বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, সপ্তম পর্ব : ৩

 প্রকাশিত: ২০১৬-১১-০৭ ০১:৫৭:৫৭

কাজী মাহবুব হাসান:

বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, সপ্তম পর্ব (কারেনিনের হাসি)

কারেনিন দুটি রুটির রোল আর একটি মৌমাছির জন্ম দেয়। সে অবাক হয়ে তার উত্তরসূরিদের দিকে তাকিয়ে থাকে, রোলগুলো পুরোপুরিভাবে প্রশান্ত, তবে মৌমাছিটি মাদকাসক্তদের মত খানিকটা এলোমেলোভাবে হেটে উড়ে চলে যায়।

অথবা এমনটাই হয়েছিল তেরেজার স্বপ্নে। যে মুহূর্তে টমাসের ঘুম ভেঙ্গেছে, তাকে তেরেজা তার স্বপ্নের গল্পটি বলেছে, তারা দুজনে সেখানে খানিকটা সান্ত্বনাও খুঁজে পেয়েছিল।এটি কারেনিনের অসুখটিকে রূপান্তরিত করেছিল একটি গর্ভধারণ আর এমন কিছুর জন্ম দেবার নাটকে, যা একই সাথে হাস্যকর আর হৃদয়স্পর্শী: দুটি রুটির রোল আর একটি মৌমাছি।

আবারো অযৌক্তিক আশার শিকার হয় তেরেজা। বিছানা থেকে উঠে তার কাপড় পরে নেয় সে। এখানেও, তার দিন শুরু হয় দুধ, রুটির রোলের জন্যে দোকানে যাওয়ার মাধ্যমে। কিন্তু সেদিন সকালে হাটার সময় যখন সে কারেনিনকে ডাকে, সে খুব কষ্ট করে শুধু তার মাথাটি তুলতে পেরেছিল। এই প্রথমবারের মত কারেনিন তার নিত্যদিনের একটি আচারে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করলো, যে আচারটি সে নিজেই তাদের উপর জোর করে চাপিয়ে দিয়েছিল।

কারেনিনকে ছাড়াই তেরেজা বের হয়। ‘কারেনিন কোথায়’? কাউন্টারের পেছনের মহিলাটি জিজ্ঞাসা করে, কারেনিন জন্যে রুটির রোল প্রতিদিনের মত আজও সে প্রস্তুত করে রেখেছে। তেরেজা সেটি তার ব্যাগে নিয়ে বাসায় ফেরে। যখন দরজা কাছে তখনই সে সেটি বের করে কারেনিনকে দেখায়, সে চাইছিল যেন কারেনিন তার কাছে এসে সেটি নিয়ে যাক। কিন্তু সে কোনো নড়াচড়া না করেই শুয়ে থাকে ।

টমাস দেখতে পেয়েছিল তেরেজা কতটা কষ্ট পাচ্ছে। সে নিজেই রোলটি মুখে নিয়ে কারেনিনের উল্টোদিকে বসে পড়ে, তারপর ধীরে ধীরে হামাগুড়ি দিয়ে তার দিকে অগ্রসর হয়।

কারেনিন তার চোখ দিয়ে টমাসকে অনুসরণ করে, কৌতূহলের একটি ঝলক সেখানে দেখা যায় যায় বলে মনে হয়, কিন্তু সে উঠে দাড়ায় না। টমাস ঠিক কারেনিনের নাকের কাছ তার মুখটা নিয়ে আসে। শরীর না নড়িয়ে কুকুরটি টমাসের মুখে ধরা রোলটির এক প্রান্ত তার মুখ দিয়ে ধরে, টমাস তার প্রান্তটি ছেড়ে দেয় যেন কারেনিন পুরোটা তার মুখে নিয়ে খেতে পারে।

তখনও মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে, টমাস কিছুটা পিছনে সরে আসে, তার পিঠ উঁচু করে কুকুরের মত ডাকতে শুরু করে, কারেনিনকে সে বোঝাতে চায় তার মুখের রোলটার জন্য সে তার সাথে যুদ্ধ করতে চাইছে। কিছুক্ষণ পর কুকুরটিও তেমনি ডাক দিয়ে প্রত্যুত্তর দেয়। অবশেষে! তারা যা আশা করছিল! কারেনিনের খেলার ইচ্ছা হচ্ছে! কারেনিন বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা হারায়নি!

ঐ ডাকগুলোই কারেনিনের হাসি, আর তারা চেয়েছিল যত দিন সম্ভব এই হাসিটা টিকে থাকুক। সুতরাং টমাস আবারও তার কাছে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যায় এবং কারেনিনের মুখে থাকা রোলটার একটি অংশ ছিঁড়ে নেয়, তাদের মুখ এত কাছে যে, কুকুরের নিশ্বাসের গন্ধ পায় টমাস, কারেনিনের মুখের চুলগুলো তাকে সুড়সুড়ি দেয়। কুকুরটি আরো একটি ডাক দেয় তার মুখ খানিকটা বেকে যায়, এখন দুজনের মুখে রোলের টুকরো। তারপর কারেনিন অদ্ভুত একটি কৌশলগত ভুল করে বসে, সে তার মুখের অংশটা ফেলে দেয় তার মনিবের মুখের অর্ধেকটা নেবার আশায়, সব সময়ের মত সে ভুলে গিয়ে যে টমাস তার মত কুকুর নয় আর তার হাত আছে। তার অংশটি মুখ থেকে না ছেড়ে - টমাস মেঝে থেকে রোলের বাকী অংশটা তুলে নেয়।

‘টমাস’, তেরেজা চিৎকার করে বলে, ‘তুমি ওর কাছ থেকে রোল নিয়ে নেবে না তো’?

টমাস এবার দুটি অংশ মেঝেতে কারেনিনের সামনে রাখে, কারেনিন খুব দ্রুত একটি খেয়ে নেয় দ্বিতীয়টি তার মুখে ইচ্ছা করে দীর্ঘ সময় ধরে রাখে, যেন তার বিজয়কে সে দুজনের সামনে দেখাতে চায়।

দাড়িয়ে তাকে দেখতে দেখতে তারা দুজনে আরো একবার ভাবে, সে হাসছে, এবং যতক্ষণ সে হাসবে, তারা মৃত্যুদণ্ড সত্ত্বেও সে বেঁচে থাকার তাড়না অনুভব করবে।

পরের দিন আসলেই তার অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছিল। তারা একসাথে দুপুরে খেয়েছিল, সাধারণত দিনের এই সময়টায় তারা তাকে হাটতে নিয়ে যায় । তার অভ্যাস ছিল অস্থিরভাবে দুজনের মধ্যে দৌড়ে বেড়ানো। সেই দিন, যদিও তেরেজা যখন তার গলার বন্ধনী হাতে নেয়, বিষণ্ণ প্রাণহীনভাবে সে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তারা দুজনেই আনন্দিত থাকার চেষ্টা করে (তার জন্য ও তার সম্বন্ধে), খানিকটা উৎসাহিত করার চেষ্টা করে, আর অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর সে তাদের উপর করুণা করে, তিন পায়ে খুড়িয়ে খুড়িয়ে সে তাদের দিকে যায়, তেরেজাকে তার গলায় বন্ধনী পরিয়ে দিতে দেয়।

‘তেরেজা, আমি জানি তুমি ক্যামেরা ঘৃণা করো, আজ তুমি নিয়ে চলো, নেবে তো? টমাস বলে।

তেরেজা ভিতরে গিয়ে আলমারির দরজা খুলে খোজার চেষ্টা করে বহু দিন আগে পরিত্যক্ত আর বিস্মৃত ক্যামেরাটিকে। টমাস বলে, ‘একদিন তুমি খুশী হবে ছবিগুলো যদি থাকে। কারেনিন আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ ছিল’।

‘তুমি কি বোঝাতে চাইছো, অংশ ছিল মানে’? তেরেজা বলে, যেন তাকে কোনো সাপ কামড় দিয়েছে। ক্যামেরাটি আলমারির মেঝেতেই পড়ে ছিল তার চোখের ঠিক সামনে, কিন্তু সেটি নেবার জন্য নিচু হয়ে বসে না। ‘আমি সাথে করে ক্যামেরা নেবো না, কারেনিনকে হারানোর কোনো চিন্তা করতে অস্বীকার করছি, আর তুমি তাকে অতীত কাল ব্যবহার করে উল্লেখ করছো’। টমাস বলে, ‘আমি দুঃখিত’।

তেরেজা মৃদু ভাবে বলে, ‘ঠিক আছে। আমি নিজেই অতীত কাল হিসাবে তার কথা ভাবছি এমনটা লক্ষ্য করি সব সময়। আমি আমার মন থেকে জোর করে চিন্তাটা বাদ দেবার চেষ্টা করি, সেই জন্য আমি ক্যামেরা নেবো না’।

তারা নীরবে পাশাপাশি হাটে। নীরবতা হচ্ছে একটি মাত্র উপায় যেখানে কারেনিনকে আর অতীত কালের ভাষায় ভাবতে হবে না। তারা কারেনিনকে চোখের আড়াল হতে দেয় না। সারাক্ষণই তারা তার সাথে থাকে, অপেক্ষা করে তার হাসির জন্য। কিন্তু সে হাসে না, শুধুমাত্র তাদের সাথে হাটে, তার তিন পায়ের উপর খুড়িয়ে খুড়িয়ে।

‘সে শুধু কাজটি করছে আমাদের জন্যে’ তেরেজা বলে, ‘সে হাটতে যেতে চায়নি, সে কাজটি করছে আমাদের খুশি করার জন্য’।

তেরেজা যা বলছিল তা খুব দুঃখের, কিন্তু সেটি তারা অনুধাবন না করেই আনন্দিত ছিল। তারা সুখী ছিল তাদের দুঃখের অনুপস্থিতির জন্য নয় বরং তার কল্যাণে। তারা হাত ধরে ছিল, দুজনের চোখে ছিল একই চিত্র : খুড়িয়ে হাটা একটি কুকুর যে তাদের জীবনের দশ বছরের প্রতিনিধিত্ব করছে। আরো খানিকটা দূর অবধি তারা হাটে, তারপর, তাদের হতাশ করেই কারেনিন থেমে যায় আর ঘুরে হাটতে শুরু করে। তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়।

হয়তো সেই দিন বা তার পরের দিন তেরেজা টমাসকে একটি চিঠি পড়তে দেখেছিল, দরজা খোলার শব্দ পেয়ে সে চিঠিটা অন্য কাগজের মধ্যে রেখে দেয়, কিন্তু কাজটি করতে সে দেখে ফেলেছিল। ঘর থেকে বের হবার সময় তেরেজা লক্ষ্য করেছিল চিঠিটা সে পকেটে ঢোকাচ্ছে, কিন্তু টমাস খামটার কথা ভুলে গিয়েছিল। যখনই তেরেজা বাসায় একা ছিল, সে খুব ভালো করে সেটি পরীক্ষা করে দেখে। ঠিকানাটা অপরিচিত হাতের লেখা, কিন্তু খুব পরিষ্কার, সে ধারণা করে হয়তো কোনো মহিলার।

পরে টমাস বাসায় আসলে, নির্লিপ্তভাবে তেরেজা তাকে জিজ্ঞাসা করে, কোনো চিঠি এসেছে কিনা।

‘না’, টমাস বলে। উত্তরটি তেরেজাকে হতাশায় পূর্ণ করে, সেই হতাশা আরো খারাপ কারণ সে এমন অনুভূতির সাথে বেশ অনভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল। না, সে বিশ্বাস করে না যে গ্রামে কোথাও তার গোপন প্রেমিকা আছে। এটি প্রায় অসম্ভব। কারণ প্রতিটি অবসর সময় সে কি করে তা তেরেজা জানে। হয়তো তার কেউ আছে প্রাগে, যে এখনও তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ যে সে তার কথা ভাবে যদিও তার যোনীর গন্ধ আরে সে রেখে যায় না টমাসে চুলে। তেরেজা বিশ্বাস করেনা যে টমাস কোনো রমণীর জন্য তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে। কিন্তু দুবছর এই গ্রামের থাকার সময়কালীন তাদের সুখ এখন দূষিত হয় মিথ্যার দ্বারা।

একটি পুরোনো ভাবনা তার মনে ফিরে আসে: তার ঘর ছিল কারেনিন, টমাস নয়। কে তাদের দিনের ঘড়ির সময় রাখতো যখন সে থাকতো না?

মনে মনে ভবিষ্যৎে যায় সে, কারেনিন ছাড়া ভবিষ্যৎ, নিজেকে তার পরিত্যক্ত মনে হয়।

কারেনিন ঘরের এক কোনায় শুয়ে যন্ত্রণায় কাঁদছিল। তেরেজা বাগানে বেরিয়ে আসে, সে দুটি আপেল গাছের মাঝখানে এক চিলতে ঘাসে ঢাকা জায়গা লক্ষ্য করে, কল্পনা করে ওখানে কারেনিনকে সে কবর দেবে। সে মাটিকে গোড়ালি ঢুকিয়ে ঘাসের উপর আয়তাকার একটি দাগ কল্পনা করা করে। এখানেই তার কবর হবে।

‘কি করছো তুমি’? টমাস জিজ্ঞাসা করে, তাকে চমকে দেয় ঠিক যেমন করে সে তাকে চমকে দিয়েছে কয়েক ঘণ্টা আগে একটা চিঠি পড়ার সময়।

সে কোনো উত্তর দেয়না, বহু মাস পর টমাস লক্ষ্য করে তার হাত কাঁপছে। টমাস তার হাত ধরে, কিন্তু তেরেজা হাত ছাড়য়ে নেয়।

এটা কি কারেনিনের কবর’?

সে উত্তর দেয় না।

তার নীরবতা অসহ্য মনে হয় টমাসের, সে চিৎকার করে বলে, ‘প্রথমে তুমি আমাকে বললে তাকে অতীত কালের অর্থে না ভাবতে, আর তারপর তুমি নিজে কি করছো ? তুমি শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের আয়োজন করছো!

তেরেজা কোনো কথা না বলে সেখান থেকে চলে যায়।

টমাসও তার ঘরে যায়, শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করে দেয় সে।

তেরেজা ভিতরে যায়, দরজা খোলে, ‘সারাক্ষণ নিজের কথা না ভেবে, অন্তত তার জন্য খানিকটা বিবেচনা করো’, সে বলে, ‘তুমি না জাগানো অবধি সে ঘুমাচ্ছিল, এখন সে আবার কাঁদতে শুরু করবে’।

সে জানে সে সুবিচার করছে না (কুকুরটি ঘুমাচ্ছিল না), সে জানে সে খুবই অসভ্য মহিলার মত আচরণ করছে, যাদের কাজ কষ্ট দেয়া এবং জানে কিভাবে সেটি করতে হয়। টমাস পা টিপে টিপে রুমে ঢোকে যেখানে কারেনিন শুয়ে আছে, কিন্তু কুকুরের সাথে তাকে সে একা ছাড়াবে না, তারা দুজনেই তার উপর ঝুঁকে পড়ে, প্রত্যেকে তাদের নিজেদের দিক থেকে। এই আচরণের কোথাও মীমাংসা হবার আভাস নেই। বরং পুরো এর বিপরীত, তারা প্রত্যেকেই একা। তেরেজা তার কুকুরের সাথে, টমাস তার কুকুরের সাথে।

এভাবে বিভক্ত, প্রত্যেকে একা হয়েই, দুঃখের সাথে বলতে হয়, তারা কারেনিনের শেষ ঘণ্টা অবধি তার সাথে ছিল।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য