‘ম্যান্ডেলার দেশে’ : একটি অনবদ্য ভ্রমণ সাহিত্য

 প্রকাশিত: ২০১৭-০২-২৭ ১৭:২২:২৭

দেব প্রসাদ দেবু:

ফ্রিডম ক্যান নট বি ম্যানাকল্ড- স্বাধীনতা বেঁধে রাখা যায় না; এটি দক্ষিণ আফ্রিকার রুবেন আইল্যান্ডে নামতেই চোখে পড়া একটা অমর বাক্য। ১৯৬২ সালে বিনা অনুমতিতে দেশ ত্যাগের অভিযোগে নেলসেন ম্যান্ডেলাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে বন্দি করা হয় রুবেন আইল্যান্ডের কারাগারে। রুবেন আইল্যান্ড হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকার সেই বিখ্যাত কারাগার যেখানে কেটেছে কিংবদন্তী নেলসেন ম্যান্ডেলার ২৭ বছর জেল জীবনের ১৮ বছর! তাঁর কারাজীবনও বিষিয়ে তুলেছিলো শাসক শ্রেণী। নানা প্রলোভনে তাঁকে মুক্তির আশ্বাস দেয়া হয়েছিলো, আর সেগুলোকে পায়ে মাড়িয়ে রুবেন আইল্যান্ডের কারাগারে বসে মাদিবা করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত উক্তি- অনলি আ ফ্রি ম্যান ক্যান নেগোশিয়েট।

দক্ষিণ আফ্রিকা মানেই লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস, দক্ষিণ আফ্রিকা মানেই শিকল ভাঙার ইতিহাস। আর দক্ষিণ আফ্রিকার গল্প আসলেই অবধারিত ভাবে আসবে মাদিবার কথা, তাঁর সংগ্রামের কথা, তাঁর আত্মত্যাগের কথা, তাঁর অর্জনের কথা। শুধু দক্ষিণ আফ্রিকাই বা বলি কেনো? কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের কথা বললেই মনের অজান্তে ভেসে আসে মাদিবার অতি পরিচিত সেই অবয়ব। যিনি শুধুমাত্র গাত্রবর্ণের কারণে সুদূর অতীত থেকে দাস হয়ে চালিত হয়ে নিপীড়িত হয়ে আসা মানবগোষ্ঠীর অধিকারের জন্য লড়ে গেছেন সারাটা জীবন।

দক্ষিণ আফ্রিকার কেইপ টাউনে দাস বোঝাই জাহাজ প্রথম এসেছিলো ১৬৬৮ সালের ২৮ মার্চ। অমের্সফোর্ট নামের সেই ডাচ বাণিজ্য জাহাজে মোট ১৭৪ জন এঙ্গোলিয়ান দাস ছিলো। সেই শুরু, তারপর থেকে কেইপ টাউন হয়ে উঠে দাস বিক্রির উর্বর যায়গা। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দাস নিয়ে আসা হতো এই অঞ্চলে। এই কালো দাসদের অতীত নিয়ে আমরা কেউ ততটা ঘাটাঘাটি করিনি বলে জানিই না আমাদের পূর্বপুরুষেরও কিছু রক্ত মিশে আছে এই আফ্রিকায়। আফ্রিকায় শিক্ষকতায় যুক্ত ভারতীয় নাগরিক অধ্যাপক অংশু দত্ত –“ফ্রম বেঙ্গল টু দ্যা কেইপ: বেঙ্গলি স্লেইভস ইন সাউথ আফ্রিকা” নামের এক বইতে দেখিয়েছেন ওলন্দাজরা তৎকালীন বাংলা থেকে প্রচুর বাঙালী ধরে নিয়ে আরাকান অঞ্চল দিয়ে দাস হিসেবে পাচার করেছে আফ্রিকায়। ফলে ম্যান্ডেলা আফ্রিকান কালোদের জন্য লড়েছেন সেটি সত্য হলেও পরোক্ষ ভাবে আমাদের পূর্ব পুরুষের জন্যও তাঁর লড়াই ছিলো বলতে হয়। সবকিছু মিলিয়ে 'ম্যান্ডেলার দেশে' শিরোনামে ভ্রমণ সাহিত্য দেখে পড়া শুরু করেছিলাম লেখকের চোখে এই বিচিত্র আফ্রিকা দেখবো বলে।

ভ্রমণ কাহিনী এখন আর নেহাত গেলাম, খেলাম, ঘুরলাম, আড্ডা দিলাম-এ সীমাবদ্ধ নেই অনেকদিন ধরেই। এটি এখন ‘কাহিনীর’ গণ্ডি পেরিয়ে ‘সাহিত্যের’ গণ্ডিতে পৌঁছে গিয়েছে। প্রদীপ দেব'এর “ম্যান্ডেলার দেশে”ও নেহাত এলাম, খেলাম, ঘুরলাম-এ সীমাবদ্ধ থাকেনি। লেখকের ঘুরে বেড়ানো স্থানগুলোর ঐতিহাসিক কাহিনীও উঠে এসেছে প্রাসঙ্গিক আলোচনায়। রাষ্ট্র, সমাজ, দেশ এসব নিয়ে, শাসন ব্যবস্থা নিয়ে কিছু পড়তে গেলেই মনে আসে কার্ল মার্কস-এর অমর বাণী। তিনি বলেছিলেন-রাজনীতি হচ্ছে শ্রেণী নিপীড়নের হাতিয়ার। দক্ষিণ আফ্রিকায়ও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। দক্ষিণ আফ্রিকার রাজনীতিও আবর্তিত হয়েছে শ্রেণী নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবেই। কৃষ্ণাঙ্গদের জমির অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে রাজনীতিবিদরা সেখানে ৮৬ টি ভূমি আইন পাশ করেছিলো। যেসব আইনের মাধ্যমে জনসংখ্যার ৭৪ ভাগ কৃষ্ণাঙ্গকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছিলো ১৩ ভাগ জমিতে। আইন করে দেয়া হয় কালোদের সাথে সাদাদের বিয়েতো দূরের বিষয়, কোনরূপ সম্পর্কই রাখা যাবে না, কালোরা নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে না, ভোট দিতে পারবে না......। ‘না’-এর কোন সীমা পরিসীমা ছিলো না। যেসবের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে যায় নেলসেন ম্যান্ডেলার। এসব কাহিনীর চমৎকার বর্ণনা আছে প্রদীপ দেব-এর “ম্যান্ডেলার দেশে” বইতে। প্রাসঙ্গিক এসব ইতিহাসের ছোঁয়ায় এলাম, খেলাম, ঘুরলামকে ছাপিয়ে বইটিকে করে তুলেছে বেশ প্রাণবন্ত, বাড়িয়ে দিয়েছে এর সাহিত্য মূল্যও।

প্রদীপ দেব মূলত বিজ্ঞানের মানুষ। লিখেন বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের নিয়ে। পেশাগত জীবনেও দেখা যাচ্ছে শিক্ষকতায় যুক্ত আছেন অস্ট্রেলিয়ার স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে সাধারণ ভ্রমণ পিপাসীদের দৃষ্টির সাথে জুটে গিয়েছে লেখকের বিজ্ঞান পিপাসী দৃষ্টি। আমার মতো সাধারণ পাঠকের জানাই ছিলো না বিশ্বের প্রথম হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন হয়েছিলো দক্ষিণ আফ্রিকার একটি হাসপাতালে। "ম্যান্ডেলার দেশে" পড়ে জানা হলো। সেই সাথে এই প্রতিস্থাপনের ইতিহাসও। জানা হলো কেইপটাউন থেকে সাদা আর কালো মানুষদের আলাদা করে দেয়ার সময়কার সময়ে মানবতাবাদী ডাক্তার বার্নার্ডের সাদা-কালো এক করে দেয়ার , খ্রিস্টান-ইহুদি এক করে দেয়ার অনন্য এক ইতিহাস। ডেনিসের কিডনি নিয়ে বেঁচে উঠেছিলো জনাথন নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ বালক। ব্যাপারটা সহজ ছিলো না। সাদা আর কালোদের মধ্যে যেহেতু কোনরূপ সম্পর্কই রাখা যেতো না তাই বলা হলো ডক্টর বার্নার্ড অপরাধ করেছেন। কিন্তু সেসবে মাথা ঘামাতে রাজি ছিলেন না মানবতাবাদী এই চিকিৎসক। লেখকের বর্ণনা শৈলীতে যেটি হয়ে উঠেছে অনবদ্য।

আমাদের অনেকের ধারণা যে, সাদাদের বৈষম্যমূলক শাসনের যবনিকার পর দক্ষিণ আফ্রিকায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সাম্য এসেছে। আসলে সাম্য বিষয়টার অর্থই এখন পালটে গিয়েছে বাজার অর্থনীতির ধাক্কায়। সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি এখন বাজার বুঝে। বাজারকে ঘিরেই আবর্তিত হয় প্রতিনিয়ত। ফলে এক শোষণের পরে প্রতিষ্ঠা পায় অন্য শোষণ। এক আধিপত্যবাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যায় অন্য আধিপত্যবাদ। বাজারের খেলোয়াড় শুধু পরিবর্তন হয়, সামগ্রিক সমাজের নয় । বর্তমান দক্ষিণ আফ্রিকাও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশ্বের অপরাধ প্রবণ দেশগুলোর মধ্যে আফ্রিকান দেশগুলো যে অন্যতম এই তথ্য আমাদের অজানা নয়। সেই অপরাধের মূলে রয়েছে অর্থনীতি। আরো স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় বৈষম্যের অর্থনীতি। বর্তমান গণতান্ত্রিক শাসনে দক্ষিণ আফ্রিকায় তৈরি হচ্ছে আরেকটা ধনিক শ্রেণী। এই ধনিক শ্রেণী কৃষ্ণাঙ্গ। এরা নিজেদের সম্পদকে, নিজেদের আবাসকে বঞ্চিত কিংবা বুভুক্ষু অপরাধপ্রবণদের থেকে নিরাপদ রাখতে প্রাসাদ প্রাচীরে লাগিয়ে রেখেছে হাই ভোল্টেজের বৈদ্যুতিক তার। যেই তারে শরীর লাগলে মৃত্যুও হতে পারে। সামাজিক বৈষম্য এই ভ্রমণ সাহিত্যের উপজীব্য না হলেও লেখকের সচেতন চোখ এড়িয়ে যায়নি এই ভয়ংকর ব্যবস্থাও।

ডিসট্রিক্ট সিক্স মিউজিয়াম দক্ষিণ আফ্রিকা ভ্রমণ পিপাসীদের জন্য একটা আগ্রহের জায়গা। এই মিউজিয়ামের অতীতে প্রথিত আছে এক করুণ ইতিহাস। এই অঞ্চলে বসবাসরত ৬০ হাজার মানুষকে বিভিন্ন আইনের ফাঁদে ফেলে বাস্তু চ্যুত করা হয়েছিলো ১৯৬৮ সালে। লেখক তাঁর অনবদ্য লেখনীতে তুলে এনেছেন সেই নির্মম ইতিহাস। এখানে লেখকের একটা পর্যবেক্ষণ বেশ লেগেছে আমার। তিনি লিখেছেন-

"মানবজাতির ইতিহাস বড় বিচিত্র আর স্ববিরোধীতায় ভরা। হিটলার উঁচু-জাতি-নিচু-জাতি, আর্য-অনার্য ইত্যাদি প্রশ্ন তুলে বিশ্বযুদ্ধ বাঁধিয়ে ফেললো। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ফ্রান্স সবাই একজোট হয়ে হিটলারকে পরাজিত করলো। সব মানুষ সমান এটাই ছিলো আদর্শ। অথচ দেখা গেলো দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ সরকার অশ্বেতাঙ্গদের জাতিসত্তা, গায়ের বর্ণ, ভাষা ইত্যাদির ভিত্তিতে আলাদা করে ফেলতে আইন পাশ করে ফেললো। গ্রুপ এরিয়া এ্যাক্ট নামে যে আইন পাশ হলো তার মূল কথা হলো বর্ণভেদ। যদিও সরকারের ভাষ্য হলো এই আইনের ফলে প্রত্যেক জাতি আলাদা আলাদা যায়গায় আলাদা আলাদা ভাবে বেশ ভালো থাকবে"।

যুগে যুগে আসলে এমনটাই হয়ে এসেছে বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন সমাজে। শ্রেণী ব্যবস্থা ঝেঁকে বসেছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কখনো বর্ণের দোহাই দিয়ে, কখনো সামাজিক প্রতিপত্তি, কখনো পেশা বিবেচনায়। মানুষের সমাজ কোথাও হয়নি, হয়েছে শ্রেণির সমাজ। আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের শোষণ শাসনও এর বাইরে ছিলো না। কিংবা নেই বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বৈষম্যের ভিত্তিও। লেখকের সাবলীল বর্ণনা শৈলীতে আমরা দেখতে পাই দুই আফ্রিকার বৈষম্যের ইতিহাস, শাসনের ইতিহাস, শোষণের ইতিহাস। সেই সাথে দেখি অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের নিখুঁত বর্ণনা। বইটিতে ব্যক্তিগত ভ্রমণ ইতিবৃত্ত বর্ণিত হলেও, লেখক এখানে প্রাসঙ্গিক ইতিহাসকে টেনে এনেছেন দুর্দান্ত ভাবে। সহযাত্রীর সাথে কিংবা চারপাশের মানুষের সাথেকার কথোপকথনগুলো লেখাকে করেছে বেশ প্রাণবন্ত এবং আকর্ষণীয়। ইতিহাস বর্ণনাও ম্যাড়ম্যাড়ে একঘেয়ে নয়, যা পাঠককে সহজভাবে ইতিহাস জানতে উৎসাহিত করবে নিঃসন্দেহে।

এসবের বাইরে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো লেখকের লেখার হাতের চেয়েও কম যায় না ছবি তোলার হাত। দুর্দান্ত ফটোগ্রাফি আছে বইটিতে অনেকগুলো, যা লেখকের নিজের হাতে তোলা। এছাড়া বলতে হয়ে পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ভ্রমণের এবং ভ্রমণ-কৃত এলাকার ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতা এসেছে চমৎকার ভাবে। সর্বোপরি বলতে হয় মীরা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত চমৎকার মলাটের ১৭৬ পৃষ্ঠার "ম্যান্ডেলার দেশে" চমৎকার একটা ভ্রমণ সাহিত্য । হাতেগোনা অল্প কিছু মুদ্রণ প্রমাদ না হয় “গো’চনা” বলেই মেনে নিলাম পাঠক হিসেবে।

আপনার মন্তব্য