বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, পঞ্চম পর্ব: ১৫

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৯-২৯ ০০:৩৯:৩৯

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা পঞ্চম পর্ব (নির্ভারতা এবং ভার)
১৫
বেশ কিছুদিন পর টমাস সংবাদপত্রে পিটিশনের সংক্রান্ত খবরগুলো পড়েছিল।

অবশ্যই, সেখানে এমন কোনো একটি শব্দও ছিল না, যা কিনা ইঙ্গিত করে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দাবী করার জন্য এটি খুব বিনম্র ভাষায় লেখা কোনো আবেদন ছিল। কোনো পত্রিকাই সেই সংক্ষিপ্ত লেখা থেকে একটি বাক্যও উল্লেখ করেনি। বরং তারা দীর্ঘ অস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন, নানা ভয়ঙ্কর শব্দ ব্যবহার করে, কিভাবে রাষ্ট্র বিরোধী এই ধরনের কোনো ঘোষণার অর্থ হচ্ছে সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে নতুন আন্দোলনে ভিত্তি রচনা করা। তারা সব স্বাক্ষরকারীদের নামের একটি তালিকাও উল্লেখ করেছিল, প্রত্যেকের নামের সাথে ছিল তাদের প্রতি মানহানিকর আক্রমণ, যা টমাসকে রীতিমত ভয় পাইয়ে দিয়েছিল।

এমন না যে এটি প্রত্যাশিত ছিল না। যে কোনো ধরনের সম্মিলিত প্রচেষ্টা (যেমন কোনো সভা, আবেদন, পথ-সমাবেশ) যা কিনা কমিউনিস্ট পার্টি আয়োজন করেনি, সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অবৈধ হিসাবে চিহ্নিত হবে আর এর সাথে সংশ্লিষ্টরা সবাই বিপদের সম্মুখীন হবে, এই বাস্তব সত্যটি কারোরই অজানা ছিলনা। কিন্তু হয়তো এটাই তাকে আরো বিষণ্ণ করেছিল পিটিশনটিতে সে নিজে স্বাক্ষর করেনি বলে।

কেন সে স্বাক্ষর করেনি? সে বিষয়টি আর ঠিকমত মনে করতে পারে না, তার সেই সিদ্ধান্ত নেবার কারণ কি ছিল।

এবং আরো একবার, আমি তাকে সেভাবে দেখতে পাচ্ছি, এই উপন্যাসের শুরুতে আমার কাছে সে যেভাবে আবির্ভূত হয়েছিল : তার ফ্ল্যাটের জানালার সামনে দাড়িয়ে মাঝখানের কোর্ট ইয়ার্ডের অপরদিকের দালানটির দেয়ালের দিকে মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে ছিল সে।

এটাই সেই চিত্র যেখান থেকে তার জন্ম হয়েছিল। যেমন আমি আগে উল্লেখ করেছিলাম, মানুষের মত চরিত্রদের জন্ম হয়না কোনো রমণীর জরায়ু থেকে। তাদের জন্ম হয় কোনো একটি পরিস্থিতি থেকে, কোনো একটি বাক্য থেকে, কোনো একটি রূপক থেকে, যা মূলত একটি মৌলিক মানবিক সম্ভাবনা যা লেখক ভাবেন আর কেউ সেটি আবিষ্কার করেনি অথবা গুরুত্বপূর্ণ কিছু কেউ কখনো বলেননি তাদের সম্বন্ধে। কিন্তু এটাই কি সত্যি নয় যে, একজন লেখক শুধুমাত্র নিজের সম্বন্ধেই লিখতে পারেন? অক্ষমতার সাথে কোর্ট ইয়ার্ডের অন্যদিকে তাকিয়ে, কি তার করা উচিৎ সেই দ্বন্দ্ব নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, ভালোবাসার একটি মুহূর্তে নিজের পেটের মধ্যে অদম্য গুড় গুড় শব্দ শুনতে শুনতে, বিশ্বাসঘাতকতা, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করার আকর্ষণীয় পথ পরিত্যাগ করার জন্য প্রয়োজনীয় ইচ্ছাশক্তির অভাব; বিশাল মিছিলে কারো মুষ্টিবদ্ধ হাত উপরে তোলা, গোপন আড়িপাতার যন্ত্রের সামনে কারো বুদ্ধিমত্তা প্রদর্শন - আমি এই সব ধরনের পরিস্থিতি সম্বন্ধে জানি, আমি নিজেও এই ধরনের অভিজ্ঞতার শিকার, কিন্তু তার কোনোটাই সেই মানুষটির জন্ম দেয়নি যা আমার জীবন বৃত্তান্ত আর আমার ‘আমি’কে প্রতিনিধিত্ব করছি।আমার উপন্যাসের চরিত্ররা আসলে আমার নিজেরই অপূর্ণ সম্ভাবনাগুলো।

সেকারণে আমি তাদের যেমন ভালোবাসি, তেমনি সমানভাবে শঙ্কিতও হই তাদের আচরণে। প্রত্যেকেই একটি সীমানা অতিক্রম করেছে, যা আমি নিজে এড়িয়ে গেছি। সেই অতিক্রান্ত সীমানা (যে সীমানার ওপারে আমার নিজের আমিত্বের শেষ হয়) আমাকে সবচেয়ে বেশী আকৃষ্ট করে। কারণ সেই সীমানার ওপারে সেই গোপনীয়তার শুরু হয়, যা উপন্যাস জানতে চায়। উপন্যাস লেখকের স্বীকারোক্তি নয়; পৃথিবী যে ফাঁদে পরিণত হয়েছে, সেখানে মানব জীবনের একটি নিরীক্ষণ এটি, কিন্তু যথেষ্ট হয়েছে, টমাসের কাছে ফিরে আসা যাক।

তার নিজের ফ্ল্যাটে একা, কোর্ট ইয়ার্ডের বিপরীত দিকে দালানটির নোংরা দেয়ালের দিকে সে তাকিয়ে ছিল। সে লম্বা খানিকটা কুঁজো হয়ে সামনে ঝুঁকে থাকা বড় থুতনির মানুষটা, আর সেই মানুষটির বন্ধুটির অনুপস্থিতি অনুভব করে, যাদের সে চেনে না, তারা এমনকি তার পরিচিত বলয়েরও নয়। তার মনে হয়েছিল যেন, কেবলই খুব সুন্দরী এক রমণীর সাথে তার দেখা হয়েছে রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে, কিন্তু তাকে কিছু বলার আগে সে ইস্তাম্বুল কিংবা লিসবনগামী একটি ট্রেনে উঠে যায়। তারপর সে চেষ্টা করে ভাবতে কি করা উচিৎ ছিল তার, এমনকি যদিও সে তার সাধ্যমত চেষ্টা করছে আবেগের জগতে সবকিছুকে একপাশে সরিয়ে রাখার জন্য (যে মুগ্ধতা ছিল তার সম্পাদকের প্রতি আর তার ছেলে যে বিরক্তির জন্ম দিয়েছিল)। সে এখনও নিশ্চিত না যে কাগজটা তারা দিয়েছিল সেটিতে তার সই করা উচিৎ ছিল কি না।

যখন অন্যদের নীরব করা হয়, তখন কি কারো উচ্চকণ্ঠ হওয়া উচিৎ? হ্যাঁ।

আবার অন্য দিকে, কেনই বা কাগজগুলো এত জায়গা দিয়েছে এই পিটিশনকে? যাই হোক না কেন প্রেস (পুরোপুরি রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত) বিষয়টি চেপে যেতে পারতো, উভয়পক্ষের জন্য সেটি বুদ্ধিমানের কাজ হতো। যদি তারা পিটিশনটি নিয়ে প্রচারণা করে, তাহলে পিটিশনটি শাসকের হাতেই ব্যবহৃত হবে, স্বর্গ থেকে আসা মান্নার মত, নতুন করে নির্যাতন শুরু করার নিখুঁত সূচনা আর যৌক্তিকতা।

তাহলে তার কি করার ছিল? সই করা, নাকি না করা?

এই প্রশ্নটি সূত্রবদ্ধ করার আরেকটি উপায় হচ্ছে, চিৎকার করা কি ভালো, আর সেভাবে পরিণতিকে তরান্বিত করা, নাকি চুপ থেকে আর ধীর মৃত্যু অর্জন করা ভালো?

এই সব প্রশ্নগুলোর কি কোনো উত্তর আছে?

এবং সেই ভাবনাটি আবার সে ভাবে, যা আমরা ইতিমধ্যেই জানি: মানুষর জীবন ঘটে শুধুমাত্র একবারের জন্য, এবং যে কারণে আমার আমরা নিশ্চিত হতে পারিনা আমাদের নেয়া সিদ্ধান্তগুলোর কোনগুলো ভালো আর কোনগুলো খারাপ, কোনো পরিস্থিতিতে আমরা কেবল একটিমাত্র সিদ্ধান্ত নিতে পারি, আমরা দ্বিতীয়, তৃতীয় আর চতুর্থ জীবন পাই না, যেখানে নানা ধরনের সিদ্ধান্তগুলো আমরা তুলনা করতে পারি।

এই ক্ষেত্রে ইতিহাসও একক ব্যক্তির জীবন সদৃশ। চেকদের কেবলমাত্র একটি ইতিহাস আছে। টমাসের জীবনের মত একদিন নিশ্চয়ই সেটি শেষ হবে, আর কখনোই যার পুনরাবৃত্তি হবে না।

১৬১৮ সালে চেক ভূস্বামীরা সাহস করে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন, ভিয়েনা থেকে রাজত্ব করা সম্রাটের বিরুদ্ধে তারা অবস্থান নিয়েছিল প্রাগ দুর্গে, রাজার দুই উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে। তাদের এই ঔদ্ধত্য সূচনা করেছিল ত্রিশ বছর ব্যাপী যুদ্ধের, যা প্রায় পুরোপুরিভাবে চেক জাতিকে ধ্বংস করেছিল। চেকদের কি আরো সাহসের পরিবর্তে সংযত আচরণ করা উচিৎ ছিল? উত্তর খুব সাধারণ মনে হতে পারে, কিন্তু সেটি নয়।

তিনশ বিশ বছর পরে, ১৯৩৮ এর মিউনিখ সম্মেলনের পর সারা পৃথিবী সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, চেকদের দেশটিকে হিটলারের কাছে বিসর্জন দেবার জন্য। চেকদের কি রুখে দাঁড়ানো উচিৎ ছিল তাদের দেশের চেয়ে আকারে আট গুণ বড় একটি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে? ১৬১৮ র ব্যতিক্রম, তারা সংযত আচরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল – তাদের আত্মসমর্পণ সূচনা করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের, যা একদিন সূচনা করেছিল বহু দশক এবং এমনকি শতাব্দীর জন্য তাদের জাতির স্বাধীনতা হারাতে। তাদের কি সতর্ক হবার চেয়ে আরো বেশী সাহস দেখানো উচিৎ ছিল? তাদের কি করা উচিৎ ছিল?

যদি চেক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করা যেত, প্রতিবারই আমরা অবশ্য চাইতাম অন্য সম্ভাবনাগুলো যাচাই করার জন্য আর পরিণতিগুলো তুলনা করার জন্য, এমন কোনো পরীক্ষা ছাড়া, এই ধরনের সব বিবেচনাগুলো কেবল হাইপোথিসিসের খেলাই থেকে যাবে।

‘আইনমল ইস্ট কাইনমল’, জার্মান এই বাক্যটির মানে, যা মাত্র একবারের ঘটে জন্য তা আদৌ ঘটেনি বললেই চলে। চেকদের ইতিহাস পুনরাবৃত্তি হবে না, ইউরোপের ইতিহাসেরও পুনরাবৃত্তি হবে না। চেক আর ইউরোপের ইতিহাস এ জোড়া রেখাচিত্র, যা আঁকা হয়েছিল মানব জাতির নিয়তি নির্দিষ্ট অনভিজ্ঞতার কলমে। কোনো একক মানুষের জীবনের মত ইতিহাসও নির্ভার, দুঃসহ নির্ভার, পালকের মত হালকা, বাতাসে ঘূর্ণি খাওয়া ধুলোর মত, সেই সব কিছুর মতই যাদের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না আগামীকাল।

আরো একবার, ভালোবাসার মত স্মৃতিবেদনা নিয়ে, টমাস সেই লম্বা কুঁজো হয়ে থাকা সম্পাদকের কথা ভাবে। সেই মানুষটি এমন ভাবে আচরণ করছিল যেন, ইতিহাস কোনো রেখাচিত্র না বরং পুরোপুরি সমাপ্ত কোনো চিত্রকর্ম। তিনি এমনভাবে আচরণ করেছিলেন যেন, তিনি যা কিছু করেছেন তার অনন্তবার পুনরাবৃত্তি হবে, চিরন্তনভাবে তা ফিরে আসবে, তার কাজ সম্বন্ধে ন্যুনতম সন্দেহ ছাড়া। তিনি আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, তিনি সঠিক, তার জন্য এটি সংকীর্ণ মনের চিহ্ন না বরং একটি সদগুণ। হ্যাঁ, সেই মানুষটি এমন একটি ইতিহাসে বাস করে যা টমাসের ইতিহাস থেকে ভিন্ন: যে ইতিহাস কোনো রেখাচিত্র নয় (অথবা সেটি তিনি অনুধাবনও করেননি)।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য