বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব: ১৪

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৯-২৭ ২৩:৫০:২৮

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা পঞ্চম পর্ব (নির্ভারতা এবং ভার)
১৪
টমাসের সিদ্ধান্তের জন্য যেন তাকে পুরস্কৃত করা হচ্ছে এমন ভাবেই সম্পাদক বললেন, ‘ইডিপাস নিয়ে আপনার লেখাটি খুবই ভালো হয়েছিল’।

তাকে কলম এগিয়ে দিয়ে তার ছেলেও যোগ করে, ‘কিছু ধারণার শক্তি বোমা বিস্ফোরণের মত’।

যদিও সম্পাদকের প্রশংসা তার ভালো লেগেছিল, কিন্তু তার ছেলের রূপকটি আরোপিত ও বেমানান মনে হয়েছিল তার কাছে। ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে একমাত্র আমি সেই বিস্ফোরণের শিকার’, সে বলে, ‘সেই ধারণাগুলোর কল্যাণে আমি আমার রোগীদের উপর আর অস্ত্রোপচার করতে পারছি না’।

টমাসের উত্তরটি শুনে মনে হয়েছিল, খুব শীতল এবং খানিকটা শত্রুভাবাপন্ন।

স্পষ্টতই দ্বিমত পোষণ করার মত একটি পরিস্থিতি এড়ানো আশায়, খানিকটা ক্ষমা প্রার্থনার সুরে, সম্পাদক বলেন, ‘কিন্তু চিন্তা করে দেখুন সেই সব মানুষদের কথা যারা আপনার লেখাটি দ্বারা উপকৃত হয়েছে’।

শৈশব থেকেই, টমাস একটি, শুধু একটি মাত্র জিনিসের সাথে মানুষকে সাহায্য করার বিষয়টি সংযুক্ত করেছিল : চিকিৎসা সেবা। কিভাবে তার সেই প্রবন্ধটি মানুষকে সহায়তা করতে পারে? এই দুজন তাকে এগুলো কি গলাধঃকরণ করানোর চেষ্টা করছে, তার সমস্ত জীবনকে হ্রাস করা হয়েছে ‘ইডিপাস’ সংক্রান্ত একটি ধারণায় অথবা আরো তুচ্ছ কোনো বিষয়ে: একটি আদিম একক না! কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে।

‘হয়তো মানুষকে এটি সাহায্য করেছে, হয়তো বা করেনি’, সে বলে ( কণ্ঠ তখনোও শীতল, যদিও সম্ভবত সে নিজে বিষয়টি বুঝতে পারেনি), কিন্তু চিকিৎসক হিসাবে আমি ‘জানি’, আমি বেশ কিছু মানুষের জীবন বাঁচিয়েছি’।

আবারো নীরবতা। টমাসের ছেলে সেটি ভাঙ্গে, ‘ধারণাও জীবন বাঁচাতে পারে’।

ছেলেটির মুখে নিজের মুখটি দেখে টমাস ভাবে, কত অদ্ভুত লাগে কারো নিজের ঠোটকে তোতলাতে দেখলে।

‘আপনি কি জানেন, আপনি যা লিখেছেন তার সবচেয়ে সেরা অংশটি কি’? ছেলেটি বলতে থাকে, টমাস তার কষ্টটাকে দেখতে পারে কথা বলার সময়। ‘সমঝোতা করতে আপনার অস্বীকৃতি, কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ সেই সম্বন্ধে আপনার সুস্পষ্ট ধারণা, এমন কিছু যা আমরা হারাতে শুরু করেছি ।আমাদের কোনো ধারণাই নেই, অপরাধবোধ ভুগতে কেমন লাগে। কমিউনিস্টদের একটা অজুহাত আছে, স্ট্যালিন তাদের ভুল পথ দেখিয়েছিল। খুনিদের অজুহাত আছে তাদের মায়েরা ভালোবাসেনি, এবং হঠাৎ করেই আপনি এসে বললেন, কোনো অজুহাত দেখানো চলবে না। ইডিপাসের চেয়ে কেউই তার আত্মায় ও বিবেকে আরো বেশী নিষ্পাপ হতে পারবে না। কিন্তু তারপরেও সে নিজেকে শাস্তি দিয়েছিল যখন যে দেখেছিল, সে কি করেছে’।

টমাস তার ছেলের মুখ থেকে জোর করে চোখ সরিয়ে সম্পাদকের উপর মনোযোগ দেবার চেষ্টা করে। টমাস খুব বিরক্ত হয়, ইচ্ছা হয় তাদের সাথে তর্ক করার। কিন্তু পুরো বিষয়টি ছিল একটি ভুল বোঝাবুঝি। ভালো আর খারাপের সীমানা ভয়ানক অস্পষ্ট। আমি কারো শাস্তি দাবী করিনি। সেই সব মানুষকে শাস্তি দেয়া, যারা জানে না তারা কি করেছে, খুবই বর্বরোচিত। ইডিপাসের পুরাণ খুব সুন্দর, কিন্তু সেটিকে এভাবে ব্যবহার করা…, তার আরো কিছু বলার ছিল, কিন্তু হঠাৎ করেই তার মনে হয় ঘরটিতে রাষ্ট্রীয় পুলিশের গোপন আড়ি পাতা থাকতে পারে। তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিলনা আগত শতাব্দীর কোনো ইতিহাসবিদ দ্বারা উদ্ধৃত হবার জন্য। পুলিশের দ্বারা উদ্ধৃত হতেও সে অনেক ভয় পায়। এটাই তো তারা তার কাছ থেকে চেয়েছিল একসময়? তার লেখাটির প্রত্যাখ্যান আর নিন্দাজ্ঞাপন? তার সেই ধারণাটা ভালো লাগেনি যে তার নিজের মুখ থেকে সে তাদেরকে এ বিষয়ে কোনো রসদের যোগান দিক। এছাড়া সে জানতো এই দেশে যে কেউ যা কিছু বলবে, তা যে কোনো সময়ে রেডিওতে সম্প্রচারিত হতে পারে। সে চুপ করে থাকে।

সম্পাদক বলেন. ‘আমি ভাবছি আপনার মনটাকে পরিবর্তন করলো কি’।

‘আর আমি যা ভাবছি, কি আমাকে বাধ্য করেছিল প্রথমেই পত্রিকায় সেই লেখাটি লেখার জন্য’, টমাস বলে।এবং ঠিক তখনই তার মনে পড়লো: তেরেজা তার বিছানার পাশে নলখাগড়া ঝুড়িতে রাখা কোনো শিশুর মত নদীর উজান থেকে ভেসে এসেছিল। হ্যাঁ, সে কারণেই সে বইটি পড়েছিল এবং রমুলাস, মোজেস আর ইডিপাসের গল্পে সে ফিরে গিয়েছিল। এবং একই সাথে সে আবারো তেরেজাকে লাল কাপড়ে জড়ানো কাকটিকে বুকে মধ্যে চেপে দাড়িয়ে থাকতে দেখে সে । তেরজার সেই ছবিটি তাকে শান্তি দেয়। তার মনে হয়েছিল দৃশ্যটি বলছে, তেরেজা এখনও বেঁচে আছে, সে তার সাথে একই শহরে বাস করছে আর কিছুই তার দরকার নেই।

এবার নীরবতা ভাঙলেন সম্পাদক, ‘আমি বুঝেছি। শাস্তি দেবার ধারণাটি আমারও পছন্দের না, তিনি যোগ করেন হাসি মুখে, ‘আর যাই হোক না কেন, আমরা তো কারো উপর শাস্তি আরোপ করা হোক, এমন কোনো দাবী করছি না। আমরা এটি বন্ধ করার দাবী করছি’।

‘আমি জানি’, টমাস বলে। পরের কিছু মুহূর্তে সে এমন কিছু করবে যা সম্ভবত মহৎ এবং অবশ্যই পুরোপুরি অর্থহীন ( কারণ এটি রাজনৈতিক বন্দীদের কোনো সাহায্য করবে না) এবং তার নিজের জন্য সুখকর নয় ( কারণ এটি ঘটেছে, তার উপর এই দুজনের চাপিয়ে দেয়া পরিস্থিতির কারণে)।

তার ছেলে বলে, ‘এখানে সই করা আপনার কর্তব্য’, প্রায় অনুনয়ের সুরে।

কর্তব্য? তার ছেলে তাকে তার কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে? তার উপর এর চেয়ে খারাপ কোনো শব্দ কেউ আরোপ করতে পারবে না। আরো একবার তার চোখের সামনে তেরেজার ছবিটি ভেসে আসলো। তেরেজা তার বুকের মধ্যে কাকটি জড়িয়ে ধরে আছে। তারপর তার মনে হয়, একদিন আগেই পুলিশের এক গুপ্তচর বেশ তাকে বেশ বিরক্ত করেছে। তেরেজার হাত আবারও কাঁপতে শুরু করেছে, তার বয়স হয়েছে। তার কাছে তেরেজাই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ছয়টি দৈব ঘটনায় তার জন্ম, প্রধান সার্জনের সায়াটিকা থেকে যে ফুলের জন্ম, তেরেজা, তার সব ‘এস মুস সাইন’ (বা যা অবশ্যই তাকে করতেই হবে) এর বিপরীত দিক – সে হচ্ছে একটি মাত্র মানুষ যাকে টমাস ভালোবাসে।

তাহলে কেন সে এত চিন্তা করছে, এখানে সই করবে কি করবে না? তার কাছে একটাই মানদণ্ড তার সব সিদ্ধান্তের: অবশ্যই এমন কিছু সে করবে না, যা তেরেজার কোনো ক্ষতি করতে পারে। টমাস রাজনৈতিক বন্দীদের বাঁচাতে পারবে না, কিন্তু সে তেরেজাকে সুখী করতে পারবে। সত্যিকারভাবে আসলেই এমনকি সেটা করতেও সে সফল হতে পারেনি, কিন্তু যদি সে পিটিশন সই করে, সে বেশ নিশ্চয়তার সাথেই বলতে পারে পুলিশের সেই গোপন এজেন্ট এর নিয়মিত যাতায়াত সহ্য করতে হবে তেরেজাকে। আর তার হাতও আরো বেশী করে কাঁপবে।

‘মাটিতে অর্ধেক কবর দেয়া কোনো কাককে খুড়ে বের করা’, সে বলে, ‘প্রেসিডেন্টের কাছে রাজবন্দীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার পিটিশন পাঠানোর চেয়েও অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ’।

সে জানতো তার কথার অর্থ দূর্বোধ্য তাদের কাছে। এবং সেকারণেই আরো বেশী সে বিষয়টি উপভোগ করেছিল। হঠাৎ অপ্রত্যাশিত এক মাদকতা সে অনুভব করে। সেই একই কৃষ্ণ মাদকতা যা সে অনুভব করেছিল যখন সে তার প্রথম স্ত্রীকে বলেছিল, তাকে আর তার ছেলেকে দেখার কোনো ইচ্ছা সে আর পোষণ করেনা। সেই একই কৃষ্ণ মাদকতা যা সে অনুভব করেছিল যখন সে পত্রিকায় চিঠি পাঠিয়েছিল, যার অর্থ ছিল চিকিৎসা বিজ্ঞানের পেশাগত জীবন সে আর অব্যাহত রাখতে পারবে না। সে আদৌ নিশ্চিত না, সে যা করছে সেটি সঠিক কিনা, কিন্তু সে নিশ্চিত সে যা সে করছে সেটি সে তার নিজের ইচ্ছানুসারেই করছে।

‘আমি দুঃখিত’, সে বলে, ‘কিন্তু আমি এখানে সই করবো না’।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য