যায়।

একজন তরুণও সেখানে দাড়িয়ে ছিল, তার মুখ ছিল উজ্জ্বল লাল, সে টমাসের দিকে তাকিয়ে ছিল, আর চেষ্টা করছিল হাসতে।

‘আমার মনে হয় কোনো প্রয়োজন নেই ,আপনাদের দুজনকে পরস্পরের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য’, লোকটি বলে।

‘না’, টমাস বলে, আর প্রত্যুত্তরে হাসি না ফিরিয়ে দিয়েই সে তরুণের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। তরুণটি ছিল তার ছেলে।

শুধুমাত্র তারপর, বড় চিবুকসহ ব্যক্তিটি মানুষটি তার নিজের পরিচয় দিয়েছিল।

‘আমার মনে হয়েছিল, আপনি দেখতে খুবই পরিচিত! অবশ্যই এখন বুঝতে পারছি, নামটাই মনে করিয়ে দিল’।

ছোটো একটি কনফারেন্স টেবিলের মত একটা টেবিলে তারা বসে। টমাস অনুভব করে, তার বিপরিতে বসা দুটি মানুষই তার নিজের অনিচ্ছাকৃত সৃষ্টি। তরুণটিকে সে বাধ্য হয়েছে তৈরি করতে তার প্রথম স্ত্রীর দ্বারা, আর বয়স্ক মানুষটির বৈশিষ্ট্যগুলো তার রূপ পেয়েছিল পুলিশের জেরার মুখে।

তার মন থেকে এই সব চিন্তা সরাতে, সে তাদের প্রশ্ন করে, ‘কোন জানালা আমি আগে পরিষ্কার করা শুরু করবো?’।

দুজনেই বেশ জোরে হেসে ওঠে।

স্পষ্টতই জানালা ধোয়ার সাথে এই পরিস্থিতির কোনো সম্পর্ক নেই। তাকে জানালা পরিষ্কার করার জন্য ঢাকা হয়নি। তাকে একটা ফাঁদে ফেলার জন্য টোপ দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। তার ছেলের সাথে এর আগে সে কখনো কথা বলেনি। প্রথমবারের মত সে তার সাথে হাত মিলিয়েছে আজ। শুধুমাত্র চেহারায় তাকে সে চেনে আর কোনো উপায়ে সে তাকে চিনতেও চায় না। সে যত কম জানবে তার ছেলে সম্বন্ধে, তার জন্য তত ভালো। এবং সে আশা করে এই মনোভাবটি পারস্পরিক।

‘সুন্দর পোষ্টার, তাই না’? সম্পাদক বলে, টমাসের বিপরীত দেয়ালে বাধাই করা একটি ড্রইং এর দিকে নির্দেশ করে।

টমাস এবার ঘরের চারপাশে তাকায়। বেশ সুন্দর ছবি দিয়ে দেয়ালগুলো সাজানো, মূলত পোস্টার ও ফটোগ্রাফ। যে ড্রইংটির দিকে সম্পাদক নির্দেশ করেছিলেন, সেটি এসেছে ১৯৬৯ সালে রুশরা তার পত্রিকা বন্ধ করে দেবার আগে প্রকাশিত শেষ সংস্করণটি থেকে। এটি ১৯১৮ সালের রুশ গৃহযুদ্ধের জন্য সদস্য সংগ্রহ করার একটি বিখ্যাত পোস্টারের অনুলিপি, যেখানে দেখা যাচ্ছে একজন সেনা, লাল তারকা খচিত টুপি পরা, চোখে অস্বাভাবিক কঠোরতা নিয়ে, তর্জনী নিদেশ করে সরাসরি দর্শকের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। মূল রুশ ক্যাপশনটি বলছে, ‘নাগরিকরা, আপনারা কি রেড আর্মিতে যোগ দিয়েছেন’? এটিকে প্রতিস্থাপন করেছে একটি চেক বাক্য, ‘আপনি কি দুই হাজার শব্দে স্বাক্ষর করেছেন’?

আসলেই অসাধারণ একটি কৌতুক! ‘দুই হাজার শব্দ’ হচ্ছে ১৯৬৮ সালে বিখ্যাত প্রাগ বসন্তের প্রথম গৌরবান্বিত ম্যানিফেস্টো। যা কমিউনিস্ট শাসনব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন দাবী করেছিল। প্রথমে সেখানে স্বাক্ষর করেছিলেন বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী, তারপর অন্যরা এসেও স্বাক্ষর করেছিলেন, তারপর এত বেশী স্বাক্ষর জমা হয়েছিল যে, কেউ আর সেই সংখ্যা গণনা করতে পারেনি। যখন সোভিয়েত রেড আর্মি তাদের দেশে আগ্রাসন ও ধারাবাহিকভাবে পদ্ধতিগত রাজনৈতিক শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়ার সূচনা করেছিল, তখন একটি প্রশ্ন তারা প্রতিটি নাগরিককে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘আপনি কি দুই হাজার শব্দটিতে স্বাক্ষর করেছেন’? যারাই স্বীকার করেছিল যে এমন কিছু তারা করেছেন, সাথে সাথে তাদের চাকরী থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।

‘চমৎকার পোস্টার’, টমাস বলে। ‘আমার খুব ভালো মনে আছে এটির কথা। আশা করছি, রেড আর্মির কেউ আমাদের কথা শুনছে না’, সে হেসে সম্পাদককে বলে।

তারপর সম্পাদক বলতে থাকেন, কোনো হাসি ছাড়াই: ‘যদিও এটি আমার ফ্লাট না, আমার এক বন্ধুর ফ্ল্যাট এটি। আমরা একেবারে পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত হতে পারবো না যে, পুলিশ আমাদের কথা শুনছে না।তবে সেটি শুধুমাত্র সম্ভাবনা। আমি যদি আমার বাসায় আপনাকে ডাকতাম, তাহলে নিশ্চিতভাবে বলতে পারতাম, কেউ শুনছে’।

এরপর তিনি বেশ হালকা মেজাজে কথা বলতে শুরু করেন। ‘কিন্তু আমি যেভাবে বিষয়টি দেখছি তাহলো, আমাদের আসলে আর কিছুই লুকানোর নেই।আর চিন্তা করে দেখুন ভবিষ্যতদের চেক ইতিহাসবিদদের জন্য কত বড় আশীর্বাদ হতে পারে এটি, পুরো চেক বুদ্ধিজীবীদের লিপিবদ্ধ জীবন সংরক্ষিত হয়ে আছে পুলিশ আর্কাইভে। আপনি জানেন সাহিত্যের ইতিহাসবিদদের কি পরিমাণ পরিশ্রম করতে হয়েছে ভলতেয়ার, বালজাক বা টলস্টয়ের যৌন জীবনের খুঁটিনাটি পুনর্নির্মাণ করার জন্য? চেক লেখকদের নিয়ে এমন কোনো সমস্যা হবে না। সবকিছুই পুলিশের টেপে রেকর্ড করা আছে, প্রতিটি শেষ দীর্ঘশ্বাস সহ’।

আর দেয়ালে কাল্পনিক মাইক্রোফোনের দিকে তাকিয়ে, তিনি বেশ জোরেই বলে ওঠেন, ‘ভদ্রমহোদয়গণ, এই পরিস্থিতিতে সবসময় যা ঘটে, আমি এই সুযোগটি নিতে চাই আপনাদের কাজে উৎসাহ জ্ঞাপন করার জন্য এবং আপনাদের ধন্যবাদ জানাতে চাই ভবিষ্যতের সব ইতিহাসবিদদের পক্ষ থেকে’।

তিন জনই বেশ কিছুক্ষণ হাসার পর, সম্পাদক সেই কাহিনীটি বর্ণনা করেন, কিভাবে তার পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, এই পোস্টারটি যে শিল্পী ডিজাইন করেছিল সে কি করেছিল এবং কি ঘটেছে অন্যান্য চেক শিল্পী, দার্শনিক আর লেখকদের সাথে। রুশ আগ্রাসনের পর তাদের সব দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে এবং তারা কেউ এখন জানালার কাচ পরিষ্কার করছের, কেউ গাড়ি পার্কিং এর সহায়তাকারী, কেউ প্রহরী বা কেউ জনসাধারণের জন্য নির্মিত কোনো ভবনের বয়লার ম্যান হিসাবে কাজ করছেন, অথবা, ভাগ্য ভালো ও কিছুটা যোগাযোগ থাকলে হয়তো ট্যাক্সি চালক হতে পেরেছেন।

যদিও সম্পাদক যা বলছিলেন, তা যথেষ্ট আকর্ষণীয়, কিন্তু টমাস তার কথায় মনোযোগ ধরে রাখতে পারেনা। সে তার ছেলেকে নিয়ে ভাবছিল, গত দুই মাসে রাস্তায় তাকে সে কয়েকবার পাশ কাটিয়ে গেছে বলে মনে করতে পারে। স্পষ্টতই এই সাক্ষাতটি কোনো দুর্ঘটনা নয়।তবে সে অবশ্যই কখনো তাকে নিগৃহীত সম্পাদকের সাথে দেখতে পাবে এমন আশাও করেনি। টমাসের প্রথম স্ত্রী ছিলেন গোড়া কমিউনিস্ট এবং টমাস স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মনে করেছে তার ছেলেও নিশ্চয়ই মায়ের প্রভাবের অধীনেই আছে।

তার সম্বন্ধে কিছু সে জানতো না। অবশ্যই বিষয়টি নিয়ে সে বলতে পারতো, মায়ের সাথে তার সম্পর্ক কেমন সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাও করতে পারতো, কিন্তু তার মনে হয়েছিল তৃতীয় কোনো ব্যক্তির উপস্থিতিতে এমন কিছু জিজ্ঞাসা করা কোনো ভদ্রতা হবে না।

অবশেষে সম্পাদক মূল প্রসঙ্গে আসেন। তিনি বলেন যে, ‘ক্রমেই সংখ্যা বাড়ছে, অনেক বেশী মানুষ এখন জেলখানায় বন্দী হচ্ছে, তবে কোনো অপরাধের কারণে না, শুধুমাত্র নিজেদের মতামত প্রকাশের জন্য’, তিনি শেষ করেন, ‘আমরা ঠিক করেছি কিছু করবো বলে’ এই শব্দগুলো উচ্চারণ করে।

‘কি করতে চাইছেন আপনারা’? টমাস তাকে জিজ্ঞাসা করে।

এ পর্যায়ে তার ছেলে কথা বলতে শুরু করে। জীবনে প্রথমবারের মত টমাস তার ছেলেকে কথা বলতে শোনে। ।অবাক হয় লক্ষ্য করে যে সে খানিকটা তোতলাচ্ছে।

‘আমাদের তথ্য অনুযায়ী’, সে বলে, ‘রাজনৈতিক বন্দীদের খুব নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে। অনেকেই খুব খারাপ অবস্থা। সুতরাং আমরা একটি পিটিশন তৈরি করে সেটিতে গুরুত্বপূর্ণ চেক বুদ্ধিজীবীদের স্বাক্ষর নেবো, বিশেষ করে তারা, যারা এখনও প্রাসঙ্গিক’।

না, আসলে তোতলামি নয়, খানিকটা বিরতিতে, কথার গতি কমিয়ে, প্রতিটি শব্দের উপর জোর দিয়ে সে উচ্চারণ করছে, তার নিজস্ব ইচ্ছার কোনো প্রভাব নেই সেই প্রক্রিয়ায়। সুস্পষ্টভাবে সে নিজেই তার এই কাজটি করাও অনুভব করছে, এবং তার গাল, যা এর প্রাকৃতিক ফ্যাকাসে রূপটি কেবলই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল, তা আবারও লাল হেয়ে ওঠে।

‘আর আপনারা আমাকে ডেকেছেন, আমার পেশাগত ক্ষেত্রে সম্ভাব্য প্রার্থীদের শনাক্ত করার জন্য’? টমাস জিজ্ঞাসা করে।

‘না’, সম্পাদক হাসতে হাসতে বলে, ‘আমরা আপনার কাছে কোনো উপদেশ চাইছি না, আমরা আপনার স্বাক্ষর চাই’!

এবং আবারো সে খানিকটা আত্মশ্লাঘা অনুভব করে! সে উপভোগ করে সেই অনুভূতি, একজন শল্যচিকিৎসক হিসাবে সে তাহলে এখনও বিস্মৃত হয়নি! যদিও সে প্রতিবাদ করে, তবে শুধুই ভদ্রতা করে, ‘দাঁড়ান, এক মিনিট, তারা আমাকে চাকরী থেকে বের করে দিয়েছে, এর মানে কিন্তু এই না যে. আমি একজন বিখ্যাত চিকিৎসক’!

টমাসের দিকে তাকিয়ে সম্পাদক হেসে বলেন, ‘আমরাও ভুলিনি আপনি আমাদের পত্রিকায় লিখেছিলেন’।

‘হ্যাঁ’, খুব আগ্রহের সাথে দীর্ঘশ্বাস ফেলে টমাসের ছেলে, যা টমাস হয়তো খেয়াল করতে পারেনি।

‘আমি বুঝতে পারছিনা কিভাবে আমার নাম একটি পিটিশনে থাকলে আপনাদের রাজনৈতিক বন্দীদের তা উপকারে আসতে পারে। সেই সব মানুষদের নাম কি বাদ দেয়াই কি উচিৎ না, যারা এই সরকারের বিরাগভাজন, বরং শুধু তারাই স্বাক্ষর করলে কি ভালো হতো না, যাদের ক্ষমতায় থাকা লোকগুলোর উপর খানিকটা প্রভাব আছে’?

সম্পাদক হাসলেন, ‘হ্যাঁ, অবশ্যই তা হতো’।

টমাসের ছেলেও হাসে, সে এমন হাসিটা হাসলো, যেন সে অনেক কিছুই বোঝে,‘সমস্যা হচ্ছে তারা কখনোই স্বাক্ষর করবে না’!

‘তার মানে এই না যে, আমরা তাদের কাছে যাবো না’, সম্পাদক বলতে থাকেন, ‘অথবা আমরা এতটাই ভদ্র যে তাদের কোনো বিব্রত করবো না’; সে হাসে, ‘আপনার শোনা উচিৎ তারা কি অজুহাত দেয়। আসলেই তারা বিস্ময়কর’।

টমাসের ছেলে একমত হয়ে হাসে সম্পাদকের সাথে।

‘অবশ্যই তারা সবাই শুরু করে এমন দাবী করে যে, তারা আমাদের লেখা প্রতিটি বাক্যের সাথে একমত’; সম্পাদক বলতে থাকেন, ‘ তারা বলেন যে, আমাদের শুধুমাত্র ভিন্ন একটি কৌশল লাগবে, কোনো কিছু যা অনেক সতর্কপূর্ণ, আরো বেশী যুক্তিসঙ্গত, আরো বিবেচনা প্রসূত। তারা স্বাক্ষর করতে ভয় পায় আবার তারা চিন্তাও করে যদি তারা সেটি না করে, তাহলে আমাদের চোখে তারা ছোট হয়ে যাবে’।

আবারো টমাসের ছেলে ও সম্পাদক একসাথে হাসে।

এরপর, সম্পাদক টমাসকে একটি কাগজের পাতা এগিয়ে দেয়, যেখানে সংক্ষিপ্ত একটি লেখা ছিল প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টকে আহবান করে, অপেক্ষাকৃত ভদ্রভাবে, সব রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দেবার জন্য।

তার নিজের মনে ধারণাটি নিয়ে দ্রুত খানিকটা ভাবে টমাস। রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি ? সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করার আবেদন মঞ্জুর করা হবে কারণ এই কমিউনিস্ট সরকারের প্রত্যাখ্যাত মানুষগুলো (এবং সেকারণে তারা নিজেরাও সম্ভাব্য রাজনৈতিক বন্দী) এর প্রেসিডেন্টের কাছে এমন কিছু দাবী করেছে বলে? এই ধরনে আর্জি শুধুমাত্র যে কাজটি করতে পারে তাহলো, রাজনৈতিক বন্দীদের ক্ষমা করার প্রক্রিয়াটি ঠেকাবে, যদি ঘটনাচক্রে এমন কোনো পরিকল্পনা থাকে সরকারের।

তার চিন্তার সূত্রে বিঘ্ন সৃষ্টি করে তার ছেলে। ‘মূল বিষয়টি হচ্ছে এমন কিছু প্রতিষ্ঠা করা যে এই দেশে এখনও মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ আছেন, যারা ভয় পান না। এবং দেখানো যে, কার অবস্থান আসলে কোথায়, ভুসি থেকে গম আলাদা করা’।

সত্য, সত্য, টমাস ভাবলো, কিন্তু তার সাথে রাজনৈতিক বন্দীদের নিয়ে এমন কিছু করার কি সম্পর্ক আছে? হয় আপনি তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবেন অথবা গমকে ভুসি থেকে আলাদা করবেন। দুটো কাজ তো একই নয়।

সম্পাদক জিজ্ঞাসা করে, ‘মনস্থির করতে পারছেন না’?

হ্যাঁ, সে মনস্থির করতে পারছিল না। কিন্তু সেটি স্বীকার করতেও সে ভয় পাচ্ছিল। দেয়ালে একটি ছবি আছে, একটি সৈন্যের ছবি, যে আঙ্গুল তুলে তাকে হুমকি দিচ্ছে রেড আর্মিতে যোগ দিতে আপনি কি ইতস্তত বোধ করছেন? অথবা আপনি কি এখনও দুই হাজার শব্দে স্বাক্ষর করেন নি? অথবা আপনিও দুই হাজার শব্দে সই করেছেন? অথবা, আপনি বলতে চাইছেন, আপনি পিটিশনের আর্জি পত্রে স্বাক্ষর করতে চান না? কিন্তু সৈন্যটি যা কিছুই বলুক না কেন, এটি ছিল একটি হুমকি।

সম্পাদক কেবলই বলে শেষ করেছেন, তিনি কি ভাবেন সেই সব মানুষদের সম্বন্ধে যারা মনে করেন যে, রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা উচিৎ, তবে হাজারটা কারণ হাজির করান এই পিটিশনে সই করার বিপক্ষে। তার মতে, তাদের কারণগুলো সব নানা ধরনের অজুহাত, তাদের অজুহাতগুলো তাদের কাপুরুষতার ঢাকার একটি প্রচেষ্টা। টমাস আর কি বলতে পারে?

অবশেষে হাসি দিয়েই টমাস তার নীরবতা ভঙ্গ করে, দেয়ালে পোস্টারটির দিকে ইঙ্গিত করে সে বলে, ‘ঐ সৈন্যটা আমাকে যখন হুমকি দিচ্ছে, জিজ্ঞাসা করছে আমি সই করবো কি করবো না, আমি ভারমুক্ত হয়ে পরিষ্কার মাথায় ভাবতে পারছি না’।

কিছুক্ষণের জন্য তারা তিনজনেই আবার হাসে।

হাসি থেমে আসলে টমাস বলে, ‘ঠিক আছে, আমি বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখবো, পরবর্তী কয়েক দিনের মধ্যে কি আমরা আবার একসাথে দেখা করতে পারি’?।

‘অবশ্যই যে কোনো সময়’, সম্পাদক বলেন, ‘কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পিটিশনের জন্য অপেক্ষা করা যাবেনা। আমরা পরিকল্পনা করেছি আগামীকালই এটি প্রেসিডেন্টের কাছে জমা দিতে’?

আগামীকাল ? আর হঠাৎ করে টমাসের মনে পড়ে সেই স্থূল পুলিশের লোকটিকে, এই চওড়া থুতনি সহ লম্বা সম্পাদকের সমালোচনা করেছিল সে। সবাই তাকে সেই বিবৃতি সই করানোর চেষ্টা করছে, যা নিজে সে লিখেনি।

‘ভাবার কিছু নেই’!, তার ছেলে বলে। যদিও তার শব্দগুলো আক্রমণাত্মক, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর ছিল প্রায় দয়া প্রার্থনা করার মতই। এবার তারা একে অপরের চোখে চোখ রাখে, টমাস লক্ষ্য করে যখন ছেলেটি মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছে সে তার উপরের ঠোটের বা দিকটা খানিকটা উপরে দিকে উঠে যাচ্ছে। এই অভিব্যক্তিটি সে তার নিজের মুখে দেখেছে, যখনই সে আয়নার সামনে দাড়িয়ে যাচাই করার চেষ্টা করছে, ভালো করে দাড়ি কামিয়েছে কিনা। অন্য কারো মুখে সেটি আবিষ্কার করে সে অস্বস্তি অনুভব করে।

যখন পিতামাতারা তাদের শিশুদের সাথে বাস করেন, তাদের শৈশবের পুরোটা সময় জুড়ে, তারা এই ধরনের সদৃশতার প্রতি অভ্যস্ত হয়ে পড়েন সাধারণত। তাদের কাছে এগুলো খুবই তুচ্ছ মনে হয়, অথবা যদি তারা খানিকটা বিরতি নিয়ে ভাবেন ও চিন্তা করেন বিষয়টি নিয়ে, তাদের কাছে বিষয় মনে হতে পারে বেশ মজার একটি ব্যাপার। কিন্তু তার জীবনে প্রথমবারের মত টমাস তার ছেলের সাথে কথা বলছে। তার নিজের অপ্রতিসাম্য মুখের মুখোমুখি বসে থাকতে সে অভ্যস্ত নয়!

কল্পনা করুন আপনার একটি হাত কেটে অন্য আরেকজনের শরীরে সেটি প্রতিস্থাপন করা হলো। কল্পনা করুন সেই মানুষটি আপনার বিপরিতে বসে আছে আর সেই হাতটি নিয়ে আপনার মুখের সামনে নানা অঙ্গভঙ্গি করছে। আপনি সেই হাতের দিকে তাকিয়ে আছে যেন ভুত দেখছেন। যদিও এটি আপনার ব্যক্তিগত, প্রিয় হাত, কিন্তু আপনি আতঙ্ক বোধ করবেন সেই হাতটির আপনাকে স্পর্শ করার কোনো সম্ভাবনায়।

তার ছেলে আরো যোগ করে, ‘আপনি কি যারা নির্যাতিত, তাদের পক্ষে না’? এবং টমাস হঠাৎ করে বুঝতে পারে, এখানে, এই দৃশ্যে আসলেই কি হুমকির সম্মুখীন, এখানে তারা যা খেলছে তা রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন নয়, তার ছেলের সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে। যদি সে স্বাক্ষর করে, তাদের নিয়তি একীভূত হবে এবং টমাস কম বেশী বাধ্য হবে তার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য। আর যদি সে ব্যর্থ হয় এখানে স্বাক্ষর করতে, তাদের সম্পর্ক আগের মতই অস্তিত্বহীন থাকবে। যদিও এখনও যতটা না তার নিজের ইচ্ছায় তার চেয়ে বেশী তার ছেলের ইচ্ছায়, যে তার বাবাকে প্রত্যাখ্যান করবে তার কাপুরুষোচিত আচরণের জন্য।

সেই দাবাড়ুর মত পরিস্থিতিতে সে ছিল, যে কিনা চেকমেট এড়াতে পারবে না এবং বাধ্য হবে খেলা ত্যাগ করতে। সে এই পিটিশনের সই করুক বা না করুক কিছুই পরিবর্তিত হবে না। তার নিজের জীবন আর রাজনৈতিক বন্দীদের জীবনে এটি সামান্যতম কোনো পরিবর্তন আনবে না।

‘আমাকে কাগজটা দয়া করে দেন’, সে বলে, কাগজটা হাতে নেয় সে।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য